ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

আইসিসের নতুন ফ্রন্ট দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ৯ জুলাই ২০১৭

আইসিসের নতুন ফ্রন্ট দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া

আইসিস নতুন ফ্রন্ট খুলেছে। সেই ফ্রন্ট দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। আর সেটাই হলো এই অঞ্চলের মানুষের জন্য মস্ত মাথাব্যথার বিষয়। ইতোমধ্যে ফিলিপিন্সের মিন্দানাও দ্বীপের মারাবি শহরে এক অভিযানের মধ্য দিয়ে আইসিস তাদের উপস্থিতি প্রবলভাবে জানান দিয়েছে। গত ২৩ মে থেকে এই শহরটি অবরুদ্ধ করে রাখে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন সেটাকে স্থানীয়রা বলে গ্রুপো আইসিস। এটি হলো বিভিন্ন মিলিশিয়াদের একটি এডহক কোয়ালিশন যারা আইসিস নেতা আবু বকর আল-বাগদাদীর প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেছে। মারাবি হলো আইসিসের এক নতুন ভৌগোলিক ফ্রন্ট ইরাক ও সিরিয়ায় ক্রমাগত একের পর এক ভূখ- হাতছাড়া হওয়ায় নিজেদের অস্তিত্ব ও পরিচিতি বজায় রাখার জন্য আইসিস এখন বাইরের বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাসী আক্রমণ হানছে। ইতোমধ্যে ইংল্যান্ডের ম্যাঞ্চেস্টারে হয়েছে, লন্ডন ব্রিজে হয়েছে। মিসরে কনটিক খ্রিস্টান তীর্থযাত্রীদের ওপর হয়েছে। জাকার্তায় হয়েছে। তেহরানে হয়েছে। তবে মৃত্যু ও হামলার স্থিতিকালের দিক দিয়ে এসব কিছুকে ছাড়িয়ে গেছে মারাবির ঘটনা। ঘটনাটির আরও বড় তাৎপর্য এখানে যে এর মধ্য দিয়ে আইসিস ও এর অঙ্গ সংগঠনগুলোর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে পড়ে আইসিস নেতৃত্ব তাদের মডেলকে বিশ্বের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে দিতে চাইছে। মারাবি পরিস্থিতির বিস্তার ঘটলে এলাকাটি ভাবী সন্ত্রাসীদের আকর্ষণ কেন্দ্র হয়ে ইতোমধ্যে মারাবি ঘটনায় সেসব সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে তাদের মধ্যে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ইয়েমেন, সৌদি আরব ও চেচনিয়ার জঙ্গীও রয়েছে। মারাবির লড়াইয়ের সূত্রপাত হয় যখন কর্তৃপক্ষ দক্ষিণ ফিলিপিন্সের মিলিশিয়া প্রধান ইসনিলন হ্যাপিলনকে ধরতে যায়। সেনাবাহিনী প্রত্যাশার চেয়ে প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। আরেক আইসিসপন্থী দল মাউতে গ্রুপের সঙ্গে জোট বেঁধে হ্যাপিলনের জঙ্গীরা একজন যাজক ও প্রার্থনাসভায় উপস্থিত লোকজনকে জিম্মি করে, স্থানীয় কারাগার থেকে জঙ্গীদের ছেড়ে দেয় এবং নগরী দখল করে ফেলে। এক মাস পরও লড়াই চলতে থাকে এবং তাতে জঙ্গী, সৈন্য ও নাগরিক মিলে শত শত জন নিহত হয়। আরও শত শত অধিবাসী নগরীতে আটকা পড়ে আছে। অনেক জায়গায় পানি, বিদ্যুত নেই। খাবারের মজুদ দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। ক্ষুধার জ্বালায় অনেকে কার্ডবোর্ড পানিতে ভিজিয়ে খেতে বাধ্য হয়। ইতোমধ্যে অনেক নারকীয় ঘটনা ঘটেছে। কিছু জিম্মিকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। কারও কারও শরীরে প্লেকার্ডে আরবীতে লিখে রাখা হয়েছে মোনাফেক। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নেতারা মানাবির এই ঘটনা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে চলেছেন। আইসিস ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলো তাদের জিহাদী পত্রপত্রিকা ও ভিডিওতে সিঙ্গাপুরকেও আক্রমণের টার্গেট করেছে। সেখানে দু’দুটো আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। একটি ছিল সুবিশাল ম্যারিনা বে স্যান্ডস্ ওয়াটার ফ্রন্ট রিসর্টে রকেট হামলা। পরিকল্পনাটি ইন্দোনেশিয়ার কর্তৃপক্ষ নস্যাৎ করে দেয়। যাদের হামলা চালানোর কথা ছিল তারা ইন্দোনেশিয়াতেই ছিল। গত জুন মাসে মালয়েশিয়াতেও প্রথম আইসিস হামলা হয়। রাজধানী কুয়ালালামপুরে সেই গ্রেনেড হামলায় ৮ জন আহত হয়েছিল। এর আগে ২০১৬ সালে সেখানে আরও ৭টি হামলার পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেয়া হয়েছিল। বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া এই ভেবে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন যে আইসিস ফিলিপিন্সের দক্ষিণাঞ্চলকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ঘাঁটি গড়ার প্রবেশপথ হিসেবে ব্যবহার করছে। এই দুটি দেশের মধ্যবর্তী জলপথ দিয়ে চরমপন্থীরা সহজেই দেশ দুটির মধ্যে আসা-যাওয়া করতে পারে। এদিকে মারাবির জঙ্গী দমনে ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট মিন্দানাও’এ ৬০ দিনের মার্শাল ল’ জারি করেছেন। যা শেষ হচ্ছে ২০ জুলাই। কিন্তু এর মধ্যে মারাবির পরিস্থিতির খুব যে একটা অগ্রগতি হয়েছে তা মনে হচ্ছে না। সামরিক বাহিনী বলেছে যে জঙ্গীরা জিম্মিদের মানববর্ম হিসাবে ব্যবহার করায় এবং মসজিদগুলোতে চোরাগোপ্তা অবস্থান নেয়ায় তারা বেশি অগ্রসর হতে পারছে না। তারপরও ১৯ জুুন সরকারীভাবে দাবি করা হয় যে লড়াইয়ের ক্ষেত্র কমে প্রায় ৩ বর্গমাইলে এসে দাঁড়িয়েছে এবং সেই ক্ষেত্রটা হলো মারাবির ৯৬টি মহুকুমার মধ্যে মাত্র ৪টি সরকারী। এই ভাষ্যের বাইরে পরিস্থিতিটি মোটেই স্পষ্ট নয়। শোনা যাচ্ছে যে, মারাবি অবরোধকারী জঙ্গীর সংখ্যা কয়েক ডজন থেকে এক হাজার। মৃতের সংখ্যাটাও পরিষ্কার নয়। ১৯ জুন সামরিক বাহিনীর দেয়া হিসেবে নিহতের সংখ্যা ৩৪৫। এর মধ্যে ২৫৭ জন চরমপন্থী, ৬২ জন সৈন্য, ২৬ জন সিভিলিয়ান। কিন্তু নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সামরিক কর্মকর্তারা মনে করেন এ পর্যন্ত এক হাজারের বেশি নিহত হয়েছে। মারাবির এক গোত্র প্রধান আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, রাস্তায় রাস্তায় দেখা এত পচাগলা লাশ পড়ে আছে যে, অচিরেই মহামারী দেখা দেবে। এই লড়াই জীবন যাত্রার ওপরও নারকীয় প্রভাব ফেলেছে। লড়াই বেধে যাওয়ার পর থেকে মারাবি ও আশপাশের এলাকার প্রায় সোয়া দুই লাখ লোক অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। থেকে যাওয়া মানুষজন দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন। একটি আশ্রয় কেন্দ্র প্রায় দু’শ’ পরিবার গাদাগাদি করে আছে। আইসিস ও তার মিত্র বাহিনীর টার্গেট খ্রীস্টানরা হলেও অন্যান্য জায়গার মতো এখানেও হতাহতের সিংহভাগ হলো মুসলমান, যারা সহিংসতাকে প্রত্যাখ্যান করে। মারাবি দখলের লড়াইয়ের শিকড় জটিল এবং তা মিন্দানাও-এর রক্তাক্ত ইতিহাসের মধ্যে নিহিত। দ্বীপটির বেশির ভাগ এলাকায় মরোদের বাস। মরো হলো বিভিন্ন মুসলিম দেশজ গ্রুপের সমষ্টিগত নাম। গত কয়েক দশকে মরোরা নানাভাবে নিগৃহীত ও বঞ্চিত হয়েছে। আমেরিকানরা তাদের ঘাঁটি থাকার কারণে বিপুল সংখ্যক ক্যাথলিক ফিলিপিন্সকে এখানে বসতি করতে উৎসাহিত করেছিল। যা মরোদের মধ্যে অসন্তোষের জন্ম দেয়। পরবর্তীকালে একনায়ক মার্কোসের আমলে হাজার হাজার মরোকে হত্যা করা হয়েছিল। মরো ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (এম এন এল এফ) ও এর দলছুট অংশ মরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্ট (এম আই এল এফ) দশকের পর দশক ধরে মিন্দানাও’এর হয় বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন নয়ত পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য লড়াই চালিয়েছে। সে লড়াইয়ে এ পর্যন্ত প্রায় দেড় লাখ লোক নিহত হয়েছে। দুটো সংগঠনই শেষে লড়াই থামিয়ে শান্তি আলোচনায় অংশ নেয়। তবে সে আলোচনা অচলাবস্থায় আটকে আছে। এত প্রাণহানি, এত রক্তপাতের পরও কিছু হলো না। দারিদ্র্য ও বঞ্চনা এখনও এই দ্বীপে অতি প্রকট। সেটাই সহিংস জিহাদের আশঙ্কার জন্ম দিচ্ছে। মিন্দানাওয়ে বিদ্রোহের চালিকাশক্তি হিসেবে এটাই কাজ করছে। শান্তি আলোচনায় অগ্রগতি না হওয়া অধিকতর উগ্র জঙ্গীদের উত্থানে সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে। এই জঙ্গীদের মধ্য আছে হ্যাপিলন ও তার মিত্ররা অর্থাৎ মাউতে ভ্রাতৃদ্বয় ওমর খাইয়ুম ও আবদুল্লাহ। মারাবির ঘটনার পিছনে এরাই মস্তিষ্ক হিসেবে কাজ করছে বলে মনে করা হয়। স্বদেশজাত বন্ধু র‌্যাডিকেল ইসলামপন্থীদের নিয়ে হ্যাপিলন ও মাউতে ভ্রাতৃদ্বয় আইসিসের সঙ্গে সম্পৃক্ততা গড়ে তুলছে যাতে করে তারা অর্থ ও জনবলের মতো আইসিসের সম্পদ পেতে পারে। আইসিস হ্যাপিলনকে আমির বা কমান্ডার বলে ঘোষণা করেছে। মারাবির সাবেক মেয়র ওমর আলী যিনি সলিটারিও নামেই অধিক পরিচিত, কদিন আগে মাউতে ভ্রাতৃদ্বয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং সামরিক অস্ত্রবিরতির প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন যে, প্রেসিডেন্ট দুতার্তে ফেডারেল সরকারের পরিকল্পনা নিয়েছেন। সেটা শুরু না হওয়া পর্যন্ত তারা যেন লড়াই ক্ষান্ত রাখে। প্রেসিডেন্ট তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করলে তারা আবার অস্ত্র ধারণ করতে পারে। কিন্তু মাউতে ভ্রাতৃদ্বয় আপোসরফায় কিম্বা মরো জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনে আগ্রহী নয়। সলিটারিওকে তারা জানিয়েছে ‘আমাদের শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে। মুসলমানদের আমরা নিরপেক্ষ দেখতে চাই না। হয় তারা আমাদের পক্ষে যোগ দেবে নয়ত আমাদের বিরুদ্ধে যাবে।’ মাউতে ভ্রাতৃদ্বয় জর্দানে ও মিসরে লেখাপড়া করার সময় এই মতাদর্শে দীক্ষিত হয়েছে কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত নন সলিটারিও। তবে তার ভাষায় তারা বিদেশ থেকে দেশে আসার সময় এই ভাইরাস নিয়ে আসে। মারাবির মুসলমান, খ্রীস্টান নির্বিশেষে সব নাগরিক এই ভাইরাস দূর করতে চায়। কিন্তু কোন্ কৌশলে সেটা এখনো তাদের কাছে স্পষ্ট নয়। সূত্র : টাইম
×