ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

গৌতম দত্ত

পাঠ পর্যালোচনা ॥ অসংবৃত অন্ধকার

প্রকাশিত: ০৭:০৮, ৭ জুলাই ২০১৭

পাঠ পর্যালোচনা ॥ অসংবৃত অন্ধকার

নিরীক্ষাপ্রবণ কবি অনীক মাহমুদ (জন্ম ১৯৫৮) গত শতকের সত্তরের সময় থেকে অদ্যাবধি কাব্যরাজ্যে সদর্পে বিচরণ করে চলেছেন। সে বিচরণে তার চলার পথ একমুখী নয়, বহুমুখী। বিচিত্র কাব্যাঙ্গিকে তিনি বাংলা কবিতার নানাবিধ সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তুলেছেন। কখনও বিষয়ের বৈভবে, কখনও উপস্থাপনের প্রকৌশলে, কখনও ইতিহাস আর কখনও পুরাণ প্রসঙ্গে সেই সব বৈচিত্র্য দৃশ্যমান। তবে পৌরাণিক আবহ নির্মাণ কিংবা পুরাণনির্ভরতা অনীক মাহমুদের কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তার প্রথম কাব্যপ্রেম বড় স্বৈরতন্ত্রী (১৯৯৫) থেকে শুরু করে আঠারোতম কাব্য দিনযাপনের গ্লানি (২০১৫)তে এ পুরাণ প্রসঙ্গ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রসদ যুগিয়েছে। অসংবৃত অন্ধকার (২০১৬) প্রায় পুরোটিই পুরাণনির্ভর। পুরাণের পরিচর্যায় এ কাব্য একেবারে পরিপূর্ণ। সে পূর্ণতায় পুরাণের কাল হয়ে উঠেছে কবির স্বকাল। ফলে স্বকালের নানা অসঙ্গতি শত শতাব্দীপূর্ব সময়কে করে তুলেছে সমসাময়িক। প্রাচীন পুরাণের স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের ইতিহাস এ পৃথিবীর অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যতের পুনর্পাঠে পরিণত হয়েছে এ কাব্যে। কবি দেখিয়েছেন সুদূর অতীতের অসুর কিংবা কবিকল্পনার দানবগোষ্ঠীর মতো একালের মানবরূপী দানবরা কীভাবে বর্তমানের সুখ-শান্তিকে বিনষ্ট করে চলেছে। এ ক্ষেত্রে কবি রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড, ওডিসিসহ প্রাচ্য-মধ্যপ্রাচ্য-পাশ্চাত্য পুরাণ ও ইতিহাসের নানা ঘটনা, চরিত্রকে কবিতায় উপস্থাপন করেছেন প্রতীকী ব্যঞ্জনায়। এ কাব্যের সহৃদয় পাঠকমাত্রই বুঝতে পারেন অনেককাল আগের দানবদের আসুরিক আয়োজন এ যুগেও অবিরত। তবে পুরাণের দানবেরা বিশেষ করে দেবতাবিদ্বেষী আর অনীক মাহমুদের ‘দানবেরা’ মানববিদ্বেষী। পুরাণের দানবেরা স্বর্গে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারে ছিল মত্ত আর দেবতারা ছিলেন বিতারিত অন্যদিকে অনীক মাহমুদের ‘দানবেরা’ গোটা পৃথিবীতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের লালসায় হয়ে উঠেছে বিধ্বংসীÑমানবসভ্যতার জন্য হুমকিস্বরূপ। বোঝা যায় এ অসুররাই ফিরে আসে বার বার নতুন যুগে নতুন মুখোশে। এ কাব্যের প্রতিটি কবিতা পুরাণ বা ইতিহাসের কোন না কোন খল চরিত্রের নামে নামকরণ করা হয়েছে। প্রথম কবিতার শিরোনাম ‘রাবণ’। বহুল পরিচিত এ চরিত্রটি নেয়া হয়েছে রামায়ণ থেকে। রাবণ ব্রহ্মার প্রপৌত্র অর্থাৎ ব্রহ্মার পুত্র পুলস্ত্য আর পুলস্ত্যের পুত্র বিশ্রবার পুত্র রাবণ। সুমালী কন্যা নিকষা তার মা। কঠোর তপস্যায় সিদ্ধি লাভ করে রাবণ হয়ে ওঠে প্রচ- অত্যাচারী। তার সে অত্যাচারে অতিষ্ঠ দেবকুল। এমনকি নারীহরণ করার মতো ক্ষমাহীন অপরাধ করতেও তার দ্বিধা হয়নি। ফলে সীতাকেও বন্দী হতে হয় তার অহঙ্কারের শৃঙ্খলে। এই রাবণের যাবতীয় অপকর্মের কাব্যিক বর্ণনা পাওয়া যায় এ কবিতায়। কিন্তু কবির অভীষ্ট তো শুধু পুরাণাশ্রিত রাবণের অপকীর্তি বর্ণনা করা নয়Ñ রাবণের সেই অপছায়া কীভাবে কবির বর্তমান পৃথিবীর সভ্যতার আলো গ্রাস করেছে তার বাস্তবতা তুলে ধরা। কবি বলেন, আমিও শক্তিশেল সন্ধানের মহরতে আশালতা প্রশস্ত করে লক্ষ্মণের আয়ুর লিলেন শামিয়ানা মেরে ধরে দেখি এ পৃথিবী রাবণাক্ত গলদের ভারপট্টি থেকে মুক্তির নিশানা খোঁজে খোঁজে হার্দ্য কলাক্ষেত্র গরিমার চিরশ্রী টোপর... ‘ত্রিপুর দানব’ কবিতায় তারকাসুরের তিনপুত্র তারকাক্ষ, কমলাক্ষ ও বিদ্যুন্মালীর জন্য তিনটি নগর নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে স্বর্গে স্বর্ণময়পুর, অন্তরীক্ষে রৌপ্যময়পুর আর পৃথিবীতে কৃষ্ণলৌহপুর স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। কবি অনীক মাহমুদ এই তিন দানবের তিন পুর (বসবাসের স্থান) এবং বিশেষ করে পৃথিবীতে দানববাসের ফলে কতটা অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়েছে সে বর্ণনা করেছেন। এ ক্ষেত্রে কবির অভিমত, দানব দাপট সাধনা সম্পুট কেবল জাগায় নগ্ন রসাতল পৃথিবীর শান্তিধামে ত্রিপুর সঙ্গম পুঙ্গবাদি কখনো সখনো মেতেছে অকালে দানবিক আস্ফালনে, মানবিক বোধের দামিনী প্রতিরন্ধ্রে বসিয়েছে মেঘদীপ দুরাচার তা-বের কীট নিশ্চিহ্নের ঘাটে গুটিয়েছে লেজ অসুর দানব পায়নাকো পথ নৈতিকতা ন্যায়ের মশালে পারে না জ্বালাতে সৌহার্দ্যরে আলো... ‘হিরণ্যকশিপু’ কবিতায় পাওয়া যায় ভারতীয় পুরাণের আরেক পরিচিত চরিত্র হিরণ্যকশিপুকে। যাকে অসুর সম্রাট বলা হয়। প্রথম জন্মে এ হিরণ্যকশিপু, দ্বিতীয় জন্মে রাবণ এবং তৃতীয় জন্মে সে শিশুপাল হয়ে জন্মগ্রহণ করে। এই হিরণ্যকশিপু হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য অসুর ও অত্যাচারী। ফলে তারই ঘরে জন্ম নিল তারই মৃত্যুদূত তারই পুত্র প্রহলাদ। প্রহলাদ পিতাকে হত্যা করে পৃথিবীকে করেছিলেন শাপমুক্ত। ‘বৃত্রাসুর’ কবিতায় প্রবল পরাক্রমশালী অসুর বৃৃত্তের প্রচ-তা ও পরিণতি দেখানো হয়েছে। কিন্তু এরই মাঝে কবি তাঁর মূল উদ্দেশ্য উপস্থাপন করেছেন এইভাবে, ঈর্ষাবৃত্ত কখনো বোধের মূলে ঢালতে পারে না সৌহার্দ্যরে জল মাৎসর্য কখনোই কল্যাণের পুষ্পবৃন্তে জমাতে পারে না সুগন্ধি বিলাস আমাদের মর্ত্যলোক আকীর্ণ বৃত্তের দম্ভে লোভ আর লিপ্সার মিশেল ওজারতি ঢেলে দিয়ে কত ট্রয়-হিরোশিমা-নাগাসাকি-বসনিয়া-একাত্তর-উন্মূখর করে দিতে পারে ... এরপরে এ কাব্যে পরপর তেরোটি সনেট লেখা হয়েছে। সনেটগুলোর শিরোনামও পুরাণ কিংবা ইতিহাসের কোন না কোন অশুভশক্তির নামে লেখা হয়েছে। সনেটগুলো ১৪ লাইনের এবং অষ্টক ও সটকের নিয়মে বিন্যস্ত। অষ্টকের প্রবর্তনা ও সটকের পরিণতিতে সনেটগুলো শুধু এ কাব্যের নয়, বাংলা কবিতার অন্যতম অলঙ্কার হয়ে থাকবে। সনেটগুলো ‘মধুকৈটভ’, ‘ধেনুকাসুর’, ‘হিরণ্যাক্ষ’, ‘হয়গ্রীব’, ‘কবন্ধ’, ‘প্রলম্বাসুর’, ‘মহিষাসুর’, ‘আলোইদা’, ‘একিদনা’, ‘মীরজাফর’, ‘হালাকু খাঁ’, ‘রাহু’ ও ‘বিক্ষুব্ধ দানব’ শিরোনামে লেখা। এসব শিরোনামে আমরা বুঝতে পারি চরিত্রগুলো অসুরশক্তির প্রতীক কিংবা প্রতিনিধি। যেমন মধু ও কৈটভ দুই দানব। তারা বিষ্ণুর কর্ণমূল থেকে সৃষ্ট। কিন্তু তারা দু’জনেই ধাবমান হয়েছিল ব্রহ্মার উৎসাদনে। কবি এই দুই দানবকে তুলনা করেছেন ইতিহাসের দুই আলোচিত রাজপুরুষ হিটলার ও মুসোলিনীর সঙ্গে। ধেনুকাসুর বৃন্দাবনের রাক্ষস। সে নিহত হয়েছিল কৃষ্ণভ্রাতা বলরামের দ্বারা। হিরণ্যাক্ষ পুরাণের আরেক অসুর হিরণ্যকাশিপুর ছোট ভাই। ব্রহ্মার বরে সে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। স্বর্গ ও পৃথিবী জয় করে সে প্রায় অজেয় হয়ে ওঠে। বিষ্ণুর হাতে তাকেও জীবন দিতে হয়েছে। এভাবেই হাজার হাজার বছরের পুরাণাশ্রিত চরিত্রগুলো অনীক মাহমুদের সুনিপুণ কাব্যতুলিতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সনেটগুলোর অষ্টকে প্রতিটি চরিত্রের অতীত কার্যাবলীর বর্ণনা দেয়া হয়েছে। তেমনি সটকে এসে কবি দেখিয়েছেন এইসব চরিত্রের পাপকর্মের বোঝা বর্তমান পৃথিবীকেও করে তুলেছে ভারবাহী আর বিষণœ। দৃষ্টান্ত হিসেবে ‘মীরজাফর’ কবিতাটিকে নেয়া যেতে পারে। এ কবিতার অষ্টকের প্রথম দুই লাইনে কবি বলেছেন, জাফরাগঞ্জের ইটে কুষ্ঠের দুর্গন্ধ মেখে সে যে দুষ্টুগ্রহ এখনও কী তুমুল ঘৃণায় মানুষের লানতের তীব্র শাপ কবি এ সনেটের সটকের শেষ দুই লাইনে বলছেন, মীরের কলঙ্ক টিপ পামর পলাশী খোঁড়ে ঘাতক জাফর মানবে দানব স্থিতি এভাবে জ্বালিয়ে যাবে অনাস্থা হাপর। মীরজাফর তার প্রভু বা নবাবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে খুব অল্প সময়ের জন্য লাভবান হয়েছিল কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সময়ের শেষ সীমা অবধি। সে আজ সমগ্র মানবজাতির জন্যই লজ্জা। প্রকৃতিগতভাবেই সে শাস্তি পেয়েছিল তার কুকর্মের। অন্যদিকে ‘বৃকাসুর’ নামক কবিতায় আমরা দেখতে পাই এমনই এক অকৃতজ্ঞকে। বৃকাসুর তার নাম। বৃকাসুর নারদের সহায়তায় স্বল্পশ্রমে শিবের আরাধনায় সিদ্ধি লাভ করে। শিব তাকে বর দান করেন যে, বৃকাসুর যার মাথায় হাত রাখবে সেই মৃত্যুবরণ করবে। এই বর পেয়ে বৃকাসুর সর্বপ্রথম হাতটি রাখতে চেয়েছে বরদাতা শিবের মাথাতেই। বরদাতা শিবের স্ত্রী গৌরীকে লাভ করার জন্যই তার এ ছলনা। আপন অব্যর্থ আশীর্বাদের ক্ষমতা সম্পর্কে জানতেন শিব। ফলে বাধ্য হয়ে আশ্রয় নেন নারায়ণের। নারায়ণ কৌশলে বৃকাসুরের হাতটি বৃকাসুরের মাথাতেই রাখার ব্যবস্থা করেন। ফলে বৃকাসুর তার কর্মফল ভোগ করেছে সঙ্গে সঙ্গে। অকৃতজ্ঞতার পরিণাম এমনই। কিন্তু কবি অনীক মাহমুদ পুরাণের এ ঘটনাটিকে সমকালের আলপনায় অঙ্কন করেছেন এক নতুন দৃষ্টিতে, আমাদের যাজকবৃত্তি-যজমানি কতটা উদগ্র-লোভাকীর্ণ হতে পারে সেটাও দেখেছি বাগদাদ-তিকরিত-কাবুল-কান্দাহারে দেখেছি বিনির্মিত দানবের প্রতীচ্য সন্স টুইন টাওয়ারে... ... এ কাব্যের ‘বৃন্দাসুর’ শিরোনামে ছয়টি কবিতায় কবি হাজির করেছেন ইতিহাস ও পুরাণের ছয়টি চরিত্রকে। আবু জেহেল, শিশুপাল, ইয়াগো, বিভীষণ, মন্থরা ও লীলাসুর এই ছয়টি চরিত্রকে কবি পাঠকের সামনে এনে তাদের কর্মের কারণ ও ফলাফল উপস্থাপন করেছেন। এক্ষেত্রে কবি কখনও তাদের সরাসরি প্রশ্ন করেছেন আবার কখনও তাদের ভেতরের কদর্যতাকে তুলে ধরেছেন আপন উপস্থাপনার কাব্যদক্ষতায়। কবি আবু জেহেলকে সরাসরি বলেছেন, ঘনায়মান জ্ঞাতি শত্রুতায় দুষ্টুক্ষত সেজে হে আবু জেহেল নগ্ন হাতে ছুড়ে দিলে তাচ্ছিল্যের নুড়ি মহামানবের দিকে, আবার এ ধারার পঞ্চম কবিতায় মন্থরার উদ্দেশে বলেছেন, দিশে দিশে বক্রদেহী বুড়ির প্রেতাত্মা আজো ঢালো বিষ কুমন্ত্রণা নাগযুদ্ধ কীভাবে রক্তের চাদরে শানায় উষ্ণীষ। ‘বিভীষণ’ নামের এ ধারার চতুর্থ কবিতাটিতে অকৃতজ্ঞতার প্রতি কবির আক্রোশ ও ক্ষোভ আরও সজীব হয়ে দেখা দেয়। কবি যখন বলেন, ‘মতিহারে ডানা ঝাড়ে অশুভ এ্যালবাট্রস’ তখন তার আপন আশঙ্কা ও বেদনার নীলাভাস ভেসে ওঠে পাঠকমনে। খুব কাছের মানুষগুলো কিংবা আপন প্রজ্ঞায় পালন করা মানুষগুলো যখন বিভীষণের মতোই তারই দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তখন সে বেদনা আরও চতুর্গুণ হয়ে ফিরে আসে তারই হৃদয়ে। কিন্তু কবি এ কবিতার শেষে যখন বলেন, রাবণের ঘরের সরমা-বিভীষণ কুলি ফেলে রামের শিবিরে আনলাকি অমৃতস্য শুধু শুধু থার্টিনের শরে বিদ্ধ হয় একা... তখন এ বেদনা বা অশুভ আশঙ্কা শুধু কবির একার থাকে না, তা হয়ে ওঠে সমগ্র মানব সভ্যতার। তবে শুধু বিষয়ে নয়Ñএ ধারার আঙ্গিকেও এক নতুন সুর শোনা যায়। কবি এ ধারার ছয়টি কবিতাকে বেধেছেন ১৩ লাইনের ফ্রেমে। অর্থাৎ প্রতিটি কবিতা ১৩ লাইনের এবং এই ১৩ লাইনকে কবি সনেটের মতো ভাগ করেননি, রেখেছেন অবিভক্ত। কিন্তু কবিতাগুলো মনোযোগ সহকারে পড়লে বোঝা যায় কবিতার শেষাংশ হয়ে উঠেছে সমকালীন এবং সর্বকালীন। কবিতাগুলো অকারণ উপস্থাপনায় ভারি হয়ে ওঠেনি। এক্ষেত্রে কাব্যকৌশলটি হচ্ছে সরাসরি বিষয়বস্তুতে প্রবেশ করে অভীষ্ট বক্তব্যকে উপস্থাপন করা। এ ধরনের কবিতায় বক্তব্যকে ঠিক রেখে ব্যঞ্জনা দান করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। কবি অনীক মাহমুদ সে কঠিন কাজটি করেছেন তার কাব্যকৌশলের চমোৎকর্ষে। এমনই উৎকর্ষের আরেকটি প্রমাণ পাওয়া যায় এ কাব্যের শেষাংশ ‘অসংবৃত অন্ধকার : উপদ্রুত তপোবন’-এ। এ অংশেও ছয়টি কবিতা স্থান পেয়েছে। তবে এগুলো নাট্যকবিতা। সংলাপের আঙ্গিকে লেখা এর প্রতিটি কবিতা আলাদা আবার এক সূত্রে গাথা। অনেকটা ফুলের মালার মতো। ফুলগুলো প্রতিটিই আলাদা কিন্তু সুতার কারণে তারা মালায় স্থান পায়। এ অংশে তেমনই সুতার কাজটি করেছেন ইন্দ্রসারথি মাতলি ও মহাকবি কালিদাস। ফুল হিসেবে বলা যায় পুরাণ ও ইতিহাসের ছয়টি খল চরিত্রকে। এ চরিত্রগুলো হলো রাবণভ্রাতা বিভীষণ, কৌরববীর দুর্যোধন, দুর্যোধনের মামা গান্ধাররাজ শকুনি, অহঙ্কারী ফেরাউন, দুর্বিনীত নমরুদ ও সাম্রাজ্যবাদী হিটলার। এরা প্রত্যেকেই এসে উপস্থিত হয়েছে কালিদাসের কন্বমুণির আশ্রমে। যে আশ্রমের শান্ত-¯িœগ্ধ এক প্রশান্তিময় পরিবেশে শকুন্তলার প্রেমে পড়েছিলেন রাজা দুষ্মন্ত। বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন ধরনের আসুরিক কাজে লিপ্ত থেকে এরা যেসব দুষ্কর্ম করেছে কবি তাদের এ আশ্রমের এক স্থানে এনে তারই সত্যভাষণ উপস্থাপন করেছেন। এই সত্যভাষণে ধরা পড়েছে তাদের প্রত্যেকের অস্বস্তি আর সেই সঙ্গে সময়ের মেলবন্ধন। সে বন্ধনে কালের গ-ি স্বকালের দ্বারা নির্বাচিত হয়েছে, নির্ধারিত হয়েছে ইতিহাসের পুনর্পাঠ আর বিনির্মিত হয়েছে পুরাণ প্রসঙ্গ। এতসব কারুকার্য, এসবের পেছনে মনে হয় কবির অন্যতম দুটি উদ্দেশ্য কাজ করেছে। যার একটি হলো, তিনি বলতে চেয়েছেন অসুরের অশুভ উৎপীড়ন শেষ হয়নি, আজও তারা মানবকল্যাণের পথে পথে বাধা সৃষ্টি করে চলেছে। অন্যটি হলো মানুষ তার মনুষ্যত্বের মহিমা দিয়ে সে সব বাধা দূর করে এগিয়ে যাবেÑ প্রতিষ্ঠিত করবে এক কল্যাণময়ী বিশ্ব।
×