ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলার এক বছর ॥ অস্ত্র ও অর্থদাতাদের খোঁজা হচ্ছে

পুলিশ এখনও চার্জশীট দিতে পারেনি

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৮ জুলাই ২০১৭

পুলিশ এখনও চার্জশীট দিতে পারেনি

মাজহার মান্না, কিশোরগঞ্জ, ৭ জুলাই ॥ দেশের সর্ববৃহৎ ঈদগাহ কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়ার পাশে ঈদ-উল-ফিতরের দিন জঙ্গী হামলার এক বছর পেরিয়ে গেলেও চাঞ্চল্যকর এ মামলায় এখনও আদালতে চার্জশীট দেয়া হয়নি। বর্তমানে এ মামলায় কারাগারে রয়েছে জঙ্গী জাহিদুল হক তানিম, রাজীব গান্ধী ও আনোয়ার হোসেন। তবে মামলার তদন্তে অনেক অগ্রগতি রয়েছে দাবি করে তদন্তকারী কর্মকর্তা কিশোরগঞ্জ মডেল থানার ওসি (তদন্ত) মুর্শেদ জামান জানান, এ মামলার মোটিভ উদ্ধার করা হয়েছে। জড়িতদের অনেককেই চিহ্নিত করা হয়েছে। এখন অস্ত্র ও অর্থের যোগানদাতা, নেপথ্য মদদদাতা, তথ্য পাচারকারীসহ অন্যদের শনাক্ত ও ধরতে কাজ করছে পুলিশ। গত বছরের ৭ জুলাই ঈদের দিন জঙ্গীদের বোমা আর গুলির শব্দে কেঁপে ওঠে শোলাকিয়া ময়দানসহ আশপাশ এলাকা। ওই দিন চরশোলাকিয়া সবুজবাগ মোড়ে মুফতি মোহাম্মদ আলী জামে মসজিদের সামনে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যদের ওপর আচমকা হামলা চালায় একদল জঙ্গী। এ সময় জঙ্গীদের হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন পুলিশের দুই সদস্য আনসারুল হক ও জহিরুল ইসলাম। এছাড়া গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন স্থানীয় বাসিন্দা গৃহবধূ ঝর্ণা রানী ভৌমিক। আর হামলার পর পুলিশের সঙ্গে প্রায় ঘণ্টাখানেক চলা বন্দুকযুদ্ধে ঘটনাস্থলে নিহত হয় আবির রহমান নামে এক জঙ্গী। এদিকে জঙ্গী হামলার এক বছর অতিবাহিত হওয়ায় শুক্রবার সকালে নিহত দুই পুলিশ সদস্য ও গৃহবধূর স্মরণে জেলা পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের অস্থায়ী বেদিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করা হয়। এছাড়া এলাকাবাসী গৃহবধূর স্মরণে শোকসভার আয়োজন করে। জেলা পুলিশ লাইনসে স্থাপিত নিহত দুই পুলিশের অস্থায়ী বেদিতে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাকিব খান। পরে তিনি শোলাকিয়া সুবজকাগ এলাকায় নিহত গৃহবধূ ঝর্ণা রানী ভৌমিকের স্মরণে স্থাপিত অস্থায়ী বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। এ সময় জেলা পুলিশের অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। অপরদিকে হামলার এক বছর পরও বিপর্যস্ত দিন কাটাচ্ছেন জঙ্গীদের গুলিতে নিজ বাড়িতে নিহত হওয়া গৃহবধূ ঝর্ণা রানী ভৌমিকের পরিবারের সদস্যরা। ঝর্ণার স্বামী গৌরাঙ্গ নাথ ভৌমিক জানান, ‘শোক এখনও আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। ঘটনার পর অনেকেই অনেক ধরনের সহায়তার কথা জানালেও বাস্তবে কিছুই পাইনি। নিহতের বড় ছেলে বাসুদেব জানান, তার মায়ের মৃত্যুতে পরিবারটি এলোমেলো হয়ে গেছে। বাবা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছেন, ছোট ভাইটিও মায়ের শোকে লেখাপড়ায় মন বসাতে পারছে না।’ শুধু ঝর্ণা রানীর পরিবারের সদস্যরা নন, ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় এলাকাবাসীও এখনও ভুলতে পারছেন না সেই দুঃসহ স্মৃতি। এখনও সেদিনের কথা মনে হলে অনেকে আঁতকে ওঠেন। বিশেষ করে এখানকার শিশুদের মন থেকে ওই দিনের ঘটনার স্মৃতি দূর হচ্ছে না কিছুতেই। জানা গেছে, জঙ্গীবাদ হারাম ঘোষণা করে এক লাখ আলেমের স্বাক্ষরসংবলিত ফতোয়া প্রকাশের কারণে শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা ফরিদউদ্দীন মাসউদকে টার্গেট করে জঙ্গীরা। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল গণতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে দেশে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করা। পুলিশ সূত্রমতে, শোলাকিয়া হামলায় প্রশিক্ষিত পাঁচ জঙ্গী মাঠে থাকলেও সরাসরি অপারেশনে অংশ নেয় দুজন। ঈদের দিন সকালে অপারেশনের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও দিকনির্দেশনার পর দুই জঙ্গীকে মাঠের কাছাকাছি পৌঁছে দিয়ে কিশোরগঞ্জ ছাড়ে তিন জঙ্গী। শোলাকিয়া হামলার মূল পরিকল্পনাকারী রাজীব গান্ধী ঢাকার হলি আর্টিজানের হামলায় সরাসরি অংশ নিলেও শোলাকিয়া হামলায় সে ঘটনাস্থলে ছিল না। শোলাকিয়া হামলার ঘটনায় এ পর্যন্ত শনাক্ত হওয়া আট আসামির মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জঙ্গীবিরোধী অভিযানে পাঁচজনই নিহত হয়েছে। শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলার পর ১০ জুলাই কিশোরগঞ্জ মডেল থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ছয়টি ধারায় একটি মামলা করা হয়। পাকুন্দিয়া থানার ওসি (তদন্ত) মোহাম্মদ সামসুুদ্দীন বাদী হয়ে মামলায় (নং-১৪) হামলার সময় আহতাবস্থায় আটক জঙ্গী সাইফুল ইসলাম ওরফে শফিউল ইসলাম ওরফে ডন ও শহরের বত্রিশস্থ পশ্চিম মনিপুরী গ্রামের আঃ সাত্তারের ছেলে জাহিদুল হক তানিমসহ আরও কিছু অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীকে আসামি করা হয়। কিশোরগঞ্জ মডেল থানার ওসি (তদন্ত) মুর্শেদ জামানকে চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়। বর্তমানে এ মামলায় কারাগারে রয়েছে মামলার আসামি জাহিদুল হক তানিম, রাজীব গান্ধী ও আনোয়ার হোসেন। এখনও আদালতে এ মামলার চার্জশীট দেয়া হয়নি। তবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোর্শেদ জামান জানান, ‘শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলার অন্যতম হোতা জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধীকে গত ২৯ মে আদালতের অনুমতিক্রমে তিন দিনের রিমান্ডে নেয় কিশোরগঞ্জ পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে সে পুলিশের কাছে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। এ ঘটনায় অস্ত্রদাতা, অর্থদাতা ও হামলার নেপথ্যে আর কারা ছিল তাদের নাম প্রকাশ করেছে সে। জিজ্ঞাসাবাদে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি ও শোলাকিয়া হামলায় নিজে জড়িত থাকাসহ আরও অনেকের নাম বলেছে রাজীব’। কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন খান সাংবাদিকদের জানান, ‘এটি একটি বড় মামলা। এর সঙ্গে আরও অনেক ঘটনা জড়িত। সঠিক পথেই মামলার তদন্ত এগোচ্ছে। হামলায় জড়িতদের চিহ্নিত করা হয়েছে। সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।’
×