ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে

প্রকাশিত: ০৩:৩৭, ৮ জুলাই ২০১৭

ভুল  থেকে শিক্ষা নিতে হবে

অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের কর্মপরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন ঘটানো প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমাদের অতীত থেকে শিক্ষা নেয়ার সাংস্কৃতিক চর্চার প্রবণতা কম। ফলে কোন একটি অঘটন ঘটলে আমরা সাময়িকভাবে আলোড়িত হই কিন্তু এর দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও তা প্রতিরোধের বিষয়টি ভেবে দেখি না। আবার পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও তা বাস্তবে কতটুকু ফলপ্রসূ হচ্ছে সেক্ষেত্রে তদারকি ও নজরদারির ব্যবস্থা নেই। অতিসম্প্রতি কাশিমপুরের নয়াপাড়ায় ‘মাল্টি ফ্যাবস লিমিটেড’ নামের পোশাক কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। বয়লার দুর্ঘটনা যে শুধু আমাদের দেশে ঘটছে তা নয় এটি একটি বিশ্বজনীন সমস্যা। তবে উন্নত দেশে বয়লার বিস্ফোরণের হার যেমন কম, তেমনি ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কম। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, বয়লার একটি নির্দিষ্ট চাপ ও তাপমাত্রায় কাজ করে। কিন্তু এই চাপ ও তাপমাত্রার কোন কারণে যদি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায় এবং বয়লার সুরক্ষার সতর্কীমূলক ডিভাইসসমূহ কোন কারণে কাজ না করলে বয়লার বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। বয়লারের পানিতে বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদানের কারণে কোরসন বা ক্ষয় ঘটে, যা বিপদ ডেকে আনতে পারে। অদক্ষ বয়লার অপারেটরদের কারণেও ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। পরিকল্পনা বা ডিজাইন অনুসারে বয়লারের পানির স্তর যেখানে থাকা দরকার তা না থাকলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এ ছাড়া নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকির অভাবে বয়লার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। পরিসংখ্যানগত দিক বিবেচনা করলে দেখা যায় আমাদের দেশে ৫৫০০ বা এর অধিক পরিমাণে বয়লার থাকলেও বয়লার ইন্সপেক্টর মাত্র ছয়জন। আবার বাংলাদেশ এখন শিল্পমুখী হওয়ায় বয়লারের সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। অনেক ক্ষেত্রে শিল্প কারখানাগুলো কম মূল্যের বয়লারের দিকে ঝুঁকে পড়ায় গুণগত মানকে গুরুত্ব প্রদান করছে না। আবার দেশ ও বিদেশে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ বয়লার কর্মী তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না। অনেকটা থাম রুল অনুযায়ী বয়লারগুলো চালানো হচ্ছে। যা ভবিষ্যতে বিপর্যয়ের কারণ ঘটাতে পারে। দেশেও বয়লার তৈরির শিল্প কারখানা তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি। এক্ষেত্রে সরকার ও শিল্প উদ্যোক্তারা বিভিন্ন প্রণোদনা, স্বল্প সুদে ঋণ ও বয়লার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলার মাধ্যমে বয়লার শিল্পের বিকাশ ঘটাতে পারে। আবার এই বয়লারের গুণগত মান নিশ্চিত করা গেলে দেশে গ-ি ছাড়িয়ে বিদেশেও রফতানির ব্যবস্থা করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। এ ছাড়াও দেখা যায় যে আমাদের দেশে শিল্প কারখানাগুলোর মূল ভবনের নিচে অথবা শিল্প কারখানার ছাদে বয়লার স্থাপন করা হয়। ফলে দুর্ঘটনায় শ্রমিকসহ সব ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু বয়লার সংরক্ষণের জন্য মূল ভবনের বাইরে পৃথক বয়লার শেড তৈরি করে বয়লার স্থাপন করা হলে, কোন কারণে বয়লার বিস্ফোরণ ঘটলে তা সীমাবদ্ধ জায়গার মধ্যেই ঘটবে। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিসহ যান ও মালের নিরাপত্তা করা বিধান সম্ভব। যা বর্তমানে অধিকাংশ শিল্প কারখানায় মেনে চলা হচ্ছে না। গতকাল মঙ্গলবার সমকালের প্রকাশিত ‘হঠাৎ বিকট শব্দ নিমিষেই সব শেষ’ প্রতিবেদনে সাংবাদিক ইজাজ আহমেদ মিলন লিখেছেন ‘চারতলা ভবনের নিচতলায় নামাজের স্থানে জায়নামাজে বসা ছিলেন দু’-একজন। কেউ মাগরিবের নামাজ শেষ করে কেবল উঠে দাঁড়িয়েছেন। ঠিক সেই মুহূর্তে ভবনে স্থাপিত কারখানার বয়লারটি বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আগুনের কুণ্ডলী ঝলক দিয়ে ওঠে। ভবনের দুই, তিন ও চারতলা ভেঙ্গে পড়তে থাকে নিচে। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন কয়েক শ্রমিক। ঝলসে যাওয়া মরদেহগুলো চাপা পড়ে ধসেপড়া ভবনের কংক্রিটের নিচে। শ্রমিক ও পুলিশ জানায়, ১৯৯২-৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এ কারখানা সুইডেন, ডেনমার্ক, জার্মানি, জাপান, রাশিয়া, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, ইউকেসহ বিভিন্ন দেশের কাজ করে থাকে। ড. মহিউদ্দিন ফারুকীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটিতে নিটিং, ডায়িং ও প্রিন্টিং শাখা ছিল।’ এ পর্যন্ত এই ঘটনায় মৃতের সংখ্যা দশে দাঁড়িয়েছে। আহত হয়েছে প্রায় অর্ধশত। বিপর্যয় নেমে এসেছে কর্মজীবী মানুষের জীবনে। আর যারা প্রাণ হারিয়েছে আজ তাদের পরিবারে নির্মম হাহাকার ও আর্তনাদ। তাদের পরিবারের কান্না কি কখনও আমরা থামাতে পারব? আমরা কি তাদের আগুনে পোড়া ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারব? পোড়া মাটির অভিশাপে তাদের স্বামী, সন্তান ও পিতার মৃতদেহগুলো তারা কি কখনও ফিরে পাবে? নাকি আগুনে পোড়া কয়লাগুলো তাদের স্বজনের অস্তিত্বের কথা বলবে। এ প্রশ্নের উত্তরগুলো হয়ত কোন দিনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। সার্বিক অর্থে বিষয়টি খুবই মর্মান্তিক। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাহেনুল ইসলামকে প্রধান করে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৮ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ৭ কর্মদিবসের মধ্যে কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে। এ কমিটি মাল্টি ফ্যাবস লিমিটেড ছাড়াও শিল্প এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ কারখানাগুলোর বর্তমান অবস্থার বিচার-বিশ্লেষণ করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ দুর্ঘটনা সম্পর্কে অনেকে অনেক মন্তব্য করেছেন। কেউ বলেছেন মালিকের গাফিলতি ও জরাজীর্ণ ভবন, কারও কারও মতে, গ্যাসের পাইপলাইন লিকেজ, বয়লারের প্রযুক্তিগত ত্রুটি, মেয়াদোত্তীর্ণ বয়লারের ব্যবহার, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট, দাহ্য ফুয়েল, কেমিক্যালসহ নানা ধরনের কারণ এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু আমরা যদি টঙ্গী ট্র্যাজেডি থেকে শিক্ষা নিয়ে বয়লার সুরক্ষার নীতিমালা গ্রহণ করতে পারতাম তবে আবার এ ধরনের ট্র্যাজেডির সম্মুখীন হতে হতো না। আবার নেমে আসত না মানবিক বিপর্যয়। ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে দেখা যায়, গাজীপুরের টঙ্গী বিসিক শিল্পনগরী ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে সেখানে ১৫২টি শিল্প কারখানা রয়েছে। যাদের অধিকাংশের অবকাঠামোগত দিকটি যুগোপযোগী নয়। যে শিল্প কারখানাগুলো বর্তমানে সচল রয়েছে তার মধ্যে অন্তত ৫০টি ভবনে শ্রমিকরা ঝুঁকিপূর্ণভাবে কাজ করছে। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, অধিক মাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কারণে ৭টি শিল্প কারখানা ইতোমধ্যে পরিত্যক্ত ঘোষিত হয়েছে। ৫৪ বছরের অধিক পুরনো ও জরাজীর্ণ এই কারখানাগুলোয় জীবন-জীবিকার তাগিদে অনেক শ্রমিক জীবন বাজি রেখে কাজ করে চলেছেন, তাদের জীবনেও যে কোন সময় নেমে আসতে পারে এ জাতীয় মহাদুর্যোগ। তবে যে যাই বলুক, সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছাড়া এ ধরনের ঘটনাগুলো রোধ করা সম্ভব নয়। সময় পরিবর্তিত হয়েছে, টেকনোলজিক্যাল পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে গড়ে উঠেছে। শিল্প কারখানাগুলোর প্রকৃতি অনুযায়ী যে ধরনের ভবন নির্মাণ করা দরকার সেই প্রযুক্তিগত ভিন্নতার বিষয়টি আমরা শিল্প কারখানা নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করছি না। আধুনিক অগ্নিনিরোধক যন্ত্র ব্যবহার করে শিল্প কারখানাগুলো সুফল পেতে পারে। সরকারের উদ্যোগে ফায়ার ফাইটিংসহ নিরাপত্তার বিষয়টিতে জোর দেয়া হলেও এ বিষয়ে সচেতনতার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। শিল্প কারখানা ও শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে দেশে প্রচলিত, শিল্প কারখানা ও শ্রম আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ সম্ভব হচ্ছে না। কারখানা ও শ্রমসংক্রান্ত এ আইনগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন করা দরকার। এখানে একটি বিষয় ভাবা যেতে পারে, আমাদের দেশে ডুয়েট, বুয়েট, কুয়েট, রুয়েট, চুয়েটসহ যেসব প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা, সচেতনতা ও গবেষণার ক্ষেত্রে কাজ করে চলেছে; উন্নত বিশ্বের মতো প্রতিটি শিল্প কারখানাকে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে আইন করে সম্পৃক্ত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের ভবন নির্মাণ, নিরাপত্তা, পণ্যের গুণগত মান উন্নয়নসহ বিশেষায়িত পরামর্শ প্রদান ও গবেষণা কার্যক্রম চালাবে। বিনিময়ে গবেষণার অর্থের যোগান দেবে এই শিল্প কারখানাগুলো। এতে শিল্প কারখানাগুলো যেমন উপকৃত হবে, তেমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণার মাধ্যমে উন্নত রাষ্ট্র গঠনে ভূমিকা রাখবে। শিল্প কারখানাগুলোয় যে কোন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার আগেই আমাদের তা প্রতিরোধের বিষয়টি ভাবতে হবে। যে ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে তা ভেঙ্গে ফেলে আধুনিক প্রযুক্তিগত ধারণা প্রয়োগ করে ভবনগুলো নির্মাণ করতে হবে, যেখানে বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে। যে সময় ভবনগুলো নির্মিত হবে সেই সময়ে শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ অথবা বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার ক্ষুণœ না হয়। আমরা আর শ্রমজীবী মানুষের লাশের মিছিল দেখতে চাই না, আমরা গাইতে চাই জীবনের জয়গান। লেখক : অধ্যাপক [email protected]
×