ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ছয় কোটি টাকাগচ্চা

প্রকাশিত: ০৪:২৯, ১০ জুলাই ২০১৭

ছয় কোটি টাকাগচ্চা

আজিজুর রহমান ডল, জামালপুর থেকে ॥ মেলান্দহ উপজেলায় হতদরিদ্রদের এক শ’ দিনের কর্মসৃজন কর্মসূচী প্রকল্পের প্রায় ৬ কোটি টাকা গচ্চা গেছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জুন ক্লোজিংয়ে এ ঘটনা ঘটে। কর্মসৃজনের প্রথম পর্যায়ের ৩৮ প্রকল্পের বিপরীতে তিন হাজার ৩৩৯ শ্রমিকের দৈনিক ২০০ টাকা হারে ৪০ দিনের ২ কোটি ৬৭ লাখ ১২ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। নিয়মানুযায়ী প্রকল্পে ননওয়েজ কস্ট মাটি কাটার উপকরণ কোদাল-পাইচে ক্রয় ও প্যালাসাইডিং সম্পন্নের জন্য শতকরা ১০ টাকা হারে আরও ২৬ লাখ ৭১ হাজার ২০০ টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ দেয়া হয়। এতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ কোটি ৯৩ লাখ ৮৩ হাজার ২০০ টাকা। একই প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের সমহারে দ্বিগুণ বরাদ্দের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ কোটি ৮৭ লাখ ৬৬ হাজার ৪০০ টাকা। প্রকল্পের অগ্রগতির খোঁজ নিতে সরেজমিন দেখা গেছে, প্রথম পর্যায়ে হাতেগোনা দুই একটি প্রকল্প ছাড়া বাকি কাজগুলোয় শুভঙ্করের ফাঁকি দিয়ে শুধু কাগজে কলমেই শতভাগ কাজ দেখিয়ে অর্থ লোপাট করা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্পের এক টাকার কাজও হয়নি। জুন ক্লোজিংয়ে অর্থ ছাড়ের জন্য শুধু অফিসিয়ালভাবে প্রকল্প সাজিয়ে শতভাগ কাজ দেখানো হয়েছে। ফলে প্রকল্পের তালিকাও বাইরে প্রকাশ করা হয়নি। কর্মসূচীটি একমাত্র হতদরিদ্রদের জন্য হলেও তাদের এ সুবিধাভোগ করতে দেয়নি। প্রকল্পের টাকা নয়-ছয় রোধে ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে শ্রমিকদের মজুরি প্রদানের কথা। অভিযোগ উঠেছে, ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বার দলীয় প্রভাবে এবং ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে সাজানো শ্রমিকদের নামে ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে। প্রকৃত শ্রমিকদের করেছে বঞ্চিত। চেক বই শ্রমিকদের না দিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তা ও ইউপি চেয়ারম্যানদের অসৎ পন্থায় ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করেছে। পক্ষান্তরে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান-উপজেলা নির্বাহী অফিসার অডিটসহ অন্যান্য খরচের কথা বলে প্রকল্পের সমুদয় অর্থের শতকরা ২০ টাকা করে উৎকোচ নিচ্ছেন। প্রকল্পের অগ্রগতি বিবেচনা না করে জুন ক্লোজিংয়ে অর্থ ছাড় দিয়েছেন। অভিযোগ, উৎকোচের (পিসির) টাকার ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব পালন করছেন পিআইও অফিসের এক অফিস সহকারী। লক্ষ্য করা গেছে, প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণও অস্বাভাবিক। বাস্তবতায় দেখা যায়, মাহমুদপুর ইউনিয়নের রোকনাইপাড়া তালেব আলীর বাড়ির মোড় হতে মাফলের বাড়ি পর্যন্ত ২০০ শ্রমিকের বিপরীতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ননওয়েজ কস্টের শতকরা ১০ টাকা হারে এক লাখ ৯৮ হাজার টাকাসহ সর্বমোট ১৭ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। স্থানীয় ছামিউল জানান, তিন বছর আগে এ রাস্তায় মাটি কাটা হয়েছে। বর্তমানে কাজ করতে দেখিনি। মাফলের বাড়ির প্রতিবেশী সালেতন জানান, ভাঙ্গা রাস্তার সঙ্গে আমার বসতবাড়ি ঠিক রাখার জন্য বাঁশ দিয়ে আমি নিজে মাটি আটকেছি। এরই মধ্যে পাশের পাকা রাস্তার কাজে মালামাল নেয়ার জন্য ঠিকাদার নিজেও এই ভাঙ্গাতে কিছু রাবিশ ফেলে চলাচল উপযোগী করেছেন। এরপর একদিন কয়েকজন শ্রমিককে রাস্তার উঁচু-নিচু কাটতে দেখেছি। কিন্তু বাস্তবে তালেবের বাড়ি থেকে মাফলের বাড়ির দূরত্ব হবে প্রায় ৪০০ ফুট। এতে প্রতি ঘনফুট মাটি কাটার খরচ পড়েছে চার হাজার ৪৯৫ টাকা। প্যালাসাইটিংয়ের গন্ধও নেই। তালেব আলী জানান, ৫-১০ হাজার টাকার মাটি কাটলেও দৃশ্যমান হতো। আদ্রা ইউনিয়নের পশ্চিম আদ্রা ছাবেদের বাড়ি মোড় হতে বাদশার বাড়ি পর্যন্ত মাত্র ২০০ ফুট এবং একই গ্রামের নূরুলের বাড়ির পাকা রাস্তা হতে হযরতের বাড়ি পর্যন্ত দূরত্ব প্রায় ১৫০ ফুট। মাটি কাটার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তিন লাখ ৯২ হাজার টাকা। এতে প্রতি ঘনফুট মাটি কাটার খরচ দাঁড়ায় এক হাজার ১২০ টাকা। দেখা গেছে, বাদশার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তার পাশে বসতি। এখানে মাটি কাটা কিংবা মাটি ভরাটের মতো স্থানই নেই। নূরুলের বাড়ির পাকা রাস্তার মোড় থেকে হযরতের বাড়িটি দাঁতভাঙ্গা নদীর তীরবর্তী মাত্র তিনটি বাড়ি। এখান দিয়ে দু’পায়ে চলাচল করতে হয়। এখানে কোন মাটি কাটার পরিবেশ বা মাটি কাটার চিহ্নও নেই। অভিযোগ অস্বীকার করে আদ্রা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল করিম ফরহাদ জানান, আমি কাজও করেছি। টাকাও তুলেছি। তবে শ্রমিক দিয়ে নয়। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের নিজ এলাকা নাংলা ইউনিয়নের চারাইলদার বাজারের পশ্চিম পাশে সেতু থেকে চারাইলদার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত দূরত্ব হবে প্রায় ৬০০ ফুট। এরমধ্যে ঈদগাহ মাঠ আছে। ঈদগাহ মাঠে মাটি কাটতে হবে না। এতে বরাদ্দ দেখানো হয়েছে পাঁচ লাখ ৬২ হাজার টাকা। স্থানীয় কৃষক রাজা মিয়া বলেন, শুধু সেতুর পাশে সামান্য মাটি ফেলা হয়েছে। শুনেছি আমারও নাম শ্রমিক তালিকায় আছে। সত্যতা জানার চেষ্টা করলে আমাকেও কিছু টাকা দিয়েছে। আমি কাজও করিনি। এভাবে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের আত্মীয়দের দিয়ে শুধু টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। নাংলা ইউপি চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান মাফল বলেছেন, আমি টাকা উত্তোলন করলেও পরে কাজ করব। কিছু করাচ্ছি। অন্যরা তো কিছুই করেনি। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম হাবিবুর রহমান চাঁনের বিয়াই চরবানিপাকুরিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহাদাৎ হোসেন ভুট্টোর এলাকায় বেতমারী দক্ষিণপাড়া পাকা রাস্তার মাথা থেকে দক্ষিণপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত রাস্তা মেরামতের বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ননওয়েজ কস্টসহ মোট ১০ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এ রাস্তার দূরত্ব প্রায় ২৫০ মিটার। দেখা গেছে, এ রাস্তার মাটি কাটার প্রয়োজনই নেই। এর চেয়েও অবহেলিত রাস্তা প্রকল্প হওয়া উচিত ছিল। এ গ্রামের আব্দুল আজিজ মাস্টার জানান, শুনেছি বরাদ্দ দিয়েছে ৭০ হাজার টাকা। ৩০ হাজার টাকার চুক্তিতে শ্রমিকদের রাস্তা চাছাছোলা করতে দেখেছি। ফুলকোচা ইউনিয়নের হাজরাবাড়ি সিএন্ডবি রাস্তায় রহিমের দোকান থেকে গুজাদহ বিল পর্যন্ত রাস্তা মেরামতের বরাদ্দ দেয়া হয়েছে আট লাখ ৪৪ হাজার টাকা। রাস্তাটি সম্পূর্ণ সচল। মাটি কাটার কোন প্রয়োজনই হয়নি। তবে শাহজাহানের দোকানের সামনে একটু নিচু স্থান। এখানেও কোন মাটি ফেলা হয়নি। ব্রাহ্মণপাড়া শাহজাহানের বাড়ি থেকে ফরিদ মেম্বারের বাড়ি পর্যন্ত ঝকঝকে রাস্তার দূরত্ব হবে প্রায় ৪০০ ফুট। এই রাস্তার মাটি কাটার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে আট লাখ ৪৪ হাজার টাকা। রাস্তার মাথায় গাছে টানানো সাইনবোর্ডে বরাদ্দের পরিমাণ লেখা আছে। বিলের তীরে সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকার মাটি কাটা হয়ে থাকতে পারে বলে স্থানীয়রা জানান। ফুলকোচা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম বাবু জানান, রাস্তা সচল ছিল না। দুই মাস আগে মাটি কেটেছি। এখনও কি মাটি থাকবে? এভাবেই প্রতিটি প্রকল্পে অনিয়মের চিত্র পাওয়া যায়। মেলান্দহ উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক এমদাদুল ইসলাম জানান, সাধারণ শ্রমিকের মুখের আহার কাড়া বন্ধে দলের অবস্থান পরিষ্কার। কোন অজুহাতে লুটপাট চলে? প্রয়োজনে দলীয়ভাবে মোকাবেলা করা উচিত। এ বিষয়ে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম হাবিবুর রহমান চাঁনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোন কথা বলতে রাজি হননি।
×