ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি বলছে ভুল তথ্য প্রচার করছে সরকার

ইউনেস্কো অবস্থান বদল করায় রামপাল ইস্যুতে পরিবেশবাদীরা বিপাকে

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৮ জুলাই ২০১৭

ইউনেস্কো অবস্থান বদল করায় রামপাল ইস্যুতে পরিবেশবাদীরা বিপাকে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রামপাল প্রকল্প বিষয়ে ইউনেস্কো তাদের অবস্থান বদলালেও অনড় অবস্থানে রয়েছে দেশের আন্দোলনকারীরা। সরকারের তরফ থেকে ভুল তথ্য প্রচারের অভিযোগ করছে সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি। পরিবেশবাদীদের বড় ভরসা ছিল ইউনেস্কোর অবস্থান। কিন্তু রামপাল বিষয়ে সরকারের প্রস্তাব গ্রহণ করে অবস্থান বদল করায় বিপাকে পড়েছেন পরিবেশবাদীরা। এ বিষয়ে বিদ্যুত জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ শুক্রবার জানান, রামপাল প্রকল্প নিয়ে ইউনেস্কো যেসব প্রশ্ন করেছিল আমরা তার উত্তর দিয়েছি। তারা সন্তুষ্ট হয়ে অবস্থান পরিবর্তন করেছে। এক্ষেত্রে ইউনেস্কো আমাদের আরও যেসব পরামর্শ দিয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। সরকারের তরফ থেকে বরাবরই বলা হচ্ছিল রামপাল ইস্যুর সমাধান করা হবে বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে। এর বিপরীতে রামপাল ইস্যুতে নিজেদের মনগড়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আন্দোলন করছে দেশের পরিবেশবাদীরা। সরকার কয়েকবার পরিবেশবাদীদের বোঝানোর চেষ্টা করলেও পরিবেশবাদীরা বলেছেন তারা কিছু বুঝতে চান না। তারা রামপালে বিদ্যুত কেন্দ্র হচ্ছে না এটাই দেখতে চান। এক্ষেত্রে তারা ইউনেস্কোর প্রতিবেদনকে আন্দোলনের বড় ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করে আসছিল। আন্দোলনকারীদের পক্ষে সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি সদস্য সচিব ডাঃ আব্দুল মতিনের সই করা একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ইউনেস্কোর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন বিষয়ক চূড়ান্ত প্রস্তাব এখনও ঘোষিত হয়নি। আমরা যতটুকু জেনেছি তা হচ্ছে এই প্রকল্পে যে ব্যাপক বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, কয়লা পরিবহন ও ড্রেজিংজনিত ঝুঁকি রয়েছে, তা ইউনেস্কো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অভিযোগ করা হয়, ইউনেস্কোর মূল কমিটিতে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পেয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বৃহস্পতিবার খবর বিজ্ঞপ্তিতে ইউনেস্কোর অবস্থান পরিবর্তনের কথা জানানো হয়। পোলান্ড থেকে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন এই প্রতিবেদককে জানান, সরকারের প্রস্তাব ইউনেস্কো গ্রহণ করে আগের অবস্থান পরিবর্তন করেছে। এখন রামপাল ইস্যুতে ইউনেস্কোর কোন সমস্যা নেই। এক্ষেত্রে যেসব শর্ত দেয়ার কথা ইউনেস্কোর তরফ থেকে বলা হচ্ছে আগে থেকে সরকারের পরিকল্পনাতেও তা ছিল। ইউনেস্কো কঠোর মনিটরিং এবং স্থানীয়দের চাকরি দেয়ার কথা বলছে। এর মধ্যেই রামপাল বিদ্যুত প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ কোম্পানি স্থানীয়দের স্বনির্ভর করতে সেলাই এবং কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেছে। এছাড়া স্থানীয়দের উন্নয়নে প্রতি ইউনিট বিদ্যুত বিক্রি থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নিয়ে তহবিল গঠন করা হবে। ওই তহবিলের অর্থ স্থানীয়দের কল্যাণে ব্যয় করা হবে। দেশের কয়লাচালিত সকল বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য আইনটি সরকারের তরফ থেকে করা হয়েছে। দেশের পরিবেশবাদীরা দাবি করছে সুন্দরবনের মধ্যে বিদ্যুত কেন্দ্রটি স্থাপন করা হচ্ছে। তারা বলার চেষ্টা করছে সুন্দরবন থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরে বিদ্যুত কেন্দ্রটি স্থাপন করা হচ্ছে। যা দেশের পরিবেশ আইন অনুযায়ী করা ঠিক নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বিদ্যুত কেন্দ্রটি সুন্দরবনের ১৪ কিলেমিটার দূরে স্থাপন করা হচ্ছে। বাফার জোনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন না করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিদ্যুত কেন্দ্রটি বাফার জোন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে। ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য থেকে ৬৯ দশমিক ৬ কিলোমিটার দূরে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রটির সব থেকে আশঙ্কার বিষয় বিদ্যুত উৎপাদনের পর উড়ন্ত ছাই। পরিবেশবাদীরা বলছেন বছরে একটি এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য ৪৭ লাখ টন কয়লা পোড়ানো হয়। এতে ৭ লাখ ৫০ হাজার টন ফ্লাই এ্যাশ এবং দুই লাখ টন বটম এ্যাশ তৈরি করবে। এই ছাইয়ে থাকা বিভিন্ন ভারি ধাতব এর মধ্যে আর্সেনিক, পারদ, সীসা, নিকেল, ভ্যানাডিয়াম, বেরিলিয়াম, ব্যারিয়াম, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, সেলেনিয়াম, রেডিয়াম পরিবেশে মিশে ক্ষতি করবে। বিদ্যুত কেন্দ্রটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ কোম্পানি বলছে বিদ্যুত কেন্দ্রটির ৯৯ দশমিক ৯ ভাগ ছাই এ্যাশ হপারে ধরা হবে। এই ছাই স্থানীয় সিমেন্ট কারখানা এবং সিরামিক কারখানায় কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হবে। স্থানীয়ভাবে বাজার জরিপ করে দেখা গেছে ছাইয়ের বড় বাজারও রয়েছে। ছাই ধরার পর তা সংরক্ষণের জন্য ২৫ একর জমির ওপর একটি সংরক্ষণাগার নির্মাণ করা হবে। অর্থাৎ ছাইকে বাতাস বা পানির সঙ্গে মিশতে দেয়া হবে না। নির্গত গ্যাস ধরতে ফ্লু গ্যাস ডিসালফারাইজার ইউনিট (এফজিডি) ব্যবহার করা হবে। এর মাধ্যমে কেন্দ্রটির ৯৬ ভাগ ফ্লু গ্যাস ধরা হবে। কেন্দ্রটির পরিবেশগত সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে কেন্দ্রটি বাতাসে নক্স ছড়াবে ৫১ দশমিক ২ মাইক্রোগ্রাম/প্রতি ঘন মিটার সাধারণ বাতাসে সক্স ছড়াবে ৫৩ দশমিক ৪ মাইক্রোগ্রাম/প্রতি ঘন মিটার সাধারণ বাতাসে। (এক মাইক্রোগ্রাম অর্থ এক গ্রামের ১০ লাখ ভাগের এক ভাগ) কিন্তু পরিবেশ অধিদফতরের অনুমোদিত মাত্রা হচ্ছে ৮০ মাইক্রোগ্রাম/ ঘনমিটার। বাতাসে যে পরিমাণ সক্স এবং নক্স ছাড়বে তা পরিবেশ অধিদফতরের অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে ৩০ মাইক্রোগ্রাম কম। পরিবেশগত সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী পশুর নদী থেকে পানি প্রত্যাহারের হার হবে শূন্য দশমিক শূন্য পাঁচ (০.০৫%)। বিদ্যুত কেন্দ্রটিতে কুলিং টাওয়ার থাকবে। পানি ঠা-া করার পর তা আবার নদীতে ছাড়া হবে। এতে নদীর কোন ক্ষতি হবে না, কোন প্রভাব পড়বে না। পরিবেশবাদীরা দাবি করছেন বিদ্যুত কেন্দ্রর কয়লা পরিবহন এবং যন্ত্রপাতি পরিবহনে শব্দ দূষণ হবে। এতে বনের স্বাভাবিক প্রজনন বিঘিœত হবে। জীবজন্তুর বাসযোগ্যতা নষ্ট হবে। বিদ্যুত কেন্দ্রটি সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে। কয়লা পরিবহন করা হবে যে জায়গা দিয়ে সেখানে প্রতিদিন মংলা বন্দরে অসংখ্য জাহাজ আসে। এ ধরনের আধুনিক বিদ্যুত কেন্দ্রের ২০০ মিটার দূর থেকেই শব্দ শোনা যায় না। সেখানে ১৪ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত শব্দ যাওয়ার কোন আশঙ্কা নেই। আকরাম পয়েন্টে মাদার ভেসেল থেকে ঢাকনাযুক্ত লাইটারেজে করে রামপালে কয়লা আনা হবে। মংলা পোর্ট বহু বছর ধরে যে পথ ব্যবহার করে সেই পথেই কয়লা আসবে। কয়লা খালাসের জন্য ভাসমান টার্মিনাল ব্যবহার (এফটিএস) করা হবে। এই টার্মিনালের নক্সা করা হয়েছে আন্তর্জাতিক মানদ- মেনে। বিদ্যুত কেন্দ্রের ভেতরে কয়লা নেয়ার জন্য ঢাকনাযুক্ত চলন্ত বেল্ট ব্যবহার করা হবে। কয়লায় যাতে তাপের কারণে আগুন ধরে না যায় এজন্য পানিও ছিটানো হবে। যাতে কয়লা থেকে কোন ধুলাও বাতাসে ছড়াতে পারবে না।
×