ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইফতেখার আহমেদ খান

গুলশান হামলার এক বছর

প্রকাশিত: ০৩:৩৬, ৮ জুলাই ২০১৭

গুলশান হামলার এক বছর

সম্প্রতি পালিত হলো ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশানে ভয়ঙ্কর জঙ্গী আক্রমণের এক বছর। বস্তুতপক্ষে সার্বভৌম বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সমাজধারার প্রকৃতি বিশ্লেষণে এই জঙ্গী গোষ্ঠীর উদ্ভব বিকাশ ও প্রকাশ একটি সম্পূর্ণ বিপরীত পরিক্রমা। একটা সমাজ কতটা ভয়ঙ্কর অবস্থায় পৌঁছে গেলে এরূপ ঘটনা ঘটে। সমাজের ভিতরের মনস্তত্ত্ব¡ কতটা তেতে ওঠলে সারা গায়ে বারুদ মেখে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজের জীবনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। এটি আবহমান বাংলার শাশ্বত ও মৌলিক রূপ নয়। এ্যাকাডেমিক গবেষণা পদ্ধতি মতে, যা ঘটে তাই ঘটনা (ডযধঃ রং ৎবধষষু যধঢ়ঢ়বহবফ রং ভধপঃ)। বাস্তব ঘটনা হলো বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ চরমভাবে সক্রিয় রয়েছে। আইএস করেছে, জেএমবি করেছে কিংবা অন্যকোন চরমপন্থী করেছে -এ রকম কথা এই পরিপ্রেক্ষিতে খুবই প্রাসঙ্গিক। এখানে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হলো যার দ্বারাই হোক জঙ্গী আক্রমণ আমাদের এই দেশে এক বাস্তব সত্য। রাষ্ট্র প্রসঙ্গ আসলে প্রথমেই রাজনীতির প্রসঙ্গ এসে যায়। আধুনিকতা শব্দটি মূলত রাজনীতি কেন্দ্রিক। যখন থেকে রাজার ছেলে রাজা হওয়ার রীতিধারা রহিত হলো এবং যখন থেকে শাসক হওয়ার রীতি সমষ্টির রায়ের ভিত্তিতে নির্ধারিত হলো ঠিক সেই সময় থেকেই আধুনিকতার শুরু। আধুনিকতা সভ্যতার একটি ‘ব্রেক থ্রু’ এটি একটি বাস্তব অবস্থা এবং বিবর্তনের পরিণতি। যেভাবেই হোক যে কারণেই হোক আমরা সেই অর্থে আধুনিক হতে পারিনি, যারই পরিণাম আজকের এই জঙ্গী হামলা। ঘটনাটির খোলস ধর্মভিত্তিক হলেও কার্যত এর অন্য উদ্দেশ্য রয়েছে। আধুনিকতা মানে হলো শাসনে গণতন্ত্র আর গণতান্ত্রিক শাসনের পদ্ধতি হলো দলভিত্তিক রাজনৈতিক চর্চা ও অনুশীলন। আমরা আধুনিক বিশ্বে যত উন্নত শাসন দেখি যত উন্নত সংবিধান দেখি তার মূলে রয়েছে দলীয় রাজনৈতিক চর্চা। দল হলেই সেটা রাজনৈতিক দল নয়। সকল রাজনৈতিক দলই দল, সকল দলই রাজনৈতিক দল নয়। কোন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দলকে সেই রাষ্ট্রের ইতিহাস ও সংস্কৃতির তথা ঐতিহাসিক জীবনধারার উৎসজাত হতে হয়। উদাহরণ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। শাসনে যত অপরিণত বিষয়ই লক্ষ্য করা যাক না কেন আওয়ামী লীগ তাত্ত্বিকভাবে এবং জনজীবনে উৎসগতভাবে একটি শুদ্ধ আধুনিক রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক দলের কর্মসূচী ও অনুসূচীর প্রক্রিয়া ও পদ্ধতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠে রাজনৈতিক সংস্কৃতি। গতকাল শেষ হওয়া অপারেশন টোয়াইলইিট’এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে বাংলােেদশর রাজনৈতিক সংস্কৃতি ব্যখ্যা করতে হবে। পাকিস্তানী ইসলামের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের উদ্ভব। যত ব্যাভিচার, অবিচার, অত্যাচর, অনৈসলামিক আচার সব কিছুকে ধর্ম দিয়ে বৈধতা দেয়া ছিল পাকিস্তানী শাসনের প্রকৃতি। স্বাধীনতা অব্যবহিতকালেই আবার এদেশে ধর্মভিত্তিক শাসন তথা ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার শুরু হয়। এটি হলো বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের ভ্রƒণ। মুক্তিযুদ্ধে গৃহীত ভূমিকা ও আধুনিক রাষ্ট্র নির্মাণের কারণে স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৭৬ সালে আবার তাদের অভ্যুদয় পূর্বতন ধর্ম- রাজনীতির নয়া আর্বিভাব ঘটায়। জামায়াতের রাজনীতির যৌক্তিক কোন গণভিত্তি নেই বিধায় তাদের রাজনৈতিক আচরণ হত্যা, জবাই, কতল, বোমা, রগকাটা, গাছপালা নিধন ইত্যাদির মধ্যে নিহীত। এই জাতীয় রাজনৈতিক আচরণ হলো জঙ্গীবাদের ওরিয়েন্টেশন এবং তার সামাজিকীকরণ। রাজনৈতিক বিখ-ন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রধান দিক। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রকৃতি দৃশ্যায়নে রাজনৈতিক দলসমূহের পারস্পরিক বিরুদ্ধাচরণ দেখে বুঝার উপায় নেই যে দ্বন্দ্বরত গোষ্ঠীগুলো একই দেশের। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করার জন্য ধর্মের আশ্রয় নেয়ার পূর্বতন চর্চার কোন বিলোপ ঘটেনি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগ আন্দোলনের বিপক্ষে হেফাজত নামক আরেক ধর্মগোষ্ঠীকে ব্যবহার করা হয়েছে। ভীষণ লজ্জাজনক ব্যাপার !! একটি আধুনিক উদারনৈতিক আন্দোলন যারা কোনরূপ আঘাত না করে বিচারের দাবিতে একত্রিত হয়েছে, তাদের নাস্তিক বানিয়ে এই আন্দোলন স্থগিত করার এ চেষ্টা আবারও সেই মধ্যযুগের ইউরোপ, আবারও সেই হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা ইত্যাদির প্রতিনিধিত্বের বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায়। সমগ্র মধ্যযুগ ছিল অরাজনৈতিক। মধ্যযুগের ইউরোপে পোপ, গির্জার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সকল ধরনের উদারনৈতিক ধারা তথা যুক্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে শক্ত বাধা সৃষ্টি করেছে। সমগ্র মধ্যযুগে ইউরোপে যুক্তিবাদ, নীতিবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্দ্রবাদ, রাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি কোন কিছুই প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেনি। পোপ আর রাজার দ্বন্দ্বে সমগ্র মধ্যযুগ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়েছিল। ১৮ শতাব্দীর শিল্পবিপ্লব এবং এভাবে সমগ্র ইউরোপে জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব সেই অন্ধকার দূর করেছে। আমাদের বাংলাদেশের বাস্তবতায় মধ্যযুগের অন্ধকার এখনও দূর হয়নি। আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূক্ষ্ম অধ্যয়নে এখনও দেখা যায় অনেক মানুষ জামায়াতকে সমর্থন না করাকে ইমানহীনতা মনে করে। এই চিন্তার মানুষের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও এর প্রভাব ভয়াবহ। ধর্মের নামে কোন দল গঠনের মনোভঙ্গির ছিলছিলা থেকে আমাদের বাংলাদেশ এখনও মুক্ত হয়নি। আফগান যুদ্ধ শেষে ১৯৯২ সালে এদেশে প্রথম জঙ্গী সংগঠন হরকাতুল জিহাদের জন্ম হয়। হরকাতুল মোজাহেদীন বা আফগান ফেরত জঙ্গীর প্রতি এদেশের জনগণের একটি ক্ষুদ্র অংশ রোমান্টিক মনোভঙ্গি নিয়ে আগ্রহী হয় এবং আত্মহুতির শপথে বলিয়ান হয়। মৌলিকভাবে বিএিনপি নামক রাজনৈতিক গোষ্ঠীর কোন তাত্ত্বিক ভিত্তি নেই। এটা রাজনীতি শাস্ত্রের একটি বড় অনুসন্ধান। এটিও জামায়াতের মতো আরেকটি ধর্মাশ্র্রয়ী সংগঠন। এর বহু দৃশ্যমান প্রমাণ রয়েছে। এই গোষ্ঠীর উদ্যোক্তাদের দ্বারাই বাংলাদেশের আধুনিক সংবিধানকে মধ্যযুগের ধারায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এই গোষ্ঠীরই ছত্রছায়ায় ১৯৯৮ সালে জেএমবি প্রতিষ্ঠা পায়। তারা একই সময় একাধারে বাংলাদেশের ৬৩টি জেলায় বোমা হামলা চালিয়ে তাদের শক্তি প্রকাশ করে। বাংলাদেশ জাতি রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নিয়েছে। বাঙালী জাতীয়তাবাদ সম্বলিত ‘সেক্যুলারিজম’ এই রাষ্ট্রের একটি প্রধান দার্শনিক ভিত। কিন্তু বাস্তবিকভাবে, চর্চাগতভাবে অভ্যুদয়ের উদ্ভবকালেই বাংলাদেশের দার্শনিক উদ্দেশ্য একেবারেই অনুশীলন হয়নি। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের বিকাশের পথরেখায় সুনির্দিষ্ট কোন দর্শনের প্রতিফলন ঘটেনি। এটি জঙ্গী আঘাতের একটি শক্তিশালী কারণ। স্বাধীনতাকালের মৌল সংবিধানের মূলনীতিসমূহ নানা সময়ে ক্ষত বিক্ষত করা হয়েছে, উল্টানো হয়েছে, পাল্টানো হয়েছে। তাছাড়াও বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের দার্শনিক ভিত্তির ব্যাপকভিত্তিক রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের কোন উদ্যোগ কোন সরকারই গ্রহণ করেনি। যেমন, জয়বাংলা সেøগানটি সার্বজনীন হয়নি। অথচ জয়বাংলা এদেশের অভ্যুদয় বাস্তবতায় একটি দর্শন। আমাদের জীবনধারার বৈশিষ্ট্য ও এর রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি প্রকৃতি এই যে, এটি একটি পুরুষতান্ত্রিক ধারা যা প্রায় সমগ্র পৃথিবীর বৈশিষ্ট্য। পুরুষতন্ত্র একটি নির্মাণ, একটি প্রতিষ্ঠা ও প্রতিষ্ঠান যার মুখ্য উপাদানগুলো অসত্য, অযৌক্তিক ও অবৈজ্ঞানিক। পুরুষ বেরিয়ে পড়, নারী ঘরে ঢুকে পড় Ñএই হলো পুরুষতন্ত্রের অন্তরের কথা যা কর্যত একটি অসাড় ও অযৌক্তিক পরিক্রমা। আমাদের দেশের মানুষের মন ও মগজ খুব বেশি মাত্রায় পুরুষতান্ত্রিক। আমাদের শাসক, শাসকের বিরোধী, গণপরিষদের প্রধান সবাই নারী সত্য, তেমনি সত্য হলো তারা নারী হয়েও চরমভাবে পুরুষতান্ত্রিক। তারা অত্যন্ত মনোযোগী হয়ে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোকেই মেরামত করে যাচ্ছে। আমাদের দেশের বাস্তবতায় দেখা যায় মেয়েরা চাকরি করে, বাজারে যায়, পার্কে যায়, সুন্দর করে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোজ দেয়, পুরুষদের মতো নানাস্থানে ঘুরে বেড়ায়। এই বিষয়গুলো জঙ্গী নামক মানব সন্তানদের মনে জ্বালা ধরায়। মেয়েরা ঘরে থাকবে, ঘরের কাজ করবে, সন্তান জন্ম দিবে প্রয়োজন হলে মুখ ঢেকে একজন পুরুষকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে যাবে- নারীদের এই রকম একটা সামাজিক স্ট্যাটাস প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তারা উন্মুখ হয়, তড়পায়, পাখির পাখা ঝাঁপটানোর মতো শরীর ঝাঁপটায়। তারা উপলব্দি করে এই অবস্থার মধ্যে কোনক্রমেই নারীদের সেই স্ট্যাটাস বয়ে আনা সম্ভব নয়। অনন্যোপায় হয়ে নিজেরা জঙ্গী হয়ে আত্মহুতি দেয়। এটিই মূলত তাদের সামগ্রিক উদ্যোগের মুখ্য উদ্দেশ্য। জঙ্গীরা ধর্ম রক্ষার জন্য আক্রমণ করে বলে ঘোষণা দেয়। বাস্তবতা হলো তারা পুরুষতন্ত্রকে রক্ষার জন্য আরও সহজভাবে নারীদের ঘরে ঢোকানোর জন্য হামলা চালায়। বিষয়টি এমন, যেহেতু এই শাসন তাদের উদ্দেশ্যের পথে বাধা হয় সেহেতু তারা বোমা মেরে সরকাকে নস্যাত করতে চায়। হলি আর্টিজানে জঙ্গীরা বলেছিল তারা বিদেশীদের হত্যা করতে চায়। তাদের পর্যবেক্ষণে বিদেশী নারীদের দেখে দেখে আমাদের দেশের নারীরা ঘরের বাহির হয়েছে। এই জন্যই বিদেশী নারীরা তাদের প্রধান টার্গেট। আমাদের দেশে শাসনের সীমাহীন অনিয়ম, শাসকের লাগামহীন ভোগ, জনভোগান্তি, দুর্নীতির উল্লম্ফন আস্ফালন ইত্যাদি বাস্তব সমস্যা বিরাজমান রয়েছে। জঙ্গীরা এসবের প্রতিবাদ করে না কেন? এসবের বিরুদ্ধে কোন জঙ্গীগোষ্ঠী গড়ে ওঠে না কেন? জঙ্গীদের আসল উদ্দেশ্যটি কী, নিবিড় পর্যবেক্ষণে কী উত্তর বেরিয়ে আসে? রাষ্ট্রের একটি মৌলিক সংজ্ঞা এমন- রাষ্ট্র হলো কেন্দ্রীয় শাসন সহযোগে সমাজের আনুষ্ঠানিক কাঠামো (ংঃধঃব রং ঃযব ভড়ৎসধষ ংঃৎঁপঃঁৎব ড়ভ ংড়পরবঃু রিঃয পবহঃৎধষ ধঁঃযড়ৎরঃু) । রাষ্ট্র একটি বিমূর্ত বিষয়, এটা দেখা যায় না, উপলব্দিতে আসে। একটি রাষ্ট্রকে স^ার্থক করতে হলে প্রয়োজন এর অভ্যন্তরের সকল বিষয়সমূহের যৌক্তিক বিন্যাস। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের বিষয়সমূহের যৌক্তিক বিন্যাসের জন্য প্রয়োজন ব্যাপকভিত্তিক রাজনৈতিক সমাজিকীকরণ (চড়ষরঃরপধষ ংড়পরধষরুধঃরড়হ)। রাষ্ট্র উদ্ভবের ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা ইত্যাদি সহযোগে একটি ব্যাপকভিত্তিক রাজনৈতিক সামাজিকীকরণই পারে বাংলাদেশকে এহেন অবস্থা হতে মুক্তি দিতে। লেখক : উন্নয়নকমী
×