ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

লিটন মহন্ত

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ অনন্য সঙ্গীতজ্ঞ করুণাময় গোস্বামী

প্রকাশিত: ০৭:০৭, ৭ জুলাই ২০১৭

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ অনন্য সঙ্গীতজ্ঞ করুণাময় গোস্বামী

সঙ্গীত শুধু শোনার বিষয় নয় উপলব্ধির কিংবা জ্ঞানের বিষয়। সঙ্গীতের ভেতর যে সুর থাকে, সেই সুরের মধ্যে অনেক কঠিন তথ্য এবং তত্ত্ব লুকিয়ে থাকে, সেই জ্ঞান আহরণ করার জন্য প্রয়োজন অন্য রকম হৃদয় এবং মানসিক প্রস্তুতি; ভাবনায় কিংবা চিন্তার ভেতরে তৈরি হয় তার গাঢ় ছায়াপাত। এমনিভাবে সভ্যতার শুরু থেকে অনেকে সঙ্গীতের আবাহনের মধ্য দিয়ে নিজের আত্মপরিচয় এবং বিশ্ববৈচিত্র্যের জগতে নিজের ভাবনায় জারিত হয়েছেন এবং খুঁজেছেন মানব মুক্তির পথ। বাংলা সাহিত্যের দুই দিক পাল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলাম গান ও সুর লিখতে পেরেছিলেন বলেই তারা বাঙালীর হৃদয়ের এত কাছাকাছি আসতে পেরেছিলেন, যেমনিভাবে আমাদের সাম্প্রতিক ভাবনার জগতে নিরন্তর বাস করছেন লালন সাঁই; এ আজ সত্যি গবেষণার বিষয়। ড. করুণাময় গোস্বামী এমনি এক সত্তা ছিলেন, যিনি সুর ও সঙ্গীতের সেই তাৎপর্য এবং মহিমা জীবনভর গবেষণার মাধ্যমে উপলব্ধি করে গেছেন এবং লিখেছেন বিস্তর, এই জায়গাটায় উনি স্বতন্ত্র এবং অদ্বিতীয়। শুধু তাই নয় সঙ্গীত নিয়ে তার লেখালেখির মাধ্যমে গবেষণার একটি অত্যন্ত মৌলিক বিষয় বাঙালীর সামনে চলে এসেছে, যা বিভিন্নভাবে কয়েক দশক ধরে অনুপ্রাণিত করে এসেছে আমাদের সঙ্গীত জ্ঞান। ড. করুণাময় গোস্বামী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৮ সালে ‘বাংলা কাব্য রীতির ধারায় কাজী নজরুল ইসলামের স্থান’ শীর্ষক অভিসন্ধর্ভ রচনা ও গবেষণার মাধ্যমে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি মূলত পেশায় একজন অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ ছিলেন কিন্তু তার সমস্ত চেতনা জুড়ে ছিল সঙ্গীতের ভাব, ভাষা এবং সুরের মূর্ছনা। তিনি ছাত্র অবস্থা থেকেই লেখালেখি করতেন এবং সঙ্গীতচর্চা এবং সঙ্গীত গবেষণা শুরু করেছিলেন। ড. করুণাময় গোস্বামী সমস্ত ছাত্রজীবন ধরেই গানের তামিল নিয়েছিলেন এবং ষাটের দশকের শেষ ভাগে পাকিস্তান রেডিও তে তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং নজরুল গীতিশিল্পী হিসেবে গান গাওয়া শুরু করেন। ষাটের দশকের প্রথম দিকে উনিশ শ’ চৌষট্টি সালে নারায়ণগঞ্জে তরুণ লেখক, কবি, শিল্পী ‘সাহিত্য বিতান’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন। সেই সময় ড. করুণাময় গোস্বামী সেই সংগঠনে যোগ দেন এবং তার সাহিত্য চর্চা এবং লেখালেখির গতি বৃদ্ধি পায়। আমরা খুব সচেতনভাবে লক্ষ্য করি যে, ড. করুণাময় গোস্বামী এই রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং নজরুল গীতির ওপর গবেষণার মাধ্যমে এক নতুন চেতনা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন, যে চেতনার পাদ প্রদীপের আলোয় আমরা নতুনভাবে এবং নতুন বিস্ময়ে রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলকে অবলম্বন করি। সম্ভবত দুই বাংলায় তিনিই এক মাত্র বাঙালী যিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতের ওপর সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পুস্তক রচনা করেছেন এবং সমাদৃত হয়েছেন। প্রতিটি সুর ও সঙ্গীতের একটা নিজস্ব ভাব এবং সৌন্দর্য থাকে, থাকে সৃষ্টির ইতিহাস; সেই বিষয়গুলো বিশ্লেষণে তিনি অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তিনি শুধু দুই বাংলায় সমাদৃত ছিলেন না, উপমহাদেশে তার এই বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের জন্য বিভিন্ন সময় সংবর্ধিত হয়েছেন। ড. করুণাময় গোস্বামী শুধু সঙ্গীত গবেষক নন, তিনি ছিলেন একাধারে শিক্ষাবিদ, অনুবাদক, সম্পাদক, ঔপন্যাসিক, কলামিস্ট এবং রবীন্দ্র-নজরুল গবেষক। তিনি রবীন্দ্র ও নজরুলের ওপর অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেছেন, যা তাকে অনন্য পরিচয় দান করে। তার লেখনীর বিষয় ছিল বহুমাত্রিক; সমাজ-সংস্কৃতি-সাহিত্য ও ভাষা, তিনি প্রবন্ধের পাশাপাশি ২০১৫ সালে ভারত ভাগের ইতিহাস এবং প্রেক্ষাপটের ওপর রচনা করেন ‘ভারত ভাগের অশ্রুকণা’ নামের উপন্যাস। ‘লাহোরের রহিম খের’ তার শেষ উপন্যাস গত মে মাসে প্রকাশিত হয় এবং এর মোড়ক উন্মোচন এবং আলোচনা অনুষ্ঠান হয় বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান মিলনায়তনে; এই উপন্যাসটিও ভারতবর্ষ ভাগের প্রেক্ষাপটে লেখা এক অনন্য ইতিহাস, যা নতুন প্রজন্মকে ভারত ভাগের ইতিহাস সম্পর্কে নতুন এক অভিজ্ঞতার সঞ্চার ঘটাবে। তার অনুবাদ কর্মের উজ্জ্বল স্বাক্ষর হলো ‘ভারতীয় সংস্কৃতিতে ইসলামের প্রভাব।’ তিনি ১৯৭৫ সালের দিকে প্রথম আফ্রিকান বিভিন্ন গল্প কবিতা ও তাদের সাহিত্যকর্ম অনুবাদ করে আমাদের ভাবনায় আফ্রিকান দর্শনের অনুপ্রবেশ ঘটান এবং পরিচয় করিয়ে দেন। ড. করুণাময় গোস্বামীর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৬৮টি; যা শুধু সংখ্যায় নয়, লেখনী ও তত্ত্বগত মূল্যায়নে অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। তার সাত বছর ধরে গবেষণার পর বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘সঙ্গীত কোষ’ কয়েক হাজার পৃষ্ঠার গ্রন্থটি সঙ্গীত অভিধান হিসেবে দুই বাংলায় বহুল আলোচিত এবং সমাদৃত। ড. করুণাময় গোস্বামীর রচিত ‘দি আর্ট অব ট্যাগর সং’ গ্রন্থটি বিশ্বের প্রায় এক হাজার দুই শত লাইব্রেরিতে স্থান পেয়েছে। এই একটি কাজের মাধ্যমে তিনি সমগ্র বাঙালী জাতির মাথা বিশ্বের চিন্তাশীল ও রবীন্দ্রভক্ত সকল মানুষের কাছে সমুন্নত করেছেন। রবীন্দ্রনাথকে নতুনভাবে উপস্থাপনের এই গুরু দায়িত্ব তিনি নীরবে করে গেছেন এবং তার এই অবদান অনস্বীকার্যভাবে আমাদের রাবীন্দ্রিক ভাবনা বিশ্বে বহুমাত্রিক রোশনাই তৈরি করবে। তার অসমাপ্ত বইয়ের সংখ্যা পাঁচটি। তার দ্বিতীয় বই ‘নজরুল সঙ্গীত প্রসঙ্গ’ প্রকাশ পায় ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমি থেকে, সেই নজরুলের গানের ওপর গবেষণাধর্মী বই তেমন প্রকাশ পায়নি, যেখানে তিনি তার নজরুল সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা তুলে ধরেন। তিনি বাংলা লেখনীর পাশাপাশি ইংরেজীতেও পারদর্শী ছিলেন এবং নজরুলকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করার জন্য ‘নজরুল জীবনী’ তিনি ইংরেজীতে লেখেন। তিনি গবেষণাধর্মী লেখার পাশাপাশি রম্য সাহিত্য রচনা করেন এবং শিশুসাহিত্যও লিখেছেন। জীবনের শুরু থেকেই তিনি বিশ্বকবির দ্বারা ভীষণ ভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন এবং পরবর্তীতে নজরুলের গান ও গানের ভাবনা তাকে প্রবলভাবে আন্দোলিত করে। তার রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো; রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিক্রমা, রবীন্দ্র সঙ্গীত স্বরলিপি, রবীন্দ্র নাট্যগীতি, রবীন্দ্রনাথ হ্যান্টিংটন ও ভারত ভাগ, রবীন্দ্রনাথের প্যালেস্টাইন ভাবনা ও অন্যান্য, রবীন্দ্রনাথের গায়ক খ্যাতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত কলা প্রভৃতি। অন্যদিকে তিনি রচনা করেছেন; বাংলা গানের বিবর্তন, বাংলাগানের স্বরলিপি ইতিহাস, বুদ্ধদেব বসু ও অন্যান্য, নজরুলগীতি প্রসঙ্গ, এবং আব্বাস উদ্দীন ও অতুল প্রসাদের গান। এই কৃতিমান বাঙালী ১৯৪২ সালের ১১ মার্চ ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলার গোসাই কান্দুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে অধ্যাপনা করেছেন এবং বিভিন্ন সরকারী কলেজে কর্মরত ছিলেন। ড. করুণাময় গোস্বামী নারায়ণগঞ্জ মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে সরকারী চাকরি থেকে অবসরে যান। তিনি একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পদকসহ অসংখ্য পদক ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তিনি তার জীবনের শেষের দিকে ৩৬টি বাংলা গানের অনুবাদ করতে চেয়েছিলেন। ড. করুণাময় গোস্বামী গত ৩০ জুন আমাদের ছেড়ে মহাশূন্যের পথে পাড়ি দেন। তার মৃত্যুতে দেশের প্রধানমন্ত্রীসহ সকল গুণী মানুষ শোক প্রকাশ করেন। তার মহাপ্রয়াণে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন ‘বাংলা সঙ্গীতের একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন ড. করুণাময় গোস্বামী, সঙ্গীতের ইতিহাস ও এর ভাবসৌন্দর্য বিশ্লেষণে তিনি বিশেষ ভূমিকা রেখে গেছেন।’ তিনি মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত কেমব্রিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্টাডি সেন্টার ও কেমব্রিয়ান কালচারাল একাডেমির অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি আজীবন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন এবং ছিলেন মানবতাবাদী ও সমাজ সচেতন একজন মানুষ। তার প্রতিটি সৃষ্টিশীল কাজে এক নতুন ঘরানার সৃষ্টি হয়েছিল, যেখানে সঙ্গীত এক অন্য মাত্রায় আমাদের বোধকে শাণিত করেছে। ড. করুণাময় গোস্বামী সমস্ত জীবন দেশের মানুষকে শিল্প-সাংস্কৃতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন সংগঠন তৈরিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন; কারণ দেশের মানুষ মানবতাবাদী ও সাংস্কৃতিক না হলে উন্নত সমাজ ব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব নয়, অসাম্প্রদায়িত এই চেতনা প্রবাহ সমুন্নত রাখার পেছনে শিল্পের ও সাহিত্যের যে অবদান তিনি তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন। তিনি সব মানুষের কাছে সমানভাবে জনপ্রিয় ছিলেন, যা তার মৃত্যু পরবর্তী দেশবরেণ্য গুণীজনদের বক্তব্যে প্রতীয়মান হয়। তিনি মূলত ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন কিন্তু বাংলার সাহিত্য ও শিল্প এবং রবীন্দ্র ও নজরুল ছিল তার প্রধান আরাধ্য। তিনি যখন যেখানে চাকরির সুবাদে গেছেন তখন সেখানে একটা সাংস্কৃতিক চেতনা বোধ তৈরির জন্য নিবেদিত হয়ে কাজ করে গেছেন। তিনি শুধু নজরুলগীতি ও রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়েই গবেষণা করেননি, তার গবেষণায় উঠে এসেছে বাংলা গানের বিচিত্র ঘরানার রাগ সঙ্গীতেও। এই মহান প্রচারবিমুখ ব্যক্তিত্ব আজ আমাদের মাঝে নেই কিন্তু রয়েছে তার চেতনা, সৃষ্টি কর্ম এবং অগণিত পাঠক, যার মাধ্যমে তিনি চিরদিন আমাদের হৃদয়ে চিরজাগরুক হয়ে থাকবেন। নতুন প্রজন্ম যদি বাংলা গান নিয়ে গবেষণা বা চর্চা করতে চায়, ড. করুণাময় গোস্বামীকে অবধারিত ভাবে পাঠ করতে হবে। সঙ্গীত নিয়ে গবেষণা মূলত দেশে তেমন একটা হয় না, সেই ক্ষেত্রটি যে কতটা সমৃদ্ধ সে বিষয়গুলো আজ তার সৃষ্টির মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি। তার এই মৃত্যুতে সাহিত্যের এই সঙ্কটময় জায়গাটি আবার ফাঁকা হয়ে গেল, সঙ্গীত গবেষণার ক্ষেত্রটিতে তিনি ছিলেন মুকুটহীন সম্রাট। ড. করুণাময় গোস্বামীর প্রতি রইল আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।
×