ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রাজধানীতে চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গুর প্রকোপ রয়েই গেছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ৮ জুলাই ২০১৭

রাজধানীতে চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গুর প্রকোপ রয়েই গেছে

নিখিল মানখিন ॥ অসচেতনতা ও বৃষ্টির কারণে চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার প্রজনন কমছে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। রাজধানীতে এই দুটি রোগের প্রাদুর্ভাব রয়ে গেছে। তবে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তের হার হ্রাস পেতে শুরু করেছে বলে দাবি করেছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্ষা ও বর্ষার আগে বৃষ্টির কারণে প্রজনন বাড়ে এডিস মশার। তবে বাসাবাড়ির ছাদ বা বারান্দার টবে বা বিভিন্ন পাত্রে জমে থাকা পরিষ্কার পানিই এ মশার প্রজননের নিরাপদ স্থল। কার্যকর মশক নিধন কার্যক্রম দেখা যায় না। আর এডিস মশার প্রজনন কমাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পরামর্শ অনুযায়ী নিজেদের বাসাবাড়িতে কাজ করেন না অধিকাংশ নগরবাসী। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ইতোমধ্যে রাজধানীর ২৩টি এলাকা চিকুনগুনিয়ার জন্য অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এগুলো হলো- ধানম-ি ৩২, ধানম-ি ৯/এ, লালমাটিয়া, পল্লবী, মগবাজার, মালিবাগ চৌধুরীপাড়া, রামপুরা, তেজগাঁও, বনানী, নয়াটোলা, কুড়িল, পীরেরবাগ, রায়ের বাজার, শ্যামলী, মণিপুরিপাড়া, মোহাম্মদপুর, মিরপুর-১, কড়াইল বস্তি, মহাখালী, মধ্যবাড্ডা, গুলশান-১, উত্তরা ৪ ও উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টর। আইইডিসিআর’র পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ মীরজাদী স্রেবিনা ফ্লোরা বলেন, বালতিতে পানি ধরে রাখি, বা হাউসে পানি ধরে রাখি এবং এগুলো আমরা পরিবর্তন করি না, লম্বা সময় পানি জমে থাকে, এগুলো এডিস মশার বংশ বৃদ্ধি করে। চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব জানার জন্য মুঠোফোনভিত্তিক জরিপ করছে আইইডিসিআর। ৪ হাজার ৭৭৫ জন সম্ভাব্য রোগীর তথ্য নিয়ে ৩৫৭ জনের চিকুনগুনিয়া নিশ্চিত হওয়া গেছে। জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ঢাকায় চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব কমার আভাস পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, সঠিক তথ্য ও জনসচেতনতা জরুরী। নর্দমা বা রাস্তার পানি নোংরা বলে তাতে এডিস মশা বংশবিস্তার করতে পারে না। পরিত্যক্ত কৌটা, ড্রাম, পাত্র, বাসার টবে জমা পানিতে এই মশা বংশবিস্তার করে। সে জন্য বাসায় বা বাসার আশপাশে যেন পানি না জমে, সে ব্যাপারে ব্যক্তি ও পরিবারকে ভূমিকা রাখতে হবে বলে জানান মহাপরিচালক। তবে দুই সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, তারা স্বাস্থ্য অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সমন্বয় করেই চিকনগুনিয়া প্রতিরোধ কর্মসূচী পরিচালনা করছেন। দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডাঃ শেখ সালাউদ্দিন বলেন, আমরা প্রায় সময় পরিত্যক্ত জিনিস ছাদে রাখি। সেখানে পানি জমে আছে। দুই বাড়ির মাঝখানে পানি জমে আছে, পলিথিন জমে আছে, পলিথিনের মধ্যে পানি। এসব বিষয়ে বাসাবাড়ির লোকজনকেই সচেতন হতে হবে। উত্তর সিটি কর্পোরেশন প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম এম সালেহ ভূঁইয়া বলেন, র‌্যালি করছি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মিটিং করছি। তাদের কাছ থেকে দিকনির্দেশনা নিচ্ছি এবং স্বাস্থ্য অধিদফতর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং আমরা যৌথভাবে কাজ করছি। গত কয়েক মাস ধরে দেশে চিকুনগুনিয়ার টানা প্রাদুর্ভাব চলছে। এ রোগে মৃত্যুর খবর নেই। তবে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা সরকারী হিসাবের তুলনায় অনেকগুণ বেশি। ঘরে ঘরে যেন চিকুনগুনিয়া রোগী। তবে এ বিষয়ে সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, চিকুনগুনিয়া জ্বর নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। এতে কারও মৃত্যু ঘটবে না। এই জ্বর এমনিতেই সেরে যায়। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে অবশ্যই চিকিৎসা নিতে হবে। চিকুনগুনিয়া মশাবাহিত একটি ভাইরাসের নাম। ডেঙ্গু রোগের ভাইরাস বহনকারী মশাই চিকুগুনিয়া ভাইরাস বহন করে। এটি নতুন কোন ভাইরাস নয়। ১৯৫২ সালে প্রথম তানজানিয়ায় রোগটি শনাক্ত হয়। এখন বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশে রোগটি দেখা যায়। ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশে এই রোগটির প্রকোপ প্রথম দেখা যায়। তবে এর আগে এই রোগ বাংলাদেশে অন্য নামে পরিচিত ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ জনকণ্ঠকে জানান, অনুকূল পরিবেশ পাওয়ায় চিকুনগুনিয়া ভাইরাস বহনকারী মশার প্রকোপ বেড়েছে। চিকুনগুনিয়া রোগের প্রথমদিন থেকেই রোগীর অনেক বেশি তাপমাত্রায় জ্বর ওঠে। কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। আর প্রায় তা ১০৪ থেকে ১০৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট তাপমাত্রায় উঠে যায়। একই সঙ্গে প্রচ- মাথা ব্যথা, শরীর ব্যথা, বিশেষ করে হাড়ের জয়েন্টে ব্যথা হয়। এজন্য গ্রাম-গঞ্জে অনেকে একে ল্যাংড়া জ্বরও বলে। জ্বর চলে যাওয়ার পর শরীরে লাল র‌্যাশ ওঠে। জ্বর ভাল হলেও রোগটি অনেকদিন ধরে রোগীদের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্য কোন ভাইরাসে এতটা ভোগান্তি হয় না। সচেতন হতে হবে, তবে এই ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। চিকুনগুনিয়া থেকে বাঁচতে সতর্কতা হিসেবে করণীয় সম্পর্কে জানিয়ে অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলছেন, মশার কামড় থেকে বাঁচার ব্যবস্থা করতে হবে। ঘরের বারান্দা, আঙ্গিনা বা ছাদ পরিষ্কার রাখতে হবে, যাতে পানি পাঁচদিনের বেশি জমে না থাকে। এসি বা ফ্রিজের নিচেও যেন পানি না থাকে, তাও নিশ্চিত করতে হবে। যেহেতু এই মশাটি দিনের বেলায় কামড়ায়, তাই দিনের বেলায় কেউ ঘুমালে অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে। মশা মারার জন্য স্প্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। ছোট বাচ্চাদের হাফপ্যান্টের বদলে ফুলপ্যান্ট পরতে হবে, আর সবার খেয়াল রাখতে হবে যেন মশা ডিম পাড়ার সুযোগ না পায়। তাহলেই এই রোগটি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ।
×