ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নুরুল করিম নাসিম

কবিতাপত্র ‘পোয়েট্রি’

প্রকাশিত: ০৭:০৯, ৭ জুলাই ২০১৭

কবিতাপত্র ‘পোয়েট্রি’

একদিন ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ লন্ডনের একটি পুরনো বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। গেটের ওপর লেখা ‘পোয়েট্রি সোসাইটি।’ অনেকক্ষণ বিস্ময়ে বিমূঢ়ের মতো চেয়ে রইলাম। তারপর কী মনে হতেই বাড়িটির ভেতর ঢুকে পড়লাম দ্রুত। আলোছায়ার অপার্থিক পরিবেশে চোখে ভারি চশমা পরিহিত শীর্র্ণকায় এক মহিলা মুখ বুজে কী যেন লিখে যাচ্ছেন। অসম্ভব আত্মমগ্ন। পৃথিবীর কোথায় কি হচ্ছে, কোনদিকে তার খেয়াল নেই। বার বার মনে হতে লাগল ভুল জায়গায় আসিনি তো? এখান থেকেই কি ‘পোয়েট্রি’ কবিতাপত্র বের হয়? নিজেকেই প্রশ্নগুলো করতে লাগলাম। হঠাৎ ভদ্রমহিলার তন্ময়তা ভাঙল। তিনি বঙ্গসন্তানের দিকে চোখ তুলে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি? ক্যান আই হেল্প ইউ?’ -হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। অফভিয়াসলি। -বলুন তবে? -আমি কি এক কপি ‘পোয়েট্রি’ কবিতাপত্র দেখতে পারি? -নিশ্চয়ই। আপনি আমার সঙ্গে আসুন, তবে। পাশে একটি আলোছায়াময় ঘর। সারাঘরে অসংখ্য বই ভর্তি আলমারি। বেশ কয়েকটি টেবিল-চেয়ারও আছে। তিনি ‘পোয়েট্রি’ কবিতাপত্রের সাম্প্রতিক সংখ্যাটি আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, এখানে বসুন। কী অদ্ভুত মন মাতানো গন্ধ। ঢাকায় থাকতে কবি বেলাল চৌধুরী দেখিয়েছিলেন ‘পোয়েট্রি’ কবিতা পত্রিকাটি। সেটা সত্তর দশকের কথা। আর এখন ১৯৮৬ সাল। মাঝখানে আটাশ বছর কেমন করে যেন হারিয়ে গেছে। হায় জীবন। হায় সময়। সবকিছুই একদিন হারিয়ে যায়। না থাকে জীবন, না থাকে সময়। ‘থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার...।’ সেদিন আমার পকেটে বেশ কিছু পাউন্ড ছিল। লন্ডনের মিডল্যান্ড ব্যাংক থেকে তুলেছিলাম। একেবারে কপর্দকহীন হয়ে ভিখিরির মতো তো আর এদেশে আসিনি। ছ’বছর অন্যদেশে অধ্যাপকের চাকরি করেছি। পেট্রোডলারের দেশে। একাকী মানুষ। দেশে ভাইবোনের জন্য, মায়ের জন্য প্রতিমাসে টাকা পাঠিয়েছি। বাকি টাকা সঞ্চয় করেছি। বিদেশে এসে উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করিনি। ‘পাবে’ পড়ে থাকিনি। নাইট ক্লাবে সময় কাটাইনি। আমার বন্ধু আতিক ছিল আমার গাইড ও শুভাকাক্সক্ষী। সে ছিল আমার পাশে ছায়ার মতো। ‘পোয়েট্রি’ কিনে ফেললাম। মহিলা ‘লন্ডন’ ম্যাগাজিনও এনে আমার চোখের সামনে ধরলেন। তিনি বুঝে ফেলেছেন বইকেনা আমার নেশা। ভাল মার্কেটিং বোঝেন তিনি অনেক কথা হলো তার সঙ্গে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি কবি?’ আমি বললাম, একটু আধটু লেখালেখি করি। তবে এখনো কবি হতে পারিনি।’ তিনি বললেন, চমৎকার বলেছ। কেউ কেউ এক জীবন চলে যায়, তবুও কবি হতে পারে না। কেউ কেউ আবার প্রথম আত্মপ্রকাশে কবি হয়ে যায়।’ আমার’ খুব জানতে ইচ্ছে হলো, কে এই নারী? তিনি কি কবি? আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনার কথা শুনে আমি অভিভূত। আপনি কি কবিতা লেখেন? তিনি চশমার ভেতর দিয়ে তার মায়াবি ক্লান্ত ব্যথিত চোখ দুটো আমার চোখে রাখল। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে গেল পাশের অন্য একটি আধো-আলো আধো অন্ধকার ঘরে। আমি আলমারি খোলার শব্দ পেলাম তিনি কয়েকটি বই হাতে ফিরে এলেন। টেবিলে আমার সামনে তিনটি কবিতার বই রাখলেন : এ্যাট দ্য এ্যান্ড অব দ্য টানেল (অঞ ঞঐঊ ঊঘউ ঙঋ ঞঐঊ ঞটঘঘঊখ) হোয়েন ইউ টোল্ড মী নো (ডঐঊঘ ণঙট ঞঙখউ গঊ ঘঙ) ডাস্ট বিনিথ মাই ফিট (উটঝঞ ইঊঘঊঅঞঐ গণ ঋঊঊঞ)। ভদ্র মহিলার নাম এ্যালেন মনরো। তরুণ কবি। ৩টি কবিতার বই আমাকে দিলেন। এবার দাম নিলেন না বললেন, আসছে শনিবার বিকেলে তুমি এসো। আমি এখানকার কয়েকজন কবির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। সম্ভব হলে তোমার লেখা ইংরেজী কবিতা এনো।’
×