ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে...

প্রকাশিত: ০৭:০৮, ৭ জুলাই ২০১৭

মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে...

একজন মানুষ নৌকা বেয়ে জীবন চালায়। ঝড়-জল-বন্যা তাকে অসহায় করে, কিন্তু মানুষটা আবারও তার জীবন সংগ্রাম ফিরে পায়। প্রকৃতির এই খেয়ালখুশি মেনে নেয় মানুষ। মানুষের খেয়াল খুশিতে যদি কোন জীবনের গতি বাধাগ্রস্ত হয়, তা মেনে নেয়ার মতো না হলেও সবলের দাপট মেনে নিতে হয়। তবে মাঝে মাঝে প্রকৃতির লীলাখেলা বোঝা দায় হয়ে পড়ে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের। জন্ম নিলে পৃথিবীর ছেড়ে চলে যেতে হবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কিছু কিছু প্রয়াণ মন থেকে মেনে নেয়া যায় না। ড. করুণাময় গোস্বামী যার গবেষণা ছিল অস্থিমজ্জায় তাই ঘরও ছেড়েছেন দু’বার। বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীত অঙ্গনের দুই কাণ্ডারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর নজরুল ইসলামকে নিয়ে কাজ করে গেছেন আমৃত্যু। সঙ্গীতের গভীরতাকে তিনি বুকে ধারণ করতে পেরেছিলেন। তিনি ছিলেন প্রেরণাদায়ী পুরুষ। জাতীয় কবি কাজী নজরুলকে তিনি নানাভাবে আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন। গত ৩০ জুন শুক্রবার দিবাগত রাতে একুশে পদকপ্রাপ্ত দেশের কৃতী সন্তান করুণাময় গোস্বামী চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তিনি ছিলেন একজন প্রাণবন্ত, সদা কর্মব্যস্ত ও চিরসবুজ মানুষ। ইংরেজী সাহিত্যের অধ্যাপক হয়েও তার কর্মপরিধির বিস্তার একাধারে বিস্ময়কর ও ঈর্ষণীয়। করুণাময় গোস্বামী আমার মায়ের শিক্ষক ছিলেন বিধায় মামা বলে ডাকতাম। ছোটবেলায় নারায়ণগঞ্জে বেড়াতে গেলেই মামার বাসায় একবার না একবার যেতাম। এখনও মনে পরে প্রথম যেদিন যাই মায়ের সঙ্গে সেদিন মামা তার লেখা একটি বই দিয়ে বলেছিলেন পড়িস। খুব কম কথা বলতেন, ধীরস্থির বাসায় গেলেই দেখতাম লেখালেখি নিয়ে সদা ব্যস্ত। জ্ঞানান্বেষা ও শিক্ষাব্রতী এই মানুষটি আজীবন শিক্ষকতা করেছেন। কোন হীনমানসিকতা তাকে কখনও আবিষ্ট করেনি। সবচেয়ে বড় গুণ তিনি নীরবে কাজ করে যেতেন। প্রচার-প্রচারণা নিয়ে ভাবতেন না। ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে প্রাপ্তির বিপক্ষে দাঁড়াতেন। সত্য মুখের ওপর বলার একটা অদম্য সাহস ছিল তার। অর্থপূর্ণ জীবন আর অর্থে পূর্ণ জীবন এক নয়। অর্থপূর্ণ জীবনের চেয়ে অর্থে পূর্ণ জীবনের প্রতি আমাদের অধিক আগ্রহ। সেই আগ্রহ সীমা-পরিসীমা মেনে চলে না। তা সমষ্টির জন্য অনর্থ আমদানি করলেও ভ্রƒক্ষেপ নেই। কিন্তু মামা (ড. করুণাময় গোস্বামী) সব সময় অর্থপূর্ণ জীবন চেয়েছেন তাই অর্থের পেছনে না ছুটে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে। অধ্যাপনার পাশাপাশি সঙ্গীত ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে রেখেছেন আমৃত্যু। মামা (ড. করুণাময় গোস্বামী) প্রায় সময় বলতেন ‘রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মধ্যে কে বড়, এই নিয়ে অনেকে দেখি বিতর্ক করেন। কখনই কোন কবি নিজেকে দাবি করেন না তিনি বড়। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মধ্যে ব্যক্তিগত সখ্যের জায়গাটা ছিল অনেক নিবিড় ও আন্তরিক। শ্রদ্ধা ও স্নেহের সম্পর্ক ছিল তাদের। দু’জনের অনেক কবিতায়, চিঠিতে পরস্পরের কথা উল্লেখ আছে। অনেক সুন্দর গল্প আছে তাদের নিয়ে। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নজরুলের সাম্যবাদী, অসাম্প্রদায়িক চেতনার অনুরণন সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার কথা বলতেন করুণাময় গোস্বামী। ‘শ্যামাসঙ্গীত লিখেছেন বলে তাকে অনেকে হিন্দুদের কবি বলেন। হামদ-নাত লিখেছেন বলে তাকে কেউ কেউ মুসলমানদের কবি বলেন। সব সঙ্কীর্ণতা কাটিয়ে তিনি ছিলেন মানুষের কবি। তিনি শুধু তার লেখায় নয়, নিজের জীবনেও সেটা বাস্তবায়িত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত গারল্যান্ড এনসাইক্লোপিডিয়া অব ওয়ার্ল্ড মিউজিকে ‘পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের গান’ শিরোনামে যে সুদীর্ঘ নিবন্ধ, সেটি তারই রচনা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার যাবতীয় বইপত্র ও পাণ্ডুলিপি লুটপাট ও ধ্বংস হয়ে যায়। যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে নতুন উদ্যমে শূন্য থেকে কাজ শুরু করেন তিনি। তার অসীম ধৈর্যের কারণে সঙ্গীত কোষ আলোর মুখ দেখে ১৯৮৫ সালে। সঙ্গীতপ্রাণ এই মানুষটি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত নিয়ে লিখেছেন রবীন্দ্রনাট্য সঙ্গীত ও রবীন্দ্র গানের খ্যাতি। সমভাবে লিখেছেন- ‘প্রসঙ্গ নজরুল গীতি’ ও ‘নজরুল সঙ্গীতের জনপ্রিয়তার স্বরূপ সন্ধান।’ বড় দীর্ঘ নয় এ জীবন- তবু সীমিত হলে সীমাবদ্ধ সবুজে তিনি যতটা পেরেছেন ফুল ও ফসল ফলিয়েছেন তিনি। ১৯৬৪ সালে তিনি সরকারী কলেজে প্রভাষক হিসেবে শিক্ষকতায় যোগদান করেন এবং ২০০১ সালে অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। জীবনের শেষদিকে বেসরকারী কেমব্রিয়ান কলেজে অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি ২০০৮ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক লাভ করেন।
×