ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নিম্নমানের ওষুধ সম্পর্কে ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ

মানবহির্ভূত ওষুধ এড়িয়ে চলার পরামর্শ

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ৯ জুলাই ২০১৭

মানবহির্ভূত ওষুধ এড়িয়ে চলার পরামর্শ

নিখিল মানখিন ॥ নিষিদ্ধ ওষুধগুলো নিয়ে সাধারণ মানুষ নানা অসুবিধায় পড়ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে এ পর্যন্ত মোট ৮৬ ওষুধ কোম্পানির লাইসেন্স সাময়িক বাতিল করা হয়েছে। নিষিদ্ধ ওষুধগুলোর তালিকা কেথাও টাঙিয়ে দেয়া হয়নি। ফলে লাইসেন্স বাতিলকৃত কোম্পানি ও ওষুধসমূহের বিষয়ে সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, অনেক চিকিৎসক ও খুচরা ওষুধ বিক্রেতা কোন ধারণা রাখেন না। বাতিলকৃত কোম্পানিগুলোর ওষুধ বাজারে রয়েছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের। আর জনবল সঙ্কটের কারণে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পক্ষেও সারাদেশের হাজার হাজার ফার্মেসি ঘুরে দেখাও সম্ভব হয়ে ওঠে না। এ সুযোগে নানা কৌশলে লাইসেন্স বাতিলকৃত অনেক কোম্পানি ওষুধ উৎপাদন ও বিতরণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আর তালিকা না থাকায় রোগীদের ব্যবস্থাপত্রে নিষিদ্ধ ওষুধ লিখে যাচ্ছেন অনেক চিকিৎসক। এভাবে লাইসেন্স বাতিলকৃত অনেক কোম্পানির ওষুধ বাজারে রয়ে গেছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি সংসদে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম জানিয়েছেন, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদনের দায়ে দেশের ৮৬ ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স সাময়িক বাতিল করা হয়েছে। এর মধ্যে এ্যালোপ্যাথিক ৩২, ইউনানি ১৬, আয়ুর্বেদিক ২৩ এবং হোমিওপ্যাথিক ১৫ প্রতিষ্ঠান রয়েছে বলে জানান তিনি। গত বছর মানসম্পন্ন ওষুধ তৈরি করতে ব্যর্থ হওয়ায় ২০ ওষুধ কোম্পানির নিবন্ধন বাতিলসহ মোট ৫৬ ওষুধ কোম্পানির বিরুদ্ধে বিধিনিষেধ আরোপের সুপারিশ করে ওষুধ শিল্প নিয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি। সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভায় বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। এর মধ্যে ১৪ কোম্পানি এ্যান্টিবায়োটিক উৎপাদন করতে পারবে না এবং ২২ কোম্পানি শুধু নন-পেনিসিলিন এ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করতে পারবে এমন সুপারিশ করে কমিটি। এছাড়া অনুমোদনহীন বা নকল ওষুধ যেসব প্রতিষ্ঠানে (ওষুধের দোকান বা হাসপাতাল) পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ারও সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নেয় সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। যথাযথ মানসম্মত ওষুধ উৎপাদনে ব্যর্থ হওয়ায় ২০ কোম্পানির সব ধরনের ওষুধ ও ১৪ কোম্পানির এ্যান্টিবায়েটিক উৎপাদন বন্ধই বহাল রাখে আদালত। বন্ধের নির্দেশনা পাওয়া ২০ কোম্পানি হলোÑ এক্সিম ফার্মাসিউটিক্যাল, এভার্ট ফার্মা, বিকল্প ফার্মাসিউটিক্যাল, ডলফিন ফার্মাসিউটিক্যাল, ড্রাগল্যান্ড, গ্লোব ল্যাবরেটরিজ, জলপা ল্যাবরেটরিজ, কাফমা ফার্মাসিউটিক্যাল, মেডিকো ফার্মাসিউটিক্যাল, ন্যাশনাল ড্রাগ, নর্থ বেঙ্গল ফার্মাসিউটিক্যাল, রিমো কেমিক্যাল, রিদ ফার্মাসিউটিক্যাল, স্কাইল্যাব ফার্মাসিউটিক্যাল, স্পার্ক ফার্মাসিউটিক্যাল, স্টার ফার্মাসিউটিক্যাল, সুনিপুণ ফার্মাসিউটিক্যাল, টুডে ফার্মাসিউটিক্যাল, ট্রপিক্যাল ফার্মাসিউটিক্যাল এবং ইউনিভার্সেল ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড। এ্যান্টিবায়েটিক উৎপাদনকারী ১৪ কোম্পানি হলো- আদ-দ্বীন ফার্মাসিউটিক্যাল, আলকাদ ল্যাবরেটরিজ, বেলসেন ফার্মাসিউটিক্যাল, বেঙ্গল ড্রাগস, ব্রিস্টল ফার্মা, ক্রিস্ট্যাল ফার্মাসিউটিক্যাল, ইন্দো-বাংলা ফার্মাসিউটিক্যাল, মিল্লাত ফার্মাসিউটিক্যাল, এমএসটি ফার্মা, অরবিট ফার্মাসিউটিক্যাল, ফার্মিক ল্যাবরেটরিজ, পনিক্স কেমিক্যাল, রাসা ফার্মাসিউটিক্যাল এবং সেভ ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড। কিন্তু লাইসেন্স বাতিলকৃত এসব কোম্পানির ওষুধ ও নিষিদ্ধ এ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলায় বাজারে রয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এদিকে লাইসেন্স বাতিলকৃত কোম্পানির ওষুধ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি এবং ডক্টরস অব হেলথ এ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ রশিদ ই-মাহাবুব জনকণ্ঠকে জানান, দেশে ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরি বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই। বাড়াতে হবে মনিটরিং কার্যক্রম। পরীক্ষার আওতার বাইরে থাকা ওষুধগুলো অবশ্যই জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। লাইসেন্স বাতিলকৃত কোম্পানির ওষুধ অবিলম্বে বাজার থেকে তুলে নেয়া উচিত। পাশাপাশি ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের জনবল ও কার্য দক্ষতাও বাড়াতে হবে বলে তিনি মনে করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের ডীন অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ জনকণ্ঠকে জানান, যে কোন ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ গ্রহণ করাই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। মান ঠিক না থাকলে গ্রহণকারীর মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এ ধরনের ওষুধ ব্যবহারকারীরা নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এমনকি তাদের কেউ কেউ মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়তে পারেন। মানবহির্ভূত ওষুধ এড়িয়ে চলার জন্য জনসাধারণকে পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক জনকণ্ঠকে জানান, ভেজাল রোধ করতে হলে নিয়মিত মনিটরিংয়ের বিকল্প নেই। যে কোনভাবে মনিটরিং ব্যবস্থা সচল রাখতে হবে। জেলা পর্যায়ে সম্ভব না হলেও বিভাগীয় পর্যায়ে ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরি গড়ে তুলতে হবে। শুধুমাত্র গড়ে তুললেই হবে না, জনবল ও পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি দিয়ে ল্যাবরেটরিগুলো গতিশীল করে তুলতে হবে। এ বিষয়ে যথাযথ সরকারী সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা থাকতে হবে। কোম্পানিগুলোকে সঠিক মানের ওষুধ বানাতে বাধ্য করতে হবে। শুধু তাই নয়, ওষুধ প্রশাসনের লোকজন যাতে প্রভাবিত না হতে পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরিকে স্বায়ত্তশাসিত ক্ষমতা দেয়ার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ল্যাব হবে পুরোপুরিভাবে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানকে সকল ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব ও হুমকি থেকে মুক্ত রাখতে হবে। তিনি বলেন, দেশে এখনও ভাল ওষুধ কোম্পানির সংখ্যাই বেশি। তবে কিছু কিছু দেশীয় কোম্পানি মানহীন ওষুধ তৈরি করছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। এদিকে মানবহির্ভূত ওষুধ নিয়ন্ত্রণে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পরিদফতর থেকে অধিদফতরে রূপ নেয়ার এক বছর পরও গতিশীল হতে পারেনি ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। প্রতিষ্ঠানটির সাইনবোর্ড ছাড়া কোন কিছুতে পরিবর্তন আসেনি। জনবল, যন্ত্রপাতি ও অভিযান সহায়ক যানবাহনের অবস্থাও আগের মতোই রয়ে গেছে। কর্মসূচী ঘোষণা দিয়েও তারা ভেজাল ওষুধ বিরোধী অভিযান পরিচালনা করে না। অধিদফতরের এমন দুর্বলতার সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছে ভেজাল ওষুধ। দেশে প্রায় দুই শ’টি ওষুধ কোম্পানি নিম্নমানের ওষুধ বাজারজাত করছে। এর মধ্যে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সের আবেদন করেই ওষুধ প্রস্তুত করে চলেছে। এর মধ্যে রয়েছে ওষুধ আদালতের সীমাবদ্ধতা। সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত না থাকায় ওই সব অবৈধ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারছে না ওষুধ আদালতও। ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে জনস্বাস্থ্যের বিপর্যয় ঘটবে বলে মনে করছেন বিশেজ্ঞরা। আর সরকারী মনিটরিং টিম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার ক’দিন কাজ করেই দায়িত্ব পালন শেষ করেন।
×