ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

উদার ও অবাধ বাণিজ্য চাই, সংরক্ষণবাদী কর্তৃত্ব চাই না ॥ বিশ্বনেতাদের দাবি

জি-২০ শীর্ষে একঘরে ট্রাম্প

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ৯ জুলাই ২০১৭

জি-২০ শীর্ষে একঘরে ট্রাম্প

ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ক্রমাগতভাবে একঘরে হয়ে পড়ছেÑ তা গত শুক্রবার ২০ জাতি সম্মেলনে বিশ্বের অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী দেশগুলোর উপস্থিতিতে তীব্রভাবে অনুভূত হয়েছে। পরাশক্তিধর দেশটির সঙ্গে এই বিভাজন জলবায়ু পরিবর্তন থেকে শুরু করে মুক্তবাজার অর্থনীতি পর্যন্ত প্রায় সকল নীতি-নির্ধারণী ক্ষেত্রেই দৃষ্টিগোচর হয়েছে। খবর ওয়াশিংটন পোস্টের। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ বিশ্বের ২০ জাতি সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অন্যান্য দেশের এক দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এমন সময় আটলান্টিক অঞ্চলকেন্দ্রিক একটি সম্ভাব্য বাণিজ্যযুদ্ধ নিয়েও আলোচনার অবতারণা হয়। ট্রাম্পের পূর্বসূরিদের অনুসৃত নীতি থেকে আমেরিকার কঠোর বিদ্যুতি থেকে এই উদ্বেগ-উত্তেজনার সৃষ্টি। এটি বিশ্ব অঙ্গনে ওয়াশিংটনের ক্ষয়িষ্ণু প্রভাবের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বা সতর্কবার্তা। হামবুর্গে সমবেত অন্যান্য দেশের নেতৃবৃন্দ, ট্রাম্পকে তাদের জোট থেকে বের করে দেবেন, না কোন ধরনের আপোস বা সমঝোতামূলক পথ বেছে নেবেন তা নিয়ে এক এক যুক্ত বিবৃতিতে স্বাক্ষরদানের ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন। এ প্রসঙ্গে ইউরোপের দু’জন পদস্থ কর্মকর্তা জানান যে, তারা ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠনের কথা বিশেষভাবে বিবেচনা করছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জার্মান চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মেরকেলকে উভয় পক্ষের মধ্যে মতপার্থক্য দূর করার কঠিন দায়িত্ব দেয়া হয়। তবে তিনি প্রথম দিনের বৈঠকের পর আশাব্যঞ্জক খুব একটা অগ্রগতি লাভ করতে পারেননি বলে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে মেরকেল বলেন, আলোচনা বেশ জটিল পর্যায়ে ছিল, তবে এ নিয়ে আমি বেশি কথা বলতে চাই না। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে আসার পর বিশ্বের অপরাপর দেশগুলোর সঙ্গে দেশটির সুস্পষ্ট বিভক্তি রেখা আঁকা হয়ে গিয়েছিল। তার পর ট্রাম্প যখন সংরক্ষণবাদী বাণিজ্যনীতি গ্রহণ করলেন, বিশেষ করে ইস্পাত আমদানির ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপের কথা বললেন তখন এই দ্রব্যের রফতানিকারক দেশগুলোর মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ইস্পাত শিল্প সমৃদ্ধ এক ডজনেরও বেশি দেশ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট জাঁ ক্লদ জাঙ্গার বলেছেন, প্রয়োজন হলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের জন্য আমরা প্রতিরোধমূলক অস্ত্র (যথাযথ ব্যবস্থা) ব্যবহার করব। জাঙ্কার তার সতর্কবার্তায় সুস্পষ্টভাবে বলেন, ট্রাম্প যদি ইস্পাত আমদানির ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের ঘোষণা দেয়, তবে ইউরোপ এর তাৎক্ষণিক জবাব দেবে, মাসের পর মাস অপেক্ষা করবে না। বিশ্ব রাজনীতিতে দায়িত্বশীল এসব নেতার মন্তব্যে এটি সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হলো যে, ভেতরে ভেতরে ট্রাম্প নেতৃত্বাধীন আমেরিকার সঙ্গে ইউরোপীয় নেতাদের তিক্ততা ও বিভাজনের গভীরতা কতটুকু এবং আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ইউরোপে ট্রাম্প এতটাই অজনপ্রিয় যে, তাকে নিয়ে তাচ্ছিল্য সহকারে কথা বলতে কেউ ভয় পায় না, বরং গর্ববোধ করে। ওয়াশিংটনের এক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে জানা গেছে যে, ২০ জাতি শীর্ষ সম্মেলনের আগেই হোয়াইট হাউস মার্কিন বাণিজ্যনীতি চূড়ান্ত করার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের কয়েকজন অভিজ্ঞ উপদেষ্টার পরামর্শে এটি পিছিয়ে দেয়া হয়। যদি শীর্ষ সম্মেলনের আগেই প্রস্তাবিত মার্কিন বাণিজ্যনীতি প্রকাশ করা হতো তবে হয়তো এই সম্মেলনে তুমুল হৈ-হট্টগোল এবং ট্রাম্পকে আনুষ্ঠানিকভাবে একঘরে অবস্থায় ঘরে ফিরতে হতো। কেননা, বাণিজ্যনীতি নিয়ে ট্রাম্পের পদক্ষেপ ও মনোভাব বিশ্বের প্রতিটি দেশকেই তার প্রতি বিমুখ করে তুলেছিল। এই ২০ জাতি সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দেশই অবাধ ও ন্যায়সঙ্গত বাণিজ্যনীতির অনুসারী যা ট্রাম্পনীতির বিরোধী। ট্রাম্প অনেক সময় বাণিজ্যকে তার পররাষ্ট্র নীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার পক্ষপাতি। ট্রাম্প প্রশাসন চীনকে তার ইস্পাত শিল্পে ভর্তুকি দিয়ে প্রচুর পরিমাণে ইস্পাত উৎপাদনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ইস্পাত ব্যবসায়ীদের বেকায়দায় ফেলার জন্য দেশটিকে অভিযুক্ত করে আসছে। কিন্তু অবাধ বিশ্ব বাণিজ্যনীতি অনুসারে চীন কোন বেআইনী কাজ করছে না। চীনকে চাপে রাখার জন্য ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রে যেসব দেশ ইস্পাত রফতানি করে যেমন, কানাডা, ব্রাজিল, মেক্সিকো, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া ও জার্মানি এদের নিয়ে একটি বাণিজ্য বলয় গড়ে তোলার পক্ষপাতি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশ ও অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তি জাপানসহ বেশ কয়েকটি দেশ এই বাণিজ্যিক বাধা বা শুল্ক আরোপের তীব্র বিরোধিতা করেছে। এ বিষয়ে জাপানের প্রাধানমন্ত্রী শিনজো আবে সম্মেলনে উপস্থিত নেতৃবৃন্দকে সুস্পষ্টই ভাষায় বলেন, ‘বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল দেশকে মুক্ত ও অবাধ বাণিজ্যের নিয়মনীতি যথাযথ মেনে চলতে হবে এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ে একে সম্মান করতে হবে। তা না হলে পুরো আন্তর্জাতিক অর্থনীতি গুটিয়ে যাবে (পঙ্গুত্ববরণ করবে)।’ বাণিজ্যনীতি নিয়ে বিশ্বনেতাদের মনোভাব বুঝতে পেরে হোয়াইট হাউসের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ গত সপ্তাহের প্রস্তাবিত বাণিজ্যনীতি পরিবর্তন করে নতুনভাবে সাজানোর চিন্তাভাবনা করছেন। কেননা তারা বুঝতে পেরেছেন যে, সবাইকে পাশে না পেলে যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্বে তাদের পক্ষে কিছু করে ওঠা সম্ভব হবে না। এর মাধ্যমে এটি বোঝা যাচ্ছে যে, সারা বিশ্বে একক মার্কিন মোড়লিপনার দিন হয়তো শেষ হচ্ছে।
×