ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বজিত রায়

বন্যা ॥ অসহায় বানভাসি মানুষ

প্রকাশিত: ০৩:৩৫, ১০ জুলাই ২০১৭

বন্যা ॥ অসহায় বানভাসি মানুষ

পাহাড়ী কান্নার কবল থেকে মুক্ত হতে না হতেই জলাবদ্ধতার ছোবলে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। মাত্র মাসখানেকের ব্যবধানে কয়েকবার জলজটের বিরক্তিকর ব্যথায় আক্রান্ত চট্টলা নগরী। টানা বর্ষণে জেলার কয়েকটি উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। জোয়ারের সময় কর্ণফুলী, হালদাসহ বিভিন্ন নদী ও খালের পানি বেড়ে এসব উপজেলার একাধিক গ্রাম প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। জলাবদ্ধতার অবিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারছে না চট্টগ্রাম। শুধু পাবর্ত্য অঞ্চলই নয় সিলেট ও সুনামগঞ্জসহ দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় হানা দিয়েছে বন্যা। সুনামগঞ্জের সুরমার নদীর পানি বিপদসীমার ৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওড় পারের মানুষ পানিবন্দী অবস্থান দিন পার করছে। কক্সবাজার জেলার মিঠাপানির তিন নদী মাতামুহুরী, ফুলেশ্বরী ও বাঁকখালীতে নেমেছে পাহাড়ী ঢল। ঢলের তোড়ে ভেঙ্গে গেছে ঈদগাঁওয়ের রাবার ড্যাম এলাকার বাঁধ। অপরদিকে রাজধানী ঢাকার কথা না বললেই নয়। বৃষ্টি হলেই ঢাকার সড়কে হাঁটু পানি। বর্ষায় অনেক সড়ক খাল-বিলে পরিণত হয়। এই কর্মব্যস্ত ঢাকা মহানগরীর সড়কগুলোয় জলজট আর জানজটে জনদুর্ভোগের যেন কোন সীমা-পরিসীমা নেই। প্রতিবছরই বর্ষাকালে একটু ভারি বৃষ্টিপাতে ঢাকায় স্কুল শিক্ষার্থী, শ্রমজীবী, চাকরিজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষকে এই চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। চারপাশে বন্যার খবরে স্বস্তিতে নেই ঢাকাবাসী। শহরে বসে তাদেরও পোহাতে হচ্ছে জলজটের ঝক্কি ঝামেলা। টানা বৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলের কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বন্যার ব্যাপকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। বন্যাকবলিত মানুষরা মারাত্মক সঙ্কটকাল অতিক্রম করছে। খাদ্য সঙ্কটসহ দুর্ভোগ দুর্গতির ব্যাপক বিপর্যয়ের মুখে পতিত করেছে খেটে খাওয়া মানুষকে। বাড়িঘরে পানি উঠায় নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দৌড়াচ্ছে প্লাবিত অঞ্চলের অসংখ্য পরিবার। ত্রাণ সহায়তার খবর পেলেই সেখানে দৌড়ে হাজির হচ্ছে দুর্গত মানুষ। কিন্তু পর্যাপ্ত ত্রাণ সহযোগিতা না পেয়ে খালি হাতেই ফিরে যেতে হচ্ছে বন্যাপ্রবণ মানুষকে। একদিকে বানভাসি মানুষ যেমন গৃহহীন হয়ে পড়েছে, অন্যদিকে খাদ্য সঙ্কটের ব্যাপকতায় অনাহারী প্রাণের করুণ আর্তনাদ। সম্বলহারা সামর্থ্যহীন মানুষগুলো বন্যার পানিতে ভাসতে ভাসতে কোন রকম বেঁচে আছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষরা আকুলিত আশায় তাকিয়ে থাকেন কোন সাহায্য সহযোগিতার জন্য। সরকারের পর্যাপ্ত ত্রাণ তৎপরতা কিংবা বিত্তশালী মহলের একটু সহযোগিতাই পারে বন্যা কবলিত অসহায় মানুষকে রক্ষা করতে। কিন্তু বন্যার্ত মানুষ অসহিষ্ণু দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেও তাদের কপালে জুটছে না কোন ধরনের সহযোগিতা। সরকারের ত্রাণ সহযোগিতা পর্যাপ্ত না থাকায় আশা ভঙ্গ হচ্ছে বিপদাপন্ন অজস্র্র মানুষের। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অল্প যা দেয়া হচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এছাড়া এখানে রয়েছে স্বজনপ্রীতি দুর্নীতি। সরকারকে দুর্দশাপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। বুঝতে হবে তাদের আর্তনাদ আহাজারির বেদনার্থ সুর। বন্যা দুরবস্থার দুর্গম দিক বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে গ্রহণ করতে হবে দুর্যোগ নিরসন ব্যবস্থা। যে মানুষগুলো অনাহারী-অর্ধাহারী অবস্থায় দিনাতিপাত করছে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে সরকার, স্থানীয় সাংসদ, রাজনীতিক, জনপ্রতিনিধি ও সম্পদশালী মহলের প্রতি রইল জোর তাগিদ। চারপাশ পানিতে থৈ থৈ। হাওড়-বাওড় ও নদী-নালা উপচে রাস্তাঘাট এবং বাড়ি-ঘরে ঢেউ খেলছে বন্যার ঘোলাটে পানি। বসবাস অনুপযোগী হয়ে পড়েছে বাসস্থান। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে মানবিক বিপর্যয় সম্বলিত হাহাকার ধ্বনি। এ মুহূর্তে পল্লী জনপদের বিপর্যস্ত মানুষরা মারাত্মক সঙ্কটকাল অতিক্রম করছে। বিশেষ করে গরিব-দুঃখী নিরুপায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী অন্নহীন এক অস্বস্তিকর পরিবেশে সময় কাটাচ্ছেন। আশ্রয়হীন নিরন্ন মানুষের আকুতি হৃদয় গহিনে দিচ্ছে ঝাঁকুনি। অল্পক্ষণের জন্য চলে আসে বিমর্ষ ভাব। ভেবে পাই না কিছু। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এসব বন্যা কবলিত মানুষের দুঃখ-দুর্দশা যেন বুঝেও বুঝে না। অনেক বিত্তশালী সমাজপতি আছেন যারা নিজের সুখ-শান্তি ও আরও চাই নীতিতে বিশ্বাসী। আর রাজনীতির সংস্পর্শে থাকা কিছু চাটুকার হাইব্রিড নেতাদের কথা বলাটাও ঝুঁকির ব্যাপার। বন্যায় বিপদসঙ্কুল মানুষের জন্য সরকারী বরাদ্দকৃত ত্রাণসামগ্রীর বেশিরভাগ অংশ চলে যায় এদের পকেটে। যারা ফুলে ফেঁপে হয় হৃষ্টপুষ্ট আর পীড়িত জনতা বন্যার ঘোলাটে পানিতে ভেসে বেড়ান সর্বক্ষণ। ঋতু পরিক্রমায় চলছে বর্ষাকাল। বর্ষা বাংলার প্রকৃতিকে ধুয়ে মুছে ঝকঝকে করার এক পরিচ্ছন্ন ঋতু। গ্রীষ্মের তপ্ততায় রুক্ষ চারপাশ যখন খুঁজে ফিরে একটু শীতল পরশ তখন বর্ষা আসে বৃষ্টিভেজা কদম, হিজল, চালতা, তালের পুষ্প হাসি ও আলাদা সৌরভ নিয়ে। ঋতু বৈচিত্র্যের প্রকৃতিগত নিয়মতান্ত্রিকতা বজায় রেখে এসেছে বর্ষাকাল। অঝোর বৃষ্টির রিমঝিম ঝঙ্কারে প্রকৃতি অনেকটা শীতল। বৃষ্টি¯œানে প্রকৃতি তার তৃপ্ততা গুছাতে পারলেও বন্যায় ভাসছে দেশের অনেক অঞ্চল। আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল। এ সময় অন্য মাসের তুলনায় স্বাভাবিকভাবেই একটু বেশি বৃষ্টিপাত হয়। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলেই হাওড়াঞ্চলের প্রতিটি এলাকায় বন্যা দেখা দেয়। এবার বর্ষার শুরুতেই দেখা দিয়েছে বন্যা। বন্যার কবলে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষ। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বন্যা বিপর্যস্ত মানুষের জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ। কৃষিনির্ভর এ দেশটি মূলত মৌসুমী জলবায়ুর ওপর নির্ভরশীল। আমাদের দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে রয়েছে বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, নদীভাঙ্গন, খরা, ভূমিকম্প ইত্যাদি। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে বন্যার আঘাতই সবচেয়ে ভয়াবহ। অন্য দুর্যোগগুলো কিছু কিছু এলাকায় আঘাত হানলেও বন্যা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। নদী-নালা, হাওড়-বাঁওড়, খাল-বিল, ডোবা-নালা, নি¤œাঞ্চল যখন পানিতে ডুবে গিয়ে রাস্তাঘাট ক্ষতিসাধনসহ সাধারণ মানুষের জীবনে দুর্ভোগ নেমে আসে তখন তাকে বন্যা হিসেবে গণ্য করা হয়। তখনকার পরিবেশে গৃহপালিত পশু থেকে শুরু করে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের রোগ-ব্যাধির সংক্রমণ ঘটে। প্রতিবছরই আমাদের দেশে কম-বেশি বন্যা হয়ে থাকে। তীব্র বন্যা বলতে তিন-চার বছর অন্তর অন্তর সংঘটিত হয়। মারাত্মক বন্যা বলতে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অন্তর হয় এবং প্রলয়ঙ্করী বন্যা বলতে প্রতি দশ বছর অন্তর অন্তর হয়ে থাকে। এক তথ্যানুযায়ী দেখা যায়, গত ১৯৮৮, ১৯৯৮ ও ২০০৪ সালে আমাদের দেশে ভয়াবহ বন্যা হয়ে গেছে। ২০০৪ সালের বন্যাটি স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা হিসেবে পরিচিত। ঐতিহাসিক সমীক্ষা অনুযায়ী পেছনের দিকে তাকালে দেখা যায়, এ দেশে গত ১০৪ বছরে ১৯১০, ৩১, ৫৪, ৫৬, ৬২, ৬৬, ৬৮, ৬৯, ৭০, ৭৪, ৮০, ৮৪, ৮৭, ৮৮, ৯৮, ২০০০, ২০০৪, ২০০৭ ও ২০১৪ সহ ১৯ বার বন্যা হয়েছে। যা গড়ে প্রায় ছয় বছর অন্তর অন্তর একবার বন্যা হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ১৯৫৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ৫৫ বছরে বড়, মাঝারি ও ছোট ধরনের ৫০টি বন্যা রেকর্ড করা হয়। এত বছরে সবচেয়ে বড় ব্যাপ্তির পাঁচ বন্যার মধ্যে ২০০৪ সালের বন্যা অন্যতম। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ৫৫ বছরে সবচেয়ে বড় বন্যাটি হয় ১৯৯৮ সালে। তাতে দেশের এক লাখ ২৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়। ১৯৮৮ সালের বন্যায় প্লাবিত হয় ৮৯ হাজার ৯৭০ বর্গকিলোমিটার এলাকা। ২০১৪ সালে প্রকাশিত ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের গবেষণার ফল অনুযায়ী, ১৯৯৮ সালের পর ২০০৪ সালের জুলাইয়ে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকা বড় বন্যায় প্লাবিত হয়। যা ওই বছর আগস্ট পার হয়ে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। ২০০৭ সালে আরেকটি বড় বন্যা শুরু হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। যে সব কারণে আমাদের দেশে প্রায় প্রতিবছরই কম বেশি বন্যা হয়ে থাকে তার প্রতিকারের কোন ব্যবস্থা নেই। বন্যা এলেই দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের একটু মাথাব্যথা শুরু হয় আর বন্যা চলে গেলেই মাথাব্যথা দূর হয়ে যায়। এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোন চিন্তাভাবনা নেই উর্ধতন কর্তাব্যক্তিদের। বন্যা কবলিত হয়ে সাধারণ মানুষ দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে এবং কৃষি থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। বন্যা থেকে বাঁচতে বন্যা প্রতিকারের রাস্তা খুঁজে বের করতে হবে। লেখক : সংস্কৃতিকর্মী
×