ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রাজশাহীর ‘আমরাজ্যে’ নতুন অতিথি ‘রাঙা সিঁদুর’

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১০ জুলাই ২০১৭

রাজশাহীর ‘আমরাজ্যে’ নতুন অতিথি ‘রাঙা সিঁদুর’

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ ‘আমরাজ্য’ খ্যাত রাজশাহীতে জাতের দিক দিয়ে ধরলে বাহারি অসংখ্য জাতের আম মিলবে বাগানে বাগানে। তবে রঙে দৃষ্টিনন্দন আর অতুলনীয় স্বাদের একেবারে নতুন জাতের আমের সন্ধান মিলেছে এবার রাজশাহীর আমরাজ্যেই। প্রাতিষ্ঠানিক কোন নাম এখনও দেয়া না হলেও নতুন এ আমের নামকরণ হয়েছে ‘রাঙা সিঁদুর’। সাধারণত গাছে কাঁচা আমের রঙ সবুজ থাকলেও এ আমের রহস্য হলো কাঁচা অবস্থাতেও সিঁদুরের রঙের মতো লাল। পাকলে সে রঙ আরও গাঢ় কমলা-লাল। তাই স্থানীয়ভাবে আমটির নাম দেয়া হয়েছে ‘রাঙা সিঁদুর’। আম গবেষকরা বলছেন, দেশে এখন পর্যন্ত এমন বাহারি রঙিন আম আর নেই। মনলোভা আকর্ষণীয় রঙের পাশাপাশি এ আমের অন্যান্য গুণাগুণও সাধারণত যে কোন আমের চেয়ে কোন অংশে কম নেই। বরং এর পুষ্টিগুণ বেশ ভাল। রাজশাহীর পবা উপজেলার গ্রামের একটি বাগানে এ জাতের বাহারি আমের সন্ধান মিলেছে এবার। গাছটিতে এবারই প্রথম মুকুল এসেছিল। ছোট আকারের গাছে ধরেছে ২৫টি আম। গাছের মালিক রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মোহাম্মদ মঞ্জুরুল হক নিজেই। তার দাবি, এখন পর্যন্ত এটিই দেশের সবচেয়ে বেশি ‘রঙিন’ আম। এমন মনলোভা ও আকর্ষণীয় আম আর নেই। মঞ্জুরুল হক জানিয়েছেন, সম্প্রতি গাছে আমটি পাকতে শুরু করেছে। কিন্তু কোন নাম না থাকায় তিনি নিজের ফেসবুকে কয়েকটি কাঁচা-পাকা আমের ছবি আপলোড করেছিলেন। সেখানে তিনি আমের নাম দিতে সবার প্রতি আহ্বান জানান। একজন নাম দেন ‘রাঙা সিঁদুর’। নামটি তার কাছে ভাল লাগে। ফেসবুকে আরও অনেকে নামটি পছন্দ করেন। এখন তিনি নামটি সরকারীভাবে নিবন্ধনের কথা ভাবছেন। মঞ্জুরুল হক বলেন, ২০১২ সালে তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জের একটি আমবাগানে এই আমের গাছের প্রথম সন্ধান পান। গাছটি ছিল দুটি বাগানের মাঝামাঝি স্থানে। তার ধারণা, পাশাপাশি দুই বাগানের দুটি গাছের মুকুলের পরাগায়নের ফলে এ আমের নতুন উদ্ভব হয়েছে। জীর্ণশীর্ণ ওই গাছে এমন রঙিন আমের খবর পেয়ে তিনি সেখানে যান। এরপর সেখান থেকে একটি ডাল সংগ্রহ করেন। পরে রাজশাহীর পবা উপজেলার মতিয়াবিল গ্রামে নিজের বাগানের চার বছর বয়সী আরেকটি গাছে টপ ওয়ার্কিং (কলম) করেন। সেটি টিকলে ওই ডাল থেকে চার বছর ধরে পুরো গাছটিকেই কলম করেন। এরপর এবারই প্রথম গাছে আম ধরে। তিনি আরও জানান, কাঁচা-পাকা অবস্থাতে আমটিই যে শুধু সিঁদুরের রঙের তা নয়, গাছের মুকুলও ধরেছিল লাল বর্ণের। সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমি। তিনি জানান, এ জাতের আমের গড় ওজন ৩৫০ গ্রামের বেশি। এর মধ্যে ওপরের খোসা ৫০ গ্রাম। আর আঁটি ৪৪ গ্রাম। বাকিটা আমের পাল্প। আঁটিতে নেই কোন শাঁস। এর টিএসএস শতকরা সাড়ে ১৪ শতাংশ। পাকলে প্রচ- রকমের সুগন্ধ ছড়ায় আমটি। গুটি অবস্থায় আমের রঙ লালচে থাকলেও বড় হওয়ার পর ফেড হয়ে কিছুটা হালকা রঙ ধারণ করে। পেকে গেলে আবার গাঢ় কমলা-লাল বর্ণ হয়ে আকর্ষণীয় হয়ে উঠে। গাছে ১৫ জুনের মধ্যে পরিণত পেকে উঠে। ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে পুরো পাক ধরে। মঞ্জুরুল হক কয়েকটি আম ইতোমধ্যে তার সহকর্মীদের খাইয়েছেন। তার সহকর্মী কৃষি বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক আবদুল আউয়াল বলেন, আমটিতে সুগার কম। আকর্ষণীয় একটা স্বাদ আছে। আমের সংরক্ষণ ক্ষমতাও বেশি। বিদেশে রফতানির জন্য আমটি খুবই উপযোগী। বিদেশে এমন রঙিন আমের চাহিদাও ব্যাপক। রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলীম উদ্দিন ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের কল্যাণপুর হর্টিকালচার সেন্টারের উপ-পরিচালক ড. সাইফুর রহমান বলেন, আমটি তারাও খেয়ে দেখেছেন। মিষ্টি একটু কম হলেও আমটি তাদের কাছে সম্ভাবনাময় বলে মনে হয়েছে। স্বাদ অনেক ভাল। চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মঞ্জুরুল হুদা বলেন, ব্যাগিং প্রযুক্তি ছাড়াই এমন আকর্ষণীয় রঙের আম তিনি আগে আর দেখেননি। স্বাদে-গন্ধে আমটি অতুলনীয়। এটি খেতে লখনার জাতের আমের চেয়েও সুস্বাদু। এ জাত সম্প্রসারণ করা গেলে নতুন এই আমটি লখনাকেও ছাড়িয়ে যাবে। আমসহ অন্যান্য উদ্যানতাত্ত্বিক ফসলের নতুন জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের বিষয়ে কাজ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সেখানকার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. হামিম রেজা বলেন, নতুন এ আমটি তিনি নিজেও দেখেছেন। তিনি এটি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার উদ্যোগ নিচ্ছেন। ড. হামিম রেজা বলেন, ‘মঞ্জুরুল হকের গাছের আম তিনি নিজেও দেখেছেন। আমরা এ ধরনের রঙিন আমই খুঁজি। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমটির ডাটা রেকর্ড করা হবে। পাশাপাশি এ ধরনের কোন আম আগে থেকে আছে কী না তাও দেখা হবে। অন্য কোন আম না পেলে এটি মুক্তায়নের উদ্যোগ নেয়া হবে। তবে বাগান মালিক রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মঞ্জুরুল হক বলেন, আগামীবার পর্যন্ত তিনি দেখবেন। নিয়মিত আম আসছে কিনা। এবারে যে ধরনের স্ট্যান্ডার্ড সাইজ আছে আগামী বছরও সে ধরনের সাইজ হলে তারপর এ আমের জাতটি সম্প্রসারণ করা হবে।
×