ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ মিরাজুল ইসলাম

ধা রা বা হি ক ॥ উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

প্রকাশিত: ০৭:১০, ৭ জুলাই ২০১৭

ধা  রা  বা  হি  ক ॥ উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

(পূর্ব প্রকাশের পর) খেয়ালি তসবির ১৬০২ সালে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্র্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সম্রাট শাহজাহানের আমল হতে ভারতবর্ষে ওলন্দাজরা অবাধ বাণিজ্যের সুযোগ পেতে থাকে। ব্রিটিশ আর পর্তুগীজদের সঙ্গে পাল্লা দেয়া চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। দিল্লীর সিংহাসন দখলের ষড়যন্ত্র ইউরোপের বণিকরা আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ্য করে যাচ্ছিল। শাহজাদা সুলাইমানের সৈন্যদল যখন বেনারসে গঙ্গার নিকটবর্তী এলাকায় যুদ্ধ প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন সুদূর হল্যান্ডে আমস্টারডাম শহরের মশহুর চিত্রশিল্পী রেমব্রান্ট ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজের ক্যাপ্টেন ভ্যান বাস্তেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। দুইটি কারণে তিনি ক্যাপ্টেনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখছেন। প্রথম কারণ, আফগানিস্তানের খনিতে পাওয়া নতুন রঞ্জক পাথর ‘লাপিস লাজুলি’ সস্তায় তিনি সংগ্রহ করতে পারছেন। আগে জার্মানি, ইতালির ওস্তাদ শিল্পীরা যে নীল রংটা ব্যবহার করতেন তা অনেক পাতলা ছিল। ঘন সাগরের পানির মতো নীল তেল রংয়ের উৎস হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এই নতুন খনিজ পাথরটি আবিষ্কৃত হওয়ার পর ইউরোপজুড়ে চিত্রকলার ভাষাই বদলে গেল। মহান শিল্পী তিশিয়ান, রুবেন্স, কারাভাজ্জিও’দের ক্যানভাসে স্বর্গীয় নীলাকাশের ছোঁয়া এল। সেই সঙ্গে নীল রং লাল, হলুদ আর সাদা রংয়ের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে শীতল আর গীতলতায় ভরে গেল চিত্রপটের সৌন্দর্য। দ্বিতীয় কারণটি আরও গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দুস্থানের মুঘল দরবারের চিত্রমালা দেখার সুযোগ পাওয়া। এর আগেও তিনি দ্বিমাত্রিক ঘরানার বেশ কিছু প্র্রতিকৃতি দেখার সুযোগ পেয়েছেন বন্ধু ভ্যান বাস্তেনের কল্যাণে। সেগুলো ছিলো সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারী চিত্রীদের আঁকা। মুঘল শিল্পী আবুল হাসান, দৌলতের নাম তিনি সেই সূত্রে শুনলেও তার সংগ্রহে সেসব শিল্পীদের কোন কাজ নেই। তিনি আরও শুনেছেন হিন্দুস্থানী মুঘলরা নাকি তেল রংয়ে আঁকা ছবির কদর করে না। কাগজে আর পাতলা কাপড়ে আঁকা ছবির মূল্য তাদের কাছে অনেক। রেমব্রান্ট কিছু ছাপচিত্র ও কালো কালিতে আঁকা কাজ হিন্দুস্থানে পাঠিয়েছিলেন। শুনেছেন হিন্দুস্থানের রাজা-বাদশাহরা পছন্দ করলে একটা ছবির জন্য যে দাম দেবেন তা দিয়ে অনায়াসে একটা ছোটখাটো দুর্গ কিনে ফেলা যাবে। রেমব্রান্ট নড়েচড়ে বসলেন। স্বচ্ছ কাঁচের গ্লাসে রাখা আধ খাওয়া পানীয় জেনেভার পুুরোটাই গলায় ঢেলে দিলেন। বিশ্রী কড়া টক মিষ্টি স্বাদ। শুনেছেন এর চেয়ে স্কটল্যান্ড আর আয়ারল্যান্ডের পার্বত্য এলাকায় গীর্জার পাদ্রীদের বানানো নতুন পানীয়ের স্বাদ নাকি ঢের ভাল। বেশ ভাল দামে এই স্কটিশ ও আইরিশ পানীয় ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি হচ্ছে। স্থানীয়রা তার নতুন নাম দিয়েছে হুইস্কি। বাস্তেন’কে দিয়ে কয়েক বোতল আনিয়ে রাখতে হবে স্বগতভাবে ভাবলেন আমুদে শিল্পী। বাইরে ঘোড়ার গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল। ক্যাপ্টেন ভ্যান বাস্তেন’কে সদর দরজায় অভ্যর্থনা জানালেন রেমব্রান্ট। - মাস্টার রেমব্রান্ট কি আঁকছেন এখন? উৎসুক দৃষ্টিতে জানতে চাইলেন ক্যাপ্টেন। জেনেভারে চুমুক দিয়ে মিটিমিটি হাসতে থাকলেন রেমব্রান্ট। - প্রাচ্যের পৃথিবীর হাল হকিকত নিয়ে একটা নতুন পঞ্জিকা বের হয়েছে, দেখেছেন? - তাই নাকি? অবাক হলেন ক্যাপ্টেন বাস্তেন। - তবে আর বলছি কি? ‘চায়না ইলাস্ট্রাটা’ নামের পুস্তিকা সেটি। দুই কপি আমার হাতে এসেছে। - দেখতে পারি? - অবশ্যই। উঠে গিয়ে স্তূপাকৃতি কাগজের ভাঁজ হতে তুলোট কাগজের একটা ভাঁজ করা পুস্তিকা এনে বাস্তেনের হাতে দিলেন শিল্পী। - হুম ... এটা তো দেখি মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রতিকৃতি? - বিশ্বাস করুন মুঘল শিল্পীরা আমার ভাবনাকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। জেনেভারে আরেকটা বড় চুমুক দিয়ে রেমব্রান্ট খানিকটা উত্তেজিত বোধ করলেন। - বাহ! চমৎকার! শাহজাহানের সঙ্গে তার তিন পুত্রের প্রতিকৃতিও আছে দেখছি। পাতা উল্টিয়ে শ্রাগ করলেন বাস্তেন। - এদের নামগুলো যদিও ভুলে গেছি। - এই শাহজাদাদের মধ্যে দারা শিকো আর শাহ সুজার দরবারে আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। অন্যজনকে আমি ঠিক চিনতে পারছি না। কিন্তু এখানে আসার আগে খবর পেলাম এই দুই ভাই সিংহাসনে বসার জন্য নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু“ করে দিতে পারেন। রেমব্রান্ট এইসব যুদ্ধ বিগ্রহ নিয়ে খুব একটা উৎসাহ দেখালেন না। ক্যাপ্টেন বাস্তেন নিজেও চিত্রকলার সমঝদার। হল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালির অনেক উঠতি শিল্পীর কাজ ভাল দামে তিনি মুঘল দরবারে বিক্রি করেছেন। পশু-পাখি ও নগ্ন নারীর ছবির কদর হিন্দস্থানে বেশি। যদিও শিল্পীদের ছবি বিক্রির দশ ভাগের এক ভাগ দাম দেন তিনি। তবে রেমব্রান্টের সঙ্গে তার সম্পর্কটা আলাদা। রেমব্রান্ট সম্রাট জাহাঙ্গীরের যে প্রতিকৃতিটি বাস্তেন’কে আগ্রহ ভরে দেখাচ্ছিলেন তা ‘খেয়ালি তসবির’ চিত্রমালার একটি চিত্র। সেখানে শিল্পী বিচিত্র জাহাঙ্গীরকে রঙিন পারস্য দেশের গালিচার ওপর বালু ঘড়ির সিংহাসনে বসিয়েছেন। নক্সাবন্দীর ধরনটা ইউরোপের রেনেসাঁ শিল্পীদের অনুসরণে আঁকা। রেমব্রান্টের আগ্রহের সেটাও মূল কারণ। - আমি অবশ্য এসব দেখাতে আপনাকে আমন্ত্রণ জানাইনি। হেঁয়ালি স্বরে বললেন রেমব্রান্ট। - তা তো বুঝতেই পারছি মাস্টার। কালক্ষেপণ না করে দয়া করে আপনার নিজের কাজ কিছু দেখান। রেমব্রান্ট তাঁর বিশাল আঁকাআঁকির কক্ষে নিয়ে গেলেন। কাঠের টেবিলে ছড়িয়ে আছে অজস্র অঙ্কন আর এচিং। বড় ক্যানভাসগুলো কাপড়ে ঢাকা আছে। অঙ্কনের খাতাটি যতœ করে মেলে ধরলেন রেমব্রান্ট। কালো কালিতে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর, শাহজাহান আর দারা শিকোর ছবি হুবহু নকল করে এঁকেছেন কোন মুঘল চিত্রশিল্পীর কাজ দেখে। একটি নয়, অজস্র ড্রয়িং। অবাক হয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলেন ক্যাপ্টেন বাস্তেন। চোখ চকচক করে উঠল তার। এগুলো হিন্দুস্থানের দরবারে নিয়ে যেতে পারলে কেল্লা ফতে! - আরে এগুলো কিছু নয়, এই ক্যানভাসটা দেখুন। এটার নাম দিয়েছি, ‘ইয়াকুব আশীর্বাদ করছেন ইউসুফের পুত্রদের’। টান মেরে বড় একটা ক্যানভাসের ওপর হতে কাপড় সরালেন শিল্পী। - এ যে দেখি ইয়াকুব আর ইউসুফকে মুঘল রাজপুরুষদের মতো পাগড়ি পরিয়ে পুরো মুঘলাই লেবাসে সাজিয়েছেন! আরও এক প্রস্থ অবাক হলেন ক্যাপ্টেন। - শুধু তাই নয় আমার আরেক প্রিয় কাজ ‘আব্রাহাম ও দূতগণ’ কাজটি ছাড়াও অন্য কাজে চরিত্রগুলোকে প্রাচ্য দেশীয় সওদাগর ও হিন্দুস্থানের সাধু পরুষদের মতো লম্বা দাড়িসহ আলখেল্লা পরিয়ে দিয়েছি। - চমৎকার মাস্টার রেমব্রান্ট। একদম নতুন ধারণা। এজন্যই আপনি সবার চেয়ে আলাদা। - আরেকটি কাজ দেখাই আপনাকে। দুই বছর আগে ১৬৫৬ সালে এঁকেছিলাম। রেমব্রান্ট একটা মোড়ানো কাগজ খুলে ধরলেন ক্যাপ্টেন বাস্তেনের সামনে। জাপানি কাগজে কালো কালিতে আঁকা মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের দ্বিমাত্রিক প্রতিকৃতি। জামা-কুর্তা-পাজামা ও মাথায় পাগড়ি পরিহিত অবস্থায় পদাতিক সৈন্যেদের তরবারি হাতে মুক্তারমালা গলায় দিয়ে কোমরে খঞ্জর গুঁজে দীপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়ানো তরুণ সম্রাটের সঙ্গে রেমব্রান্টের চেহারার আশ্চর্য মিল খুঁজে পান ক্যাপ্টেন ভ্যান বাস্তেন। হঠাৎ দেখলে মনে হয় এটা শিল্পীর আত্ম প্রতিকৃতি। কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছিলেন তিনি। - শশশশ ... বলতে পারেন এটি আমার নিজের খেয়ালি তসবির। ইশারায় চোখ টিপে ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে রহস্যমাখা হাসি উপহার দিলেন মাস্টার রেমব্রান্ট। (চলবে)
×