ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আলাপকালে তেঁতুলিয়া টি কোম্পানির চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন;###;ভবিষ্যতে শ্রমিক সঙ্কট আরও তীব্র আকার ধারণ করবে ;###;উৎপাদন ৫.২৫ শতাংশ হারে বাড়ানো না গেলে চা আমদানি বাড়তে থাকবে ;###;চা পাতার মূল্য নির্ধারণ না হলে পঞ্চগড় চা শিল্পের ভবিষ্যত অন্ধকার

ক্ষুদ্রায়তন চা চাষই দেশকে চা উৎপাদনে স্বাবলম্বী করতে পারে

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ৯ জুলাই ২০১৭

ক্ষুদ্রায়তন চা চাষই দেশকে চা উৎপাদনে স্বাবলম্বী করতে পারে

কাওসার রহমান ॥ ক্ষুদ্রায়তন চা চাষই দেশকে চা উৎপাদনে স্বাবলম্বী করতে পারে। চা আমদানিকারক দেশ থেকে এ দেশকে আবার চা রফতানিকারক দেশে পরিণত করতে পারে। তাই চা আমদানি বন্ধ করতে হলে দেশে ক্ষুদ্রায়তন চা চাষের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। বড় বাগানগুলোর চা উৎপাদন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এগুলোতে আর খুব বেশি উৎপাদন বাড়ানো যাবে না। কিন্তু দেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, লালমাই পাহাড়, গারো পাহাড় ও পঞ্চগড় এলাকায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমিতে চা চাষ বাড়ানোর অনেক সুযোগ রয়েছে। এসব এলাকার জমি চা চাষের আওতায় আনা গেলে চা আবার দেশের রফতানিমুখী শিল্পে পরিণত হবে। দেশের চা শিল্প নিয়ে আলাপকালে তেঁতুলিয়া টি কোম্পানির চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন এ কথা জানান। তিনি বলেন, পঞ্চগড়ে ক্ষুদ্রায়তন চা চাষের কোন বিকল্প নেই। ওখানে বড় কোম্পানিগুলো শ্রমিক পাচ্ছে না। ফলে তারা চা পাতা কাটতে পারছে না। ভবিষ্যতে শ্রমিক সঙ্কট আরও তীব্র আকার ধারণ করবে। এ সঙ্কটের মধ্যে কেবল ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকই টিকে থাকবে। কারণ ওখানে ক্ষুদ্র চা বাগান মালিকরা তাদের নিজেদের পাতা নিজেরাই তুলতে পারবে এবং বাগানের যতœ নিতে পারবে। তবে শ্রমিকদের পাতা তোলার ব্যাপারে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। তিনি জানান, বর্তমানে চায়ের উৎপাদন বাড়ছে ১-১.৫ শতাংশ হারে। আর চা পাতার ব্যবহার বাড়ছে ৫ শতাংশ হারে। নির্বাচনের বছর চায়ের এ ব্যবহার ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। প্রতিবছর ৩০ লাখ নতুন মানুষ চায়ে আসছে। ১৯৮৩ সালে আমাদের দেশে যেখানে মাথাপিছু চা পাতার ব্যবহার ছিল ১৩৫ গ্রাম। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫০ গ্রাম। বর্তমানে দেশের ৪০ শতাংশ মানুষ চা পান করছে। ২০১০-১১ সাল থেকে দেশে চায়ের উৎপাদন ও ব্যবহার সমান সমান হয়ে যায়। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে চা পাতা আমদানি হয়েছে ১৫-১৮ মিলিয়ন কেজি। প্রতি কেজি ২ ডলার করে ধরলেও চা আমদানিতে খরচ হচ্ছেÑ ২ কোটি ডলার। আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে এ চা পাতা আমদানি করতে হচ্ছে। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কি হতে পারে? অথচ আমরা আমাদের চা উৎপাদন কাক্সিক্ষত হারে বাড়াতে পারছি না। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বড় কোম্পানিগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধির আর তেমন সুযোগ নেই। এখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমিতে চা বাগান করে চা পাতার উৎপাদন বাড়াতে হবে। ক্ষুদ্রায়তন চা চাষের সম্ভাবনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশে ক্ষুদ্রায়তন চা চাষের সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল। বর্তমানে দেশে যেভাবে চায়ের চাহিদা বেড়ে চলেছে তাতে বড় কোম্পানি দিয়ে ওই চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়। বড় কোম্পানিগুলোর কাছে বর্তমানে এক লাখ ১৪ হাজার হেক্টর জমি রয়েছে। এর মধ্যে এ পর্যন্ত ৫৯ হাজার হেক্টর জমি চা চাষের আওতায় এসেছে। বাকি প্রায় ৫৫ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে আরও ৯-১০ হাজার হেক্টর জমি চা চাষের আওতায় আনা সম্ভব। ফলে বড় কোম্পানিগুলোর চা পাতা উৎপাদন প্রায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে (পিকে) পৌঁছে গেছে। এগুলোর আর উৎপাদন খুব বেশি বাড়ানো সম্ভব নয়। এর মধ্যে আবার বেশকিছু রুগ্ন চা বাগান আছে। অনেক মালিক আছে বাগান নিয়ে বসে আছে, কিন্তু চা করছে না। টাকা দিলেও তারা চা আবাদ করবে না। ফলে বড় কোম্পানিগুলোর উৎপাদন বাড়লে বড়জোর ১০ শতাংশ বাড়তে পারে। আর আমরা যদি উৎপাদন পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখা যাবে ২০১৫ সালে দেশে চা উৎপাদিত হয়েছে ৬৭.৩৮ মিলিয়ন কেজি। অন্যদিকে, অভ্যন্তরীণ ভোগে লেগেছে ৭৭.৫৭ মিলিয়ন কেজি। এ বছর চা আমদানি হয়েছে ১০.৬৮ মিলিয়ন কেজি। অভ্যন্তরীণ ভোগের এ বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে ২০২৫ সালে অভ্যন্তরীণ ভোগের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৩০ মিলিয়ন কেজি। বিপরীতে উৎপাদন দাঁড়াবে ৮৬ মিলিয়ন কেজি। অর্থাৎ ৪৪ মিলিয়ন কেজি চা আমদানি করতে হবে। ফলে উৎপাদন ৫.২৫ শতাংশ হারে বাড়ানো না গেলে প্রতিবছর চা আমদানির পরিমাণ বাড়তে থাকবে, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলবে। তাই ভবিষ্যতে আমদানি বন্ধ করতে হলে ক্ষুদ্রায়তন চা চাষের কোন বিকল্প নেই। তিনি আরও বলেন, বড় চা বাগান করার মতো দেশে একসঙ্গে এত জমি নেই। কিন্তু চা চাষযোগ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক জমি আছে। দেশের পার্বত্য এলাকায় এ ক্ষুদ্র চা চাষ করা যেতে পারে, গারো পাহাড়ে চা চাষ করা যেতে পারে। পার্বত্য এলাকায় টিলার ঢালগুলোতে ভাল চা হবে। ওখানে ৪৬ হাজার হেক্টর নিষ্কণ্টক জমি পড়ে আছে। যেখানে ক্ষুদ্র চা চাষ হতে পারে। পঞ্চগড় এলাকায় চা চাষযোগ্য ১৬ হাজার হেক্টর জমি আছে। এর মধ্যে তিন হাজার হেক্টর জমিতে চা চাষ হয়েছে। চা উৎপাদন হচ্ছেÑ আড়াই মিলিয়ন কেজি। অথচ পঞ্চগড় অঞ্চলে থেকেই ৪০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হতে পারে। লালমাই পাহাড় এলাকায় প্রায় ৩ হাজার ৩০০ হেক্টর জমি পতিত পড়ে আছে। এর যদি ৩০ শতাংশ এলাকাও চা চাষের আওতায় আনা যায়, তাহলে বছরে ২৫ লাখ কেজি চা উৎপাদন সম্ভব। এতে অন্তত ৩ হাজার প্রান্তিক কৃষক তথা বেকার যুবকের কর্মসংস্থান হতে পারে। চা উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চা শিল্পের উন্নয়নে সরকারের কোন বিনিয়োগ নেই। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে কোন বরাদ্দও দেয়া হয় না। চা শিল্প থেকে সরকার প্রতিবছর ২০০ কোটি টাকার ওপর ভ্যাট পায়। অথচ এ শিল্পের উন্নয়নের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে প্রকল্প পাঠালে তা বাতিল করে দেয়া হয়। অথচ এ শিল্পে ৬০০-৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে পারলে বাংলাদেশ আবার চা রফতানি করতে পারবে। এ জন্য অবশ্য জনবল বাড়াতে হবে এবং লজিস্টিক সাপোর্ট দিতে হবে। চা শিল্পে ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ সরকারের জন্য কোন ব্যাপারই নয়। তবে ক্ষুদ্রায়তন চা চাষ সম্প্রসারণে এ অর্থ ব্যয় করতে হবে। তাহলেই বর্তমান আমদানির পরিবর্তে আবার এ দেশ থেকে চা রফতানি সম্ভব হবে। দেশে চা যেভাবে আমদানি হচ্ছে তাতে সরকার তথা টি বোর্ডকেই দায়িত্ব নিতে হবে ক্ষুদ্রায়তন চা চাষকে এগিয়ে নেয়ার জন্য। দেশে ক্ষুদ্রায়তন চা চাষের প্রবর্তক মোশাররফ হোসেন জানান, পঞ্চগড়ে এখন চা পাতার ব্যবসাকে কেন্দ্র করে মধ্যস্বত্বভোগী সৃষ্টি হয়েছে। এ মধ্যস্বত্বভোগীরা কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে ডালসহ পাতা কিনে নিয়ে কারখানায় বেশি দামে বিক্রির জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। ফলে প্রতিনিয়ত কারখানায় অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটছে। অথচ কারখানা ও কৃষক একই উড়োজাহাজের যাত্রী। কারখানা মরলে কৃষকও মরবে। তিনি বলেন, পঞ্চগড়ে ক্ষদ্রায়তন চায়ের প্রসার ঘটলেও উৎপাদিত চায়ের মান হ্রাস পাচ্ছে। কৃষক এক হাত লম্বা ডালসহ চা পাতা নিয়ে আসছে কারখানায়। ওই ডালসহ পাতা দিয়ে চা উৎপাদনের কারণে মানসম্পন্ন চা উৎপাদিত হচ্ছে না। তিনি বলেন, ভাল মানের চা উৎপাদনের জন্য দুটি পাতা একটি কুড়ি প্রয়োজন। ক্ষেত্র বিশেষে সাড়ে তিন পাতা পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য। কিন্তু এক হাত লম্বা ডালসহ পাতা দিয়ে ভাল মানের চা উৎপাদন সম্ভব নয়। অথচ কৃষকরা কারখানায় এসে ডালসহ সেই পাতা নেয়ার জন্যই চাপ সৃষ্টি করছে। তিনি জানান, বর্তমানে কৃষক ও কারখানার মধ্যে মূল্য নির্ধারণ নিয়ে দর কষাকষি চলছে। সরকার যদি পাতার দাম নির্ধারণ করে দেয়, তাহলে অকশন মার্কেটেও চায়ের দাম নির্ধারণ করে দিতে হবে। কারণ কৃষক এবং কারখানা মালিক দুজনেই সরকারের। সরকারকে দুজনেরই স্বার্থ দেখতে হবে। কৃষককে ৫-৬ শতাংশ কনসেশন দেয়া যেতে পারে। কিন্তু কৃষককে চায়ের ‘কস্ট অব প্রডাকশন’ অনুযায়ী মূল্য শেয়ার করতে হবে। মোশাররফ হোসেন বলেন, চা পাতার দাম নির্ধারণ করতে হবে উৎপাদিত চায়ের অকশন মূল্যের ওপর। অকশন মূল্যের ৫০ শতাংশ পাবে কৃষক এবং ৫০ শতাংশ পাবে কারখানা। এমন নিয়ম না করলে কারখানা বাঁচবে না। বর্তমানে পঞ্চগড়ে ৫টি কারখানা আছে। আরও ৭টি কারখানা হচ্ছে। যা চলতি বছরই উৎপাদনে যাবে। এ অবস্থায় চা পাতার মূল্য নির্ধারণ সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান না হলে পঞ্চগড় চা শিল্পের ভবিষ্যত অন্ধকার বলে মনে করেন তিনি। চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখন অনেকেই পঞ্চগড়ে যাচ্ছে চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানা করার জন্য। টি বোর্ডের উচিত দেখেশুনে চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানার অনুমোদন দেয়া। এক সময় যারা ক্ষুদ্রায়তন চা চাষের বিরোধিতা করছে এখন তারাই পঞ্চগড়ে যাচ্ছে চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানা করার জন্য। তাই নতুন চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানার অনুমোদন দিতে হলে দুটি শর্ত মেনে কারখানা করার অনুমোদন দিতে হবে। ১. যারা কারখানা করবেন তাদের অন্তত ১০০ হেক্টর জমিতে চা চাষের জন্য কৃষকদের চারা দিতে হবে। এ এক শ’ হেক্টরে ১৮ থেকে ২০ লাখ চা চারার প্রয়োজন হবে। দ্বিতীয়ত একটি কারখানার তিন কিলোমিটার বাইরে অপর কারখানা স্থাপনের অনুুমতি দিতে হবে। পঞ্চগড়ে মানসম্পন্ন চা পাতা উৎপাদনে করণীয় প্রসঙ্গে মোশাররফ হোসেন বলেন, পঞ্চগড় অঞ্চলে মানসম্পন্ন চা পাতা উৎপাদন করতে হলে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত ‘বেলুমিটার’ অনুসরণে চা পাতা তুলতে হবে। অন্যথায় মানসম্পন্ন চা উৎপাদন সম্ভব হবে না। এ জন্য কৃষক ও কারখানা মালিকদের বেলুমিটার অনুসরণ করতে হবে। আর বেলুমিটার অনুসরণে চা পাতা তুলতে হলে প্রতি ৮-১০ দিন অন্তর অন্তর চা পাতা তুলতে হবে। এতে চা পাতার উৎপাদন ৪ গুণ বাড়বে। বর্তমানে পঞ্চগড় এলাকার চা বিক্রি করে ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকা পাওয়া যাচ্ছে চট্টগ্রামের অকশন মার্কেট থেকে। বেলুমিটার অনুসরণে চা পাতা তোলা হলে এ আয় ৪ গুণ বেড়ে যাবে। বর্তমানে কৃষক মাসে একবার এমনকি ৪৫ দিনে একবার পাতা কাটে। এটা ৮-১০ দিন অন্তর অন্তর কাটতে হবে। জেলা প্রশাসনকে উদ্যোগ নিয়ে এ বেলুমিটার অনুসরণে কৃষকদের বাধ্য করতে হবে। যদি বেলুমিটারের নির্দেশত মানদ-ের ৮০ শতাংশও অর্জন করা যায়, তাহলে পঞ্চগড় থেকে চা বিক্রি বাবাদ আয় ৩০০ কোটিতে গিয়ে দাঁড়াবে। আর এটা করলেই কৃষক বাঁচবে। বেলুমিটারের মানদ-ে বলা হয়েছে, সবুজ চা পাতা তোলা ক্ষেতে একটি পাতা একটি কুড়ি হতে হবে ৫ শতাংশ, দুটি পাতা একটি কুড়ি হতে হবে ৫৫ শতাংশ, এবং নরম ডাটা ১০ শতাংশ মোট ৭০ শতাংশ। অন্যদিকে, তিনটা পাতা একটি কুড়ি ১৫ শতাংশ, শক্ত ডাটা ৫ শতাংশ এবং শক্ত পাতা ১০ শতাংশ মোট ৩০ শতাংশ। বাগান থেকে উত্তোলিত চা পাতার মধ্যে ৭০ শতাংশ ও ৩০ শতাংশের মিশ্রণ থাকতে হবে। তবেই ওই উৎপাদিত চা পাতা দিয়ে মানসম্পন্ন চা উৎপাদিত হবে।
×