ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রুদ্র শোণিতে নিষ্প্রভ প্রাণ

প্রকাশিত: ০৭:১১, ৭ জুলাই ২০১৭

রুদ্র শোণিতে নিষ্প্রভ প্রাণ

রবীন্দ্রনাথ সোভিয়েত সরকারের আমন্ত্রণে ১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বরে রাশিয়া গিয়েছিলেন। প্রথম মহাযুদ্ধের পর রাশিয়ার সামাজিক বিপ্লব এবং তাদের কর্মযজ্ঞ দেখে তিনি অভিভূত হন। এ সময় তিনি লেখেন: ‘... আপাতত রাশিয়ায় এসেছিলেন -না এলে এ জন্মের তীর্থদর্শন অত্যন্ত অসমাপ্ত থাকত। এখানে এরা যা কাণ্ড করছে তার ভাল-মন্দ বিচার করার পূর্বে সর্বপ্রথমেই মনে হয়, কী অসম্ভব সাহস। সনাতন বলে পদার্থটা মানুষের অস্থিমজ্জায় মনে-প্রাণে হাজারখানা হয়ে আঁকড়ে আছে; তার কত দিকে কত মহল, কত দরজায় কত পাহারা, কত যুগ থেকে কত ট্যাক্স আদায় করে তার তহবিল হয়ে উঠেছে পর্বতপ্রমাণ। এরা তাকে একেবারে জটে ধরে টান মেরেছে; ভয় ভাবনা সংশয় কিছু মনে নেই। সনাতনের গদি দিয়েছে ঝাঁটিয়ে, নূতনের জন্যে একেবারে নূতন আসন বানিয়ে দিলে। পশ্চিম মহাদেশ বিজ্ঞানের জাদুবলে দুঃসাধ্য সাধন করে, দেখে মনে মনে তারিফ করি। কিন্তু এখানে যে প্রকাণ্ড ব্যাপার চলছে সেটা দেখে আমি সব চেয়ে বেশি বিস্মিত হয়েছি। শুধু যদি একটা ভীষণ ভাংচুরের কাণ্ড হতো তাতে তেমন আশ্চর্য হতুম না কেননা নাস্তানাবুদ করার শক্তি এদের যথেষ্ট আছে কিন্তু দেখতে পাচ্ছি, বহুদূরব্যাপী একটা ক্ষেত্র নিয়ে এরা একটা নূতন জগত গড়ে তুলতে কোমর বেঁধে লেগে গেছে। দেরি সইছে না; কেননা জগতজুড়ে এদের প্রতিকূলতা, সবাই এদের বিরোধী যত শীঘ্র পারে এদের খাড়া হয়ে দাঁড়াতে হবে। হাতে হাতে প্রমাণ করে দিতে হবে, এরা যেটা চাচ্ছে সেটা ভুল নয়, ফাঁকি নয়। হাজার বছরের বিরুদ্ধে দশ-পনেরো বছর জিতবে বলে পণ করেছে। অন্য দেশের তুলনায় এদের অর্থের জোর অতি সামান্য, প্রতিজ্ঞার জোর দুর্ধর্ষ।’ এরপর গড়িয়ে গেছে অনেক সময়। সাঙ্ঘাতিক পরিবর্তন হয়েছে পরিস্থিতির। গুটিকয়েক লোকের কাছে পরাজিত হয়েছে বিপুল মানুষ। এখন রাষ্ট্রের বিরোধীরা নেই বিরোধী অবস্থানে। নাগরিকেরা থাকে না নাগরাধিকারের পক্ষে। মানুষ ‘ভিকটিম-কমপ্লেক্সের’ বৃত্তে আবদ্ধ। তারা ধরেই নিয়েছে, কর্তৃপক্ষের কেউই আর তাদের ধার ধারে না। তাদের দ্বারা কিছুই বদলাবে না। নব্বইয়ের পর থেকে সেখানে সৃষ্টি হওয়া শুরু হয়েছে নাগরিক নিবীর্যতা বা অক্ষমতা, অপ্রীতিকর অর্থনৈতিক দুরবস্থা। এখন ক্ষমতাসীনদের কট্টর শাসন, প্রবঞ্চক নির্বাচন, দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্র, গণমাধ্যমের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার, প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ওপর নিষেধাজ্ঞা সাধারণ মানুষের হৃদয়ে প্রোথিত করে দিয়েছে অসহায়ত্বের বেদনাবোধ। ভোট দিতে যায় না মানুষ, বিক্ষোভেও না। সেখানকার মানুষেরা বলেন: ‘আমাদের পছন্দ-অপছন্দের কোন মূল্য নেই তাদের (কর্তৃপক্ষ) কাছে। আমরা মিছিল-মিটিংয়ে যাই না। গেলে যে কোন উপায়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়া হয়। আমাদের অধিকারের জন্য আমরা লড়াই করি না, সংগ্রাম করি না। আমরা বেঁচে আছি-এতেই ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।’ তাই বলা যায়, কোটি কোটি মানুষ টিকে আছে সেখানে ঠিকই, কিন্তু দাঁড়িয়ে আছে প্রাণের শেষ দুর্বল শক্তিটুকু নিয়ে ধ্বংসের পাড়ে। তারা কর্তৃপক্ষদের ঘ্রণা করে, কিন্তু পরিবর্তনের কথা মনে এলেই ভয়ের জ্বরে ভোগে। তারা অন্যায়টা বোঝে, কিন্তু প্রতিবাদী সক্রিয় কর্মীদের সহ্য করতে পারে না। তারা আমলাতন্ত্রকে পছন্দ করে না, কিন্তু জীবনের সব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সামরিক নিয়ন্ত্রণের কাছে নতজানু হয়ে থাকে। তারা পুলিশের ভয়ে ভীত, কিন্তু পুলিশী শাসন-কাঠামো বিস্তৃতির বিপক্ষে কোন কথা বলে না। টেলিভিশন তাদের সঙ্গে অবিরাম প্রতারণা করে চলছে, তা জানা সত্ত্বে¡ও তারা টেলিভিশনের সব মিথ্যাচার নির্বিরোধে গ্রাস করে নিচ্ছে। তাদের বৈষম্যবোধ ও আকাক্সক্ষা শক্তির মাজা এমনভাবে ভেঙ্গে গেছে বা চুরমার করে দেয়া হয়েছে যে ফলে সেই এক মনোবিদের উপমার মতো সাধারণ মানুষ যেন বৈদ্যুতিক শকের আওতায় আনা একটা ঘরে বৈদ্যুতিক সুইচ টিপে শক থেকে বাঁচতে পারছে না কিংবা ব্যর্থ হচ্ছে নিচু পার্টিশন-ওয়ালটা ডিঙ্গিয়ে তড়িতায়িত হওয়া কক্ষ থেকে নিরাপদটাতে যেতে। কালুগা প্রদেশের একটা গ্রামের কথা বলি। মস্কো থেকে এর দূরত্ব ৩০০ কিলোমিটার। এখানে অন্য গ্রামের তুলনায় সুবিধা অনেক বেশি। কিন্তু মানুষজন কোলাহলপ্রিয় ও ঝগড়াটে। সামান্য কারণে বা একটু উত্তেজিত হলেই বেরিয়ে পড়ে ছুরি নিয়ে। প্রতি সন্ধায় শোনা যায় চিৎকার- চেঁচামেচি। কারও মুরগি চুরি হয়ে গেছে। কার কুুরকে কে যেন বিষ খাইয়েছে। একজন আরেকজনের বউকে পটিয়ে ভাগিয়ে নিয়ে গেছে। ওই যে একজন মার খেয়েছে। মার-খাওয়া লোকটি এখন তার আক্রমণকারীদের পিছ পিছ ছুটছে কুড়াল নিয়ে। তাদের উদ্যম, উদ্যোগ, গর্ব এখন এসব কর্মকা- ঘিরে। গ্রামটাতে মাত্র কয়েকটি সৌভাগ্যবান বাড়ি পানি-সংযোগ পেয়েছে। অধিকাংশ গ্রামবাসীকে বালতি করে পানি বয়ে আনতে হয় রাস্তার ঝরনা থেকে। শীতের শুষ্ক মৌসুমে কোন এক দিন হঠাৎ ঝরনাগুলো শুকিয়ে যায়। বছরের এই সময়টাতে সবচেয়ে কাছের গিরি খাতটি থাকে খুবই পিচ্ছিল। যে মানুষগুলো গোলমেলে, ঝগড়াপ্রিয়, মারমুখো, তারাই দীর্ঘ পথ পা টেনে টেনে হেঁটে ক্লান্ত, শ্রান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়ে থাকে বালতি নিয়ে। গ্রামের কেউ-ই তাদের কোন সমস্যার কথা কর্তৃপক্ষকে জানায় না, যদিও প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই টেলিফোন আছে। কেমন জানি নিস্পৃহ, নিস্পন্দ হয়ে গেছে মানুষগুলো! বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটে। হরহামেশাই অনেক দিনের পুরনো বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। গ্রামটা ডুবে থাকে গাঢ় অন্ধকারে। এ অবস্থায় যা করার কথা তা হলো বিদ্যুতের জরুরী বিভাগকে ডাকা, কিন্তু গ্রামবাসীরা তা করে না। রাতে বিদ্যুত চলে গেলে তারা অন্ধকারেই পড়ে থাকে। অক্ষম ক্ষমতা সারা গ্রামকে আচ্ছন্ন করে রাখে। রাজধানী নগরেও এর থেকে পৃথক কোন চিত্র পাওয়া যাবে না। কর্তাব্যক্তিরা যখন হাসপাতাল, চিকিৎসা কর্মসূচী- এই ধরুন, জাতীয় ক্যান্সার প্রোগ্রাম বন্ধ করা শুরু“ করল- সবাই ক্ষেপে উঠল। চিকিৎসা সমস্যা সবার কাছেই সমান। রোগ হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান, এ দল-ওদল দেখে হানা দেয় না। সরকারী হাসপাতাল, যেখান থেকে কিছু লোক অন্তত চিকিৎসা পেত, তার পরিসরও সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। মাত্র এক বছরের মধ্যে ৭০০০ চিকিৎসা-কর্মী উদ্বৃত্ত হয়ে পড়ে। আটাশটি চিকিৎসা প্রতষ্ঠানের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। কর্মবৃন্ত থেকে ছিঁড়ে পড়ে অনেক চিকিৎসক, কিন্তু তাদের ক্ষোভে শামিল হয় না কেউ, বিক্ষোভে সমর্থন দেয় না কোনালোক। এক লোককে তার সন্তানের চিকিৎসার জন্য বসতবাড়িটুকুও বেচে দিতে হয়েছে। কেউ এ ব্যাপারে তার সামনে কথা উঠালেই ওই লোক জনস্বাস্থ্য ও কর্তৃপক্ষদের শাপ-শাপান্ত করে ও চৌদ্দ গোষ্ঠী ধুয়ে দেয়। ডাক্তারদের প্রতিবাদ কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করার পরামর্শ দেয়া হলে, কেবলই মাথা নাড়ায়: ‘ মাথা ঘামিয়ে লাভ কী?’ অনরূপ মনোভাব, একই প্রতিক্রিয়া বাকি সবার: ‘লাভ কী? কিছুই বদলাবে না। কিচ্ছু হবে না।’ সুরাহা কী জানতে চাইলে একটাই উত্তর: ‘ সমাধান একটাই-দেশ থেকে বের হয়ে যাওয়া।’ অধিকাংশ রাশিয়ানদের মাথায় দেশান্তরের চিন্তা। যেতেও পেরেছেন অনেকে। যারা ছিলেন বিরোধী, গত কয়েক বছর যাবত প্রতিবাদ- র‌্যালীতে যোগ দিয়ে আসছিলেন, তারা। দেশ ছাড়ার কারণটা ছিল যতটা না কষ্ট ও শাস্তির ভয়, তার বেশি ছিল সারাদেশে প্রবাহিত হতাশার আগুনে পুড়ে মরার ভীতি। কর্তৃপক্ষ তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন সব ধরনের উপায় উপকরণ কাজে লাগাচ্ছে একটা অনুগত ও অধীনস্থ সমাজ নির্মাণে এবং তা অক্ষুণœœ রাখতে। এমনিতেই আগের তুলনায় বর্তমানে অনেক দুর্বল সাধারণ মানুষের ইচ্ছা শক্তি। তার ওপর মগজ ধোলাই হয়ে উঠেছে প্রধান অস্ত্র তাদের সেই ইচ্ছা শক্তিকে দাবিয়ে রাখার, মুক্ত চিন্তাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেয়ার। মাথাটা পরোক্ষভাবে কিনেই হোক অথবা ভয় দেখিয়েই হোক গণমাধ্যমকে কব্জা করে রেখেছে কর্তৃপক্ষ। দৃশ্যপটে মনে হতে পারে ভাগাভাগি আছে। ক্রেমলিনবাদী এবং মেকি স্বাধীনতামুখী। আসলে পর্দায় যাই দেখুন না কেন, ঘুরে ফিরে সব একই: ভুয়া প্রতিবেদন, রাজনীতিবিদদের অর্থহীন দ্বন্দ্ব, প্রেসিডেন্ট তথা ব্যক্তি-পূজা, ভুলভাল প্রচার-প্রপাগা-া, কথা ও কাজের মধ্যে সামঞ্জস্যহীনতা,প্রচলিত আইনের সঙ্গে অদ্ভুত সব সংযোজন। মাঝে মাঝে খবর দেখলে স্নায়ু রোগী হওয়া আর প্রতিদিন টিভি দেখলে মানসিক রোগী হওয়া ছাড়া অন্য কিছু হওয়ার কোন সুযোগ নেই। সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষ এ অবস্থার দীর্ঘায়ু কামনা করে না। (তথ্যসূত্র: রাশিয়া অন দ্য ভার্জ অব অ্যা নার্ভাস ব্রেকডাউন)।
×