ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মোঃ সাখাওয়াত হোসেন

কারাগারে নারীর ঈদ

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ৭ জুলাই ২০১৭

কারাগারে নারীর ঈদ

কারাগার নামক শব্দটি শুনলেই মনের ভেতর ভীতিকর, ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। নির্দিষ্ট গ-ির ভেতর জীবনাচরণ, পরাধীন জীবন,আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নজরে থাকার অপর নামই কারাবাস। কারাবাসের সংস্কৃতি, পরিচালনা ইত্যাদির মধ্যেই কেমন যেন একটা লুক্কায়িত বিষয় রয়েছে যার পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষ ভয়ের মধ্যে থাকে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে কারাগার মানে সংশোধনাগার। অপরাধীকে উপর্যুক্ত মানুষ হিসেবে পরিণত করে সমাজে পুনর্বাসিত করা হয় কারাগারের অভ্যন্তরীন কর্মকা-ের মাধ্যমেই। মূল লক্ষ্য বাস্তবায়িত হলে সমাজে অপরাধীর সংখ্যা ক্রমশই কমে আসত। কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। ক্রমান্বয়ে উদ্বেগজনক হারে পুন:অপরাধীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। কারাগার ব্যবস্থা সংস্কার, আধুনিকায়ন ও সেবার মানসিকতাই একমাত্র কয়েদিদের সামাজিকীকরণ ও পুনর্বাসনে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে। কারাগারের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্দেশ্য হলো: ব্যক্তি নিজস্ব কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে সমাজের উপযোগী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলবে এবং এ ক্ষেত্রে কারাগার সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে থাকে। বর্তমানে উল্টো চিত্র দেখা যায়, নির্যাতনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কারাগারকে দেখা হয়। সংশোধনের পরিবর্তে দাগী আসামিদের সঙ্গে মিশে কারাগার থেকে বের হওয়ার পর পূর্বের ন্যায় অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে অভিযুক্ত মানুষগুলো। তবে সংশোধনাগার হিসেবে এখনও বাংলাদেশে কারাগারগুলো প্রতিষ্ঠা পায়নি। সংশোধনাগার হিসেবে তৈরি হওয়ার জন্য যে সংস্কৃতি, মনন ও দূরদৃষ্টির প্রয়োজন তার অভাব দেখা যায় স্পষ্টতই। সম্প্রতি বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রধান বিচারপতির একটি উদ্ধৃতির দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বোঝা যায়, কারাগারে নারীদের কিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি বলেন: বন্দী নারীদের যৌন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, তিনি আরও সুনির্দিষ্ট করে উল্লেখ করেন ঢাকা, সিলেট এবং গাজীপুরের কারাগারে নারীরা যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এ রকম দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি যখন এমন অভিযোগ তুলে ধরেন কারাগারের বিরুদ্ধে তাহলে বুঝতে হবে বিষয়টি অবশ্যই আমলে নেয়ার মতোই। ওনার কাছে হয়ত যথেষ্ট প্রমাণাদি আছে যার ভিত্তিতে তিনি বক্তব্যটি তুলে ধরেছেন অথবা দীর্ঘদিন ধরে বিচারিক পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ততা প্রকৃত সত্য উদঘাটনে সহায়তা করেছেন। এখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে ঘটনার মারফত প্রকৃত অবস্থাকে তুলে ধরা। আমার গত লেখায় ঈদ উৎসবকে ঘিরে বাঙালী নারীর ব্যস্ততা, প্রস্তুতি ও দায়িত্বের স্বরূপ তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম। সেই কর্মক্ষম, দায়িত্বশীল নারীকে যদি নির্দিষ্ট গ-ির ভেতর আটকে রাখা হয় তখন তার ঈদ উৎসব বা ঈদের আনন্দ ম্লান হওয়াটাই স্বাভাবিক। তারপরও বাস্তবতার নিরিখেই কারাগারে নারীর ঈদ কেমন কাটে তার সবিস্তার তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। যদিও ঈদের দিন বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে সরকারের পক্ষ হতে তথাপি পরিবার পরিজন ব্যতীত একাকী পরিবেশে আনন্দ যেন বিলীন হয়ে যায় বাঙালী নারীর। অনেক নারীই আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে পারেন না। কেউ হয়ত হীনম্মন্যতায় ভোগেন, আবার কেউ পরিবারের পক্ষ হতে দেখার জন্য সাধারণত আসেন না কিংবা দেখা করার অনুমতির জন্য ঘুষ প্রদানের অপারগতায় অনেকেই আসেন না। সুতরাং কারাগার ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন আসতেই পারে এবং জনমনে কারাগার নিয়ে বিরূপ ধারণা হওয়াটাও স্বাভাবিক। কারাগারের পরিবেশও তেমন সুবিধের নয় যেখানে নারীরা স্বাভাবিক পরিবেশে থাকতে পারেন, পরিবেশটাও নারীদের জন্য বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে থাকে। তাছাড়া দাগী আসামিরা অনেক সময় সাধারণ নারীদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করার পাশাপাশি গর্হিত কাজের দিকে ধাবিত করে থাকেন। আস্তে আস্তে মানসিক বিকারগ্রস্ত অবস্থায় চলে যায় অনেক নারীই। তখন নিজ থেকেই সমাজ এবং পরিবার হতে নিজেদের বিচ্যুত রাখার প্রচেষ্টা চালায় নারীরা। অর্থাৎ পরিবেশ পরিস্থিতি নারীদের ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করে রাখে। সামাজিক বন্ধন, পারিবারিক দৃঢ়তা এবং অন্য সম্পর্কগুলো ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। আবার কারও কারও পরিবার হতে ঈদ উপলক্ষে কয়েদিদের জন্য নতুন জামা-কাপড় সরবরাহ করা হয়ে থাকে। নতুন জামার আনন্দে অনেকেই হয়তবা পুলকিত হয়ে উঠেন কিন্তু পরক্ষণেই আবার কারাবাসের চিন্তায় নিমজ্জ হয়ে পড়েন। অবশ্য কোন কোন কারাগারে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজনের ব্যবস্থা থাকে যার মাধ্যমে মুক্ত বিনোদন দেয়ার চেষ্টা করা হয়ে থাকে হাজতিদের। সেসব অনুষ্ঠানে কারাগারে থাকা কয়েদিরাও অংশগ্রহণ করে অনুষ্ঠানের আনন্দকে সমৃদ্ধ করে তোলে, অনুষ্ঠান পায় পূর্ণ প্রাণের ছোঁয়া। এ সব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নারীরা সামান্য হলেও ঈদের আনন্দে অন্তত একটি দিনের জন্য হলেও স্বাভাবিক সুস্থ জীবনের প্রত্যাশা করে থাকেন। আবার ঈদকে সামনে রেখে সরকার অনেক কয়েদির জেল জরিমানা মওকুফ করে থাকেন বিশেষ ব্যবস্থাধীনে। ওই সব মহিলা কয়েদি যারা ঈদের পরে মুক্তি পাবেন এমন বাস্তবায়নের অপেক্ষায় থাকেন কিংবা সরকারের পক্ষ হতে ঘোষণা প্রদান করা হয় তাদের ঈদ আনন্দের অনুভূতি অবশ্য অন্যরকম। খাঁচার ভেতর হতে মুক্ত হলে বিহঙ্গ যেমন প্রাণের স্পন্দনে বেঁচে উঠে ঠিক তেমনি মহিলা কয়েদিরাও ফিরে পায় মুক্ত বাতাসে আপনজনের সঙ্গে বেঁচে থাকার উদ্যমী শক্তি। পাশাপাশি নতুনভাবে জীবনকে সাজানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করে থাকেন নারীরা। কারিগরি দক্ষতায় প্রশিক্ষিত হয়ে সমাজে এসে প্রাপ্ত জ্ঞানকে কাজে লাগাতে সোচ্চার হন অনেকেই যার প্রেক্ষিতে পরিবারের আর্থিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখা যায়।
×