ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় গৌরবের ৬৪ বছর

প্রকাশিত: ০৭:০৪, ৯ জুলাই ২০১৭

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় গৌরবের ৬৪ বছর

১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই প্রতিষ্ঠিত হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। মাত্র ২০ জন শিক্ষক ও ১৬১ জন শিক্ষার্থী নিয়ে পথচলা শুরু উত্তরবঙ্গের শ্রেষ্ঠ এ বিদ্যাপীঠের। সময়ের পরিক্রমায় বিশ্ববিদ্যালয়টি পার করেছে গৌরবময় ৬৪টি বছর। বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে গত বৃহস্পতিবার ৬৫ বছরে যাত্রা শুরু করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদযাপনে উদগ্রীব ছিলেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এদিন সকাল থেকেই ক্যাম্পাসের জন্মদিনের আনন্দে নতুন সাজে নিজেদের রাঙিয়ে তোলেন শিক্ষার্থীরা। উৎসাহ, উদ্দীপনা ও আনন্দঘন পরিবেশে দিবসটি উদযাপনে সকলে ব্যস্ত সময় পার করেন। সকাল ১০টায় প্রশাসন ভবন চত্বরে সম্মলিত কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। জাতীয় পতাকাসহ বিশ্ববিদ্যালয় পতাকা উত্তোলনের সঙ্গে সঙ্গে ক্যাম্পাসের ১৭টি আবাসিক হলের পতাকাও উত্তোলন করা হয়। পরে বেলুন-ফেস্টুন ও শান্তির প্রতীক পায়রা উড়িয়ে দিবসটি উদযাপনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহান। এরপর সিনেট চত্বরে বৃক্ষরোপণ করেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে বের হয় বর্ণাঢ্য আনন্দ শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রাটি ক্যাম্পাসের প্রধান সড়কগুলো প্রদক্ষিণ শেষে সিনেট ভবনের সামনে শেষ হয়। সিনেট ভবনে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাইদুর রহমান খান। অধ্যাপক সাইদুর রহমান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয় নির্ভর করে শিক্ষার মানের ওপর। শিক্ষার মান উন্নয়নে কাজ করবে শিক্ষকরা আর সে কাজে সহায়তা করবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।’ সভায় অধ্যাপক রকীব আহমদ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় শুধুমাত্র একটি শিক্ষালয় নয়। এখানে শুধু ছাত্র-শিক্ষক তৈরি হয় না, আবার শুধু গবেষকও তৈরি হয় না। এটা একটা দর্শন।’ এ সময় বক্তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নয়নে শিক্ষক ও গবেষকদের অঙ্গীকার গ্রহণের আহ্বান জানান। বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদযাপনের র‌্যালিতে অংশ নেয়া প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আরিফ হোসেন বলেন, প্রথমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মদিনে আয়োজিত র‌্যালি অনেক উপভোগ করেছি! আবাসিক হলগুলোকে নতুন সাজে সাজতে দেখেছি! সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া, পতাকা উত্তোলন, ফেস্টুন ও কবুতর উড়িয়ে দিবস উদযাপনে অত্যন্ত আনন্দিত। এর মধ্য দিয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় নতুনভাবে পথচলার শক্তি অর্জন করেছে। দেশকে আরও একধাপ এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ইসমাত জাহান জিনিয়া বলেন, শুভ জন্মদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়! ৬৫ বছরে নতুন পথচলা আরও সুন্দর ও সাফল্যম-িত হোক সে প্রত্যাশা করি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় যে সব গুণীজনদের অবদান রয়েছে তাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। দেশের অন্যতম এই গৌরবময় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হতে পেরে আমি গর্বিত। উত্তরবঙ্গে শিক্ষার প্রসার ও জ্ঞানের বিস্তার ঘটাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রথম দাবি তোলেন শিক্ষানুরাগী মাদার বখশ্। পরে ১৯৫৩ সালের ৩১ মার্চ প্রাদেশিক আইনসভায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আইন পাস হয়। প্রথম উপাচার্য অধ্যাপক ইতরাত হোসেন জুবেরীকে নিয়ে মাদার বখশ্ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। এই দুজনকে যুগ্ম সম্পাদক করে মোট ৬৪ সদস্য বিশিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয়। একই বছরের ৬ জুলাই অধ্যাপক ইতরাত হোসেন জুবেরীকে উপাচার্য নিয়োগ করে বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। একাডেমিক কার্যক্রম কার্যক্রম শুরু হয় রাজশাহী কলেজে। পরে রাজশাহী শহর থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে মতিহার থানায় নির্মাণ করা হয় স্থায়ী ক্যাম্পাসের অবকাঠামো। ক্যাম্পাসটি গড়ে ওঠে অস্ট্রেলিয়ান স্থপতি ড. সোয়ানি টমাসের স্থাপত্য পরিকল্পনায়। ১৯৫৮ সালে বতর্মান ক্যাম্পাসে দালান-কোঠা ও রাস্তাঘাট নির্মাণ শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম স্থানান্তর করা হয় মতিহার থানায়। ১৯৬৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অফিস ও বিভাগ স্থানান্তরিত হয়। বর্তমানে ৫টি উচ্চতর গবেষণা ইনস্টিটিউট, ১০টি অনুষদের অধীনে ৫৭টি বিভাগ নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষা কার্যক্রম। শিক্ষক রয়েছেন ১২০০ শিক্ষক, ৩৬ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারী তিন হাজারেরও বেশি। ক্যাম্পাসে পূর্ব দিকে ছাত্রদের ১১টি ও পশ্চিম দিকে ছাত্রীদের জন্য রয়েছে ৬টি সুবিশাল আকারের আবাসিক হল। বিদেশী শিক্ষার্থী ও গবেষকদের জন্য রয়েছে একটি ইন্টারন্যাশনাল ডরমিটরি। এছাড়া রয়েছে দেশের সর্বপ্রথম মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক জাদুঘর শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে দেশের আন্দোলন-সংগ্রামে অসামান্য অবদান। ৬৯’এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ ও ৯০’এর স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর অগ্রণী ভূমিকা। ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন প্রক্টর অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহার আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধিকার আন্দোলনে যুক্ত হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী সৈন্যদের নির্যাতনে প্রাণ হারিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শহীদ হবিবুর রহমান, শহীদ মীর আবদুল কাইয়ুম ও শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্রিশ জন ছাত্র, কর্মকর্তা-কর্মচারী মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন পরিচিত হয়েছে দেশের খ্যাতনামা ব্যক্তিদের পদচারণায়। এ বিদ্যাপীঠে অধ্যাপনা করেছেন শিক্ষাবিদ ইতরাত হোসেন জুবেরী, প্রখ্যাত তাত্ত্বিক রাজনীতিবিদ বদরুদ্দীন উমর, প্রখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক ড. মুহাম্মদ শহীদল্লাহ, ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, তত্ত্ববধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা প্রয়াত বিচারপতি হাবিবুর রহমান, খ্যাতনামা ঐতিহাসিক ডেভিড কফ, প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক ও বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। সাংস্কৃতিক অঙ্গন, ক্রিড়াঙ্গনেও রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অবাধ বিচরণ। বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব একাডেমিক ভবন, আবাসিক হল ও প্রধান ফটক সাজানো হয় রঙিন সাজে। আল্পনার রঙ তুলিতে রাঙানো হয় প্রশাসন ভবন চত্বর।
×