ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর শীঘ্রই এটি সংসদে পাস হবে

খসড়া কাঠামো চূড়ান্ত ॥ চালু হচ্ছে সরকারী বেসরকারী সর্বজনীন পেনশন

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৮ জুলাই ২০১৭

খসড়া কাঠামো চূড়ান্ত ॥ চালু হচ্ছে সরকারী বেসরকারী সর্বজনীন পেনশন

এম শাহজাহান ॥ সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় এবার অংশগ্রহণমূলক সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এই ব্যবস্থায় দেশের সরকারী পেনশনারদের পাশাপাশি বেসরকারীখাতে নিয়োজিত চাকুরেরাও অবসরকালীন পেনশন সুবিধা পাবেন। সরকার ও দাতা সংস্থাগুলোর অর্থায়নে চলতি বাজেটেই সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হতে পারে। ইতোমধ্যে প্রস্তাবিত সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার খসড়া কাঠামো চূড়ান্ত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর শীঘ্রই এটি জাতীয় সংসদে পাস করানো হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। জানা গেছে, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ সরকারী চাকরে পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্রাচ্যুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধাও নেই। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমার পাশাপাশি গড় আয়ু বাড়ার কারণে জনমিতিক কাঠামো বদলে যাচ্ছে। এতে প্রবীণদের সংখ্যা এবং মোট জনগোষ্ঠীতে তাদের অনুপাত ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে নগরায়নের কারণে একক পরিবারের সংখ্যাও বাড়ছে। এর ফলে ভবিষ্যতে প্রবীণদের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তাহীন হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বাস্তবতায় সকল শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীসহ প্রবীণদের জন্য একটি সার্বজনীন ও টেকসই পেনশন পদ্ধতি প্রবর্তন এখন সময়ের দাবি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত তিন বছর ধরে সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার কথা বলে আসছেন। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায়ও এ বিষয়ে তার ঘোষণা রয়েছে। সেখানে অর্থমন্ত্রী বলেন, সরকারী পেনশনারগণ দেশের সমগ্র জনগণের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। তাই সরকারী কর্মচারীদের পাশাপাশি সকলের জন্য সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় অংশগ্রহণমূলক সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুকরণের জন্য কাজ শুরু করা হয়েছে। সরকারের সামগ্রিক কর্মকা-ের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ-রাষ্ট্রে রূপান্তর করা। তিনি বলেন, সরকারী চাকুরেদের জন্য বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থা সংস্কার করে আধুনিক, যুগোপযোগী ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হচ্ছে। পেনশন বাবদ বরাদ্দ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে রাখার পরিবর্তে অর্থবিভাগের অনুকূলে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। একই সঙ্গে পৃথক একটি পেনশন অফিস প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। জানা গেছে, সার্বজনীন পেনশন তহবিল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। সরকারের পাশাপাশি দাতাদের সহযোগিতায় যৌথভাবে এ তহবিল গঠন করা হবে। এ তহবিলের টাকা যোগান দিতে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, যুক্তরাজ্যভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা ডিএফআইডিসহ বিভিন্ন দাতার সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বিশ্ব ব্যাংক সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় থাকার কথা জানিয়ে দিয়েছে। চলতি অর্থবছরের মধ্যে সরকারের এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থমন্ত্রণালয়ের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। বেশকিছু বিষয়ে অগ্রগতি আছে মন্ত্রণালয়ের। তিনি বলেন, সরকারী চাকুরেদের মতো বেসরকারীখাতের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পেনশন সুবিধার আওতায় আসবেন। কিন্তু এই পদ্ধতি এগিয়ে নিতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বড় অঙ্কের অর্থ। সেই অর্থের যোগান আসবে সরকার ও দাতা সংস্থার কাছ থেকে। ইতোমধ্যে বিশ্ব ব্যাংক সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় থাকার ইচ্ছা পোষণ করেছে। এদিকে, সরকারী পেনশনের চাপ কমাতেও পেনশন তহবিলকে বিনিয়োগযোগ্য তহবিলে পরিণত করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এ তহবিলের অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে লভ্যাংশ পাওয়া যাবে কিভাবে সেটা নিয়ে কাজ শুরু করা হয়েছে। এখান থেকে যে মুনাফা পাওয়া যাবে, তার সুবিধা পাবেন পেনশনভোগীরা। এ তহবিলের টাকা কোথায় বিনিয়োগ করা যাবে, বিনিয়োগ টেকসই হবে কি-না, এসব বিষয় নিয়ে এখন কাজ করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সূত্রমতে বর্তমানে সাড়ে ১১ লাখ অবসরপ্রাপ্ত সরকারী চাকরিজীবী পেনশন সুবিধা ভোগ করছেন। এদের পেছনে বছরে খরচ হয় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। এতে সরকারের আর্থিক চাপ তৈরি হয়। এ চাপ প্রশমনে পেনশন তহবিল গঠন করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, সরকারী চাকরিজীবীদের পেনশন ব্যবস্থাপনার জন্য একটি পেনশন তহবিল ও ‘পেনশন ফান্ড ম্যানেজমেন্ট কর্তৃপক্ষ’ প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এ কর্তৃপক্ষকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ফান্ড প্রদান করা হবে। এ ফান্ড হতে পেনশন প্রদানের পাশাপাশি বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে পেনশনভোগীদের জন্য কল্যাণমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। সরকারী পেনশন ব্যবস্থায় সংস্কার গত ১ জুলাই থেকে অবসরগ্রহণকারী সরকারী পেনশনার আবশ্যিকভাবে তার প্রাপ্য পেনশনের অর্ধেকের ওপর নির্দিষ্ট হারে আনুতোষিক পাবেন এবং বাকি অর্ধেক আজীবন মাসিক পেনশন হিসেবে পাবেন। পেনশনারগণের পেনশন নির্ধারণের পর নতুন পে-স্কেল চালুর আগে পেনশনের হার বৃদ্ধি করা হতো না। ফলে পেনশনারগণ অতি নগণ্যহারে পেনশন পেতেন। কিন্তু এখন প্রথমবারের মতো মাসিক পেনশনের ওপর বার্ষিক ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট প্রথা প্রবর্তন করা হয়েছে। এটি একদিকে পেনশনারদের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য রহিত করবে, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি হতে সুরক্ষা প্রদান করে তাদের জীবনযাত্রার মান সমুন্নত রাখতে সহায়ক হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এছাড়া অষ্টম জাতীয় পে-স্কেল ঘোষণার পর অনলাইনে বেতন ও পেনশন নির্ধারণের পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। এর মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে পেনশনার ও সরকারী কর্মচারীদের তথ্যভা-ার। গত মে মাস পর্যন্ত ১১ লাখ ২৩ হাজার ২৪১ সরকারী কর্মচারী এবং এবং ৬ লাখ ২৭ হাজার ৩৪৮ পেনশনারের তথ্য এ ভা-ারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ তথ্যভা-ার ব্যবহার করে সরকারী কর্মচারীদের গ্রেড ও অফিসভিত্তিক সংখ্যা, বেতন ও পেনশনের হিসাব অতি সহজে নির্ণয় করা সম্ভব হবে। এছাড়া সরকারী কর্মচারীদের বেতন, বিল এবং সরবরাহকারীর বিল অনলাইনে দাখিল পদ্ধতি শীঘ্র চালু করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। জানা গেছে, সার্বজনীন পেনশন পদ্ধতিতে তহবিলের উৎস, পরিচালনা ও কর্মপদ্ধতি প্রভৃতি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। ভারত, শ্রীলঙ্কা ও অস্ট্রেলিয়ায় এ ধরনের ব্যবস্থা চালু রয়েছে। ভারতের সার্বজনীন পেনশন পদ্ধতির আদলে বাংলাদেশে এটি প্রবর্তন করা হচ্ছে। বর্তমানে কলকাতা ও অসম ছাড়া বাকি সব রাজ্যে এ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। বেসরকারী খাতের ৯৫ শতাংশের মধ্যে মাত্র ৮ শতাংশ আনুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত রয়েছেন। তাদের কোন পেনশন সুবিধা নেই। এ কারণে দেশে গড় আয়ু ও প্রবীণদের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে সামাজিকভাবে নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিও বেড়েছে। এ সঙ্কট দূরীকরণের জন্যই সরকারী উদ্যোগে সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে।
×