ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ধ্বংসকারীর আবার দেশপ্রেম!

প্রকাশিত: ০৩:৩৬, ৮ জুলাই ২০১৭

ধ্বংসকারীর আবার দেশপ্রেম!

‘আওয়ামী লীগ দেশ ধ্বংস করে দিয়েছে; দেশে গণতন্ত্র নেই, মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত, নাগরিক অধিকার অপহৃত, ইত্যাদি ইত্যাদি...’ কথাগুলো প্রায়শ বলেন বিএনপি নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। পুরো মাহে রমজানে তার দল ও জোট আয়োজিত ইফতার পার্টিতে অনর্গল বলে গেছেন। অবশ্য তিনি একা নন, তার দলের মহাসচিবসহ অন্যরা বলে চলেছেন এসব কথা। নন-স্টপ। দাড়ি-কমা- সেমিকোলনবিহীন। যদি প্রশ্ন করা হয়, ঠিক আছে, আওয়ামী লীগ দেশ ধ্বংস করেছে (?) আপনারা কি গড়েছেন? জবাব হবে উন্নয়ন (?) করেছে, কি কি উন্নয়ন করেছে প্রশ্ন করা হলে একটি উদাহরণও দিতে পারেন না, পারবেন না। বস্তুত দেশের যে যে জায়গায় ধ্বংসের চিহ্ন রয়েছে তার সবই করেছেন মিলিটারি জিয়া এবং তার পতœী খালেদা জিয়া। তবে হ্যাঁ, জিয়া-খালেদা জিয়া যে সব সেক্টরে উন্নয়ন (?) করেছেন তা হলো ১. হাওয়া ভবন ২. খোয়াব ভবন ৩. যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-শিবির ৪. বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের সেøাগান দিয়ে পাকি ধারার রাজনীতি ৫. খাল কেটে কুমির আনা ৬. যা তাড়াতে আজও হিমশিম খেতে হচ্ছে ৭. উন্নয়নের নামে খাদ্য ঘাটতি স্থায়ী করার ষড়যন্ত্র করছে ৮. শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র এবং সর্বোপরি ৯. জঙ্গীবাদের যে বিষবৃক্ষ আজ নিধন করতে প্রতি মুহূর্ত সতর্ক থাকতে হচ্ছে তার চারাগাছটি রোপণ করে যান জিয়া আর নার্সিং করে চলেছেন খালেদা জিয়া। সবচেয়ে বড় কথা হলো একজন মানুষ যত খারাপই হোন না কেন পবিত্র মাহে রমজানে কিছুটা হলেও নিজেকে শুদ্ধ করার চেষ্টা করেন। এই পবিত্র রমজান হলো পরবর্তী ১১ মাস নিজেকে শুদ্ধ রাখার ট্রেনিং গ্রহণের মাস। খালেদা জিয়ার কাছে এর মূল্য আছে বলে মনে হয় না। এমনকি যখন হাওড় অঞ্চলে অতিবর্ষণজনিত ভয়াবহ বন্যা হলো কিংবা যখন পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাহাড় ধসে মাটি চাপা পড়ে দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হল এবং অনেক মানুষ নিখোঁজ হল তখনো খালেদা জিয়া তার দল, জোট নেতাদের উদ্বিগ্ন হতে দেখা যায়নি। অবশ্য দলের মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর চট্টগ্রাম পর্যন্ত গিয়ে মোটামুটি একটা মিডিয়া কভারেজ বাগে আনতে সক্ষম হন। যা নিয়ে বেশ কিছুদিন ঢেড়া পেটাতে পারবেন। তারপর এলো ফরহাদ মাজহার ইস্যু। এটি অবশ্য রহস্য। কে বা কারা তাকে অপহরণ করল, আদৌ অপহরণ হয়েছেন কিনা, কোন এক সময় সে রহস্য উদ্ঘাটিত হলে হয়ত অনেকেই অবাক হবেন। ঘটনাটি এমন এক সময় ঘটানো যখন বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের রথযাত্রা। থ্যাংক গড কোন অঘটন ঘটেনি। একটি গভীর ষড়যন্ত্র নিশ্চয়ই ঘটেছিল এবং সেই ষড়যন্ত্রে সেই বিতর্কিত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও তার প্রেসক্লাব কেন্দ্রিক গোষ্ঠী যোগ দিয়েছিল, যা গোয়েন্দারা আগেভাগে উদ্ঘাটন করে পানি করে দিয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়া কোনটাকে ধ্বংস বলছেন? কিছু উত্তর দেয়া দরকার। নয়তো এক তরফা বক্তব্য কিছু মানুষকে কিছুটা হলেও বিভ্রান্ত করবে। আজ বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিগত বন্যায় (হাওড়) ২৪ লাখ টন খাদ্য শস্য নষ্ট হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই ঘাটতি পূরণ করতেও এরই মধ্যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ভিয়েতনাম থেকে চাল আমদানির পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ঘাটতি আর থাকছে না। আমদানির অর্থের জোগানের জন্যেও কারও কাছে ধর্না দিতে হচ্ছে না। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে শুধু নয়, অবাক করার মতো জমেছে। এবার যে বাজেটটি দেয়া হলো তার পরিমাণও কেউ কল্পনা করতে পারেনি- চার লাখ ২৬২ কোটি টাকা। মানুষের মাথাপিছু গড় আয় ১৬০০ মার্কিন ডলারের ওপর, শিক্ষার হার ৭০ শতাংশ। গড় আয়ুও ৭০ ছাড়িয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কথা নাইবা বললাম, বহুবার বলেছি- এই সব কি দেশ ধ্বংস করা? বরং বলব এই সবই দেশ গড়ার ফসল সৃষ্টি। সবচেয়ে বড় কথা হলো জাতির পিতা হত্যার বিচার না করে, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে বরং তাদের গাড়িতে শহীদের রক্তে লেখা জাতীয় পতাকা তুলে দিয়ে জিয়া-এরশাদ খালেদা জিয়া যে পাপ করেছিল, যা গোটা জাতিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, তা থেকে মুক্তি কি দেশ ধ্বংস করা? নিশ্চয়ই নয়। বরং শেখ হাসিনা দুটি বিচারই সফলভাবে সম্পন্ন করে জাতিকে আত্মগ্লানি থেকে মুক্তি দিলেন। কি নৃশংস ছিল সেই হত্যাকা-- ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর এবং একাত্তরের ৯ মাস। যে মহানায়ক লড়াই করে নেতৃত্ব দিয়ে একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেন, যাদের জন্য করলেন তাদেরই কিছু কুসন্তান তাঁকে হত্যা করল। সেই কুসন্তানের দল এখনও একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। এখনও লড়াই করতে হচ্ছে এবং সে লড়াইরও নেতৃত্ব দিতে হচ্ছে তারই কন্যাকে? বঙ্গবন্ধু যেমন বলতেন বাংলার গরিব-দুঃখী মানুষ এবং তাদের জন্যে লড়াই করতে গিয়ে জেল-জুলুম সহ্য করেছেন, ফাঁসির কাস্টে পর্যন্ত যেতে হয়েছিল তবুও তার প্রিয় ‘গরিব-দুঃখী’ মানুষগুলোকে এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলেননি। পিতার মতই কন্যাও বাংলার ‘গরিব-দুঃখী’ মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গ করে কাজ করে চলেছেন, ‘গরিব-দুঃখী’ মানুষের অধিকারের প্রশ্নে পিতার মতো মৃত্যুভয়ও তাঁকে তার আরাধ্য কর্তব্য থেকে এতটুকু নিবৃত্ত করতে পারেনি। বার বার তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কৃপায় তিনি বেঁচে আছেন সুস্থ আছেন, দিবারাত্রি অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। বঙ্গবন্ধু কেবল যে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন তা নয়, সেই সঙ্গে কিভাবে দেশ চলবে, কিভাবে বাংলাদেশ একটি উন্নত সমৃদ্ধ দেশে উন্নীত হবে, জাতি হিসেবে বাঙালী মানে মর্যাদায় গৌরবে-ঐতিহ্যে পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবে সে লক্ষ্যে যা যা করা দরকার সবই করেছেন, মাত্র ৯ মাসে বিশ্বের অন্যতম সেরা সংবিধান দিয়েছেন, যা করে যেতে সময় পাননি সে সবেরও ভিত্তি স্থাপন করে গেছেন যার ওপর দাঁড়িয়ে আজ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা। এখানেই খালেদা জিয়াদের যত গ্লানি তাই মিথ্যা বচন দিয়ে ব্যর্থতা ঢাকতে চাচ্ছেন। বাংলাদেশের মানুষ খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে জামায়াত-শিবির-বিএনপির ধ্বংসলীলা দেখেছে ২০১৩ ও ২১০৪ তে। কিভাবে পেট্রোল বোমা মেরে সাধারণ মানুষ হত্যা করেছে; পুলিশ-বিজিবি হত্যা করেছে; গরুবাহী ট্রাকে পেট্রোল বোমা মেরে অবোধ গরু মেরেছে, কিভাবে ঘুমন্ত হেলপারসহ যাত্রীবাহী বাস পুড়িয়েছে; ট্রেন-বাস-ট্রেম্পো, রিকশা, অটোরিকশা, লেগুনা, লঞ্চ কোন কিছুই ওদের পেট্রোল বোমা-হামলা থেকে রেহাই পায়নি। এসব তারা করেছে একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাঠগড়া থেকে মুক্ত করতে- গোটা ২০১৩ জুড়ে এভাবে পেট্রোল বোমা হামলা চালিয়েছে। এখানে থেমে থাকেনি, রাস্তা কেটে রাস্তার ওপর শত শত গাছ ফেলে দেশটাকে অচল করে দিতে চেয়েছিল। এসব গণমাধ্যমে যেমন এসেছে তেমনি মানুষ দেখেছে। তবে আল্লাহর কৃপায় তারা সফল হয়নি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ছিল জাতীয় সংসদের নির্বাচনের দিন। খালেদা জিয়া সন্ত্রাসী বাহিনী এক নাগাড়ে তিন মাস একইভাবে নাশকতা চালিয়েছে নির্বাচন বন্ধ করতে পারেনি। তারা পাঁচ শতাধিক পুলিং বুথ (প্রাথমিক বিদ্যালয়) পুড়িয়েছে, ভাংচুর করেছে, প্রিসাইডিং অফিসার হত্যা করেছে, হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে মারধর, ঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে তাদের ঘরবাড়ি হারা করার মতো সম্প্রদায়িকতা কার্যক্রম চালিয়েছে। তাদের দলীয় পত্রিকা ‘আমার দেশ’-এ পবিত্র কাবা শরীফের গিলাপ পরিবর্তনের ছবি ছাপিয়ে বলেছে ‘কাবা শরীফের খতিবগণ’ জামায়াত নেতা দেলওয়ার হোসেন সাঈদীর মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন করছেন, এমনকি ভরা চাঁদের ছবির মাঝে দেলওয়ার হোসেন সাঈদীর চেহারা সুপার ইমপোজ করে ছেপে দিয়ে বলেছে- ঐ যে সাঈদীকে চাঁদে দেখা যাচ্ছে অথচ আওয়ামী লীগ সরকার তাকে ফাঁসি দিতে চাচ্ছে। এ নিয়ে বগুড়ায় ডেমোনেস্ট্রেশন হয়েছে, থানা আক্রমণ করা হয়েছে, গোলাগুলিতে প্রাণহানির ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে। ২০১৪-এর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত এই ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করে। এবং এই সব নাশকতার দায় সবটাই খালেদা জিয়া ও জোটের সন্ত্রাসীদের। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যতই বিষোদগার করা হোক এই দায় খালেদা জিয়া এড়াতে পারবেন না। এসব জনগণ জানে। তবু স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। অনেকের ভুলো মনতো। খালেদা জিয়ার ঐ সব ধংসাত্মক কর্মকা-ই ধ্বংস, অর্থাৎ দেশকে ধংস করে ক্ষমতায় গিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা, আবার হাওয়া ভবন চালু করে লুটপাট-দুর্নীতি- চোলাচালান পুনরায় চালু করাই ছিল লক্ষ্য। পক্ষান্তরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার পুলিশ র‌্যাব-বিজিবিসহ রাষ্ট্রীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তাদের প্রতিরোধ করে শান্তি ফিরিয়ে আনেন। এটাই সৃষ্টি। এমনকি ২০১৩-এর ৫ মে শাপলা চত্বরের সমাবেশ থেকে বিএনপি-জামায়াত-শিবির স্টাইলে যেভাবে রাজধানীতে জ্বালাও- পোড়াও চালানো হয় এবং খালেদা জিয়া যেভাবে নিজের দলকে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকা-ে সহায়তা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন সেটাই ছিল ধ্বংস। আর দুই ঘণ্টার মধ্যে মহানগরীকে হেফাজত-জামায়াত-এরশাদের হাত থেকে রক্ষা করে শেখ হাসিনা ও তার সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রমাণ করলেন তারা ধ্বংস নয়, সৃষ্টির পক্ষে। তাইতো আজ আমাদের অবস্থান বিশ্বের অগ্রসরমান দেশগুলোর প্রথম কাতারে মধ্যম আয়ের দেশ এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্রনেতা হিসেবে বিশ্বের অল্প ক’জন রাষ্ট্রনেতার কাতারে সম্মান ও মর্যাদায় আসীন। সর্বশেষ একটি কথা বলে সমাপ্তি টানতে চাই- যারা সৃষ্টি আর ধ্বংসের প্রভেদ বোঝে না তারা দেশপ্রেমী নয়, তারা দেশ ধ্বংসকারী। ঢাকা ॥ ৬ জুলাই ২০১৭ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি জাতীয় প্রেসক্লাব [email protected]
×