ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

২৪ দিন পর রোদ, বিবর্ণ পাহাড়ে নীরব কান্না পরিস্থিতির উন্নতি

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৭ জুলাই ২০১৭

২৪ দিন পর রোদ, বিবর্ণ পাহাড়ে নীরব কান্না পরিস্থিতির  উন্নতি

মোয়াজ্জেমুল হক/ মোহাম্মদ আলী/জীতেন বড়ুয়া/এস বাসু দাশ ॥ গত ১৩ জুন একই সময়ে একযোগে পাহাড়জুড়ে ধসে সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞ এবং পরবর্তীতে আরও ধস এবং ঢলে ল-ভ- হয়ে যাওয়ার ঘটনার ২৪ দিন পর এলাকার সর্বত্র রোদের দেখা মিলেছে। থেমে গেছে বর্ষণ। কিন্তু অকল্পনীয় ক্ষয়ক্ষতির কবলে পড়ে পাহাড়বাসীর কান্না থামছে না। সর্বপর্যায়ে দিশেহারা পরিস্থিতি। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে সর্বত্র অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতির চেহারা ভেসে উঠেছে। একের পর এক পাহাড় ধসের পাশাপাশি ঢলে ভেসে গেছে বিপুল বাড়িঘর, হয়েছে বিধ্বস্ত। মাটিচাপায় প্রাণহানি হয়েছে বহু। অগণিত পাহাড় এখন বিবর্ণ। সবুজের সমারোহে পাহাড়ে আকস্মিক প্রাকৃতিক এ আঘাত সকলকে রেখেছে শঙ্কায়। আচমকা একি হয়ে গেল। এ জিজ্ঞাসা সর্বত্র। বছরের পর বছর আঘাতে আঘাতে বিপর্যস্ত পাহাড় যেন প্রতিশোধই নিল। গত ১৩ জুন থেকে একের পর এক পাহাড় ধসের ঘটনা অব্যাহত ছিল। অতিভারি বর্ষণ এর মূল কারণ বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হলেও প্রকৃত কারণ এখনও অনুদঘাটিত। দেশের বিশেষজ্ঞ মহল সুনির্দিষ্টভাবে এখনও এর কোন ব্যাখ্যা নিশ্চিত করতে পারেনি। ফলে সবকিছু হারানো পাহাড়বাসীর ক্রন্দন থামছেই না। প্রশ্নের পর প্রশ্ন জেগেছে- এ কিসের লক্ষণ। ক্ষতির পরিমাণ এতই বেশি যে সরকার পক্ষে তা সহজে পুষিয়ে আনা অসম্ভব একটি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ির মোট ২৬ উপজেলায় পাহাড়ের পর পাহাড় ধসে গেছে। তেমনি সড়কের পর সড়ক ভেঙ্গে তচনচ হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও পাহাড় ধসের মাটির সঙ্গে সড়কও সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আবার কোথাও কোথাও দেবে গেছে। সড়ক যোগাযোগ দ্রুতগতিতে কোথাও কোথাও পুনঃস্থাপিত হলেও বিভিন্ন স্থানে এখনও অচলাবস্থা বিরাজ করছে। ফলে পাহাড়ী-বাঙালী নির্বিশেষে সকলের জীবনযাত্রায় নেমে এসেছে বিপর্যয়। আশ্রয় কেন্দ্রগুলো কোথাও কোথাও এখনও ত্রাণ সামগ্রি বিতরণ হচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও খালি হয়ে গেছে। কিন্তু সব আশ্রয় কেন্দ্র সরকার খোলা রেখেছে। কেননা, কখন যে আবার ধস ও ঢলের সৃষ্টি হবে এ আতঙ্ক কাউকে ছাড়ছে না। বান্দরবানে লামা, আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়িতে দুর্যোগ পরবর্তী পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে। তবে আলীকদম-থানছিসড়ক বন্ধ রয়েছে। আবার বান্দরবান-লামা সড়ক হালকা যানবাহনের জন্য চালু হয়েছে। লামা-আলীকদম সড়কটি দেশের সর্বোচ্চ। এটি ধসে যাবার পর পুনরায় চালু হতে দীর্ঘ সময় লাগবে বলে নিরাপত্তা বাহিনী সূত্রে জানানো হয়েছে। কেননা, সড়কটি তারাই নির্মাণ করেছিল। অপরদিকে, পাহাড়ী ঢলে বাড়িঘর ও সহায়সম্পদ হারানো মানুষের মাঝে চলছে হাহাকার। বৃহস্পতিবার থেকে রোদের দেখা মেলায় ঘুরে দাঁড়ানোর আশায় মানুষের মাঝে স্বস্তিও ফিরে আসতে শুরু করেছে। তবে সর্বহারা মানুষের মাঝে অনিশ্চিত পরিস্থিতির যে ভিত রচিত হয়েছে তার অবসান কিভাবে ঘটবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। রাঙ্গামাটিতে ভয়াবহ পাহাড় ধসে সৃষ্ট মহাপ্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ২৪ দিন পর বৃহস্পতিবার থেকে খাগড়া-বড়ইছড়ি সড়ক ভারি যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। এই সড়কটি এখন পুরোপুরি যানবাহন চলাচলের উপযোগী করা হয়েছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি-নানিয়ারচর সড়কও ভারি যানবাহনের জন্য খুলে দেয়া হবে বলে রাঙ্গামাটি সড়ক বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দেখা মিলেছে রোদের। বৃষ্টি না হওয়ায় রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কের ৬ কিমি অংশে মাটি ভরাট কাজ শেষ হয়েছে। একই সড়কের ৭ কিমি এলাকায় ৭০ কিমি জুড়ে ধসে যাওয়া সড়কের মাটি ভরাটের কাজ পুরোদমে চলছে। আবহাওয়া ভাল থাকলে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে এই সড়ক পুনঃ চলাচল উপযোগী হবে বলে সড়ক বিভাগের নির্বহী প্রকৌশলী মোঃ এমদাদ হোসেন জানিয়েছেন। বৃহস্পতিবার সকালে সেতু ম্যানেজমেন্ট ও মেনটেন্যান্স বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী রওশন আরা খানম ও ব্রিজ ডিজাইন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ ইউচুপ রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের সাপছড়ি এলাকার বেইলিব্রিজ এলাকাসহ এই সড়কের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্পট পরিদর্শন করে গেছেন। তারা ঢাকায় গিয়ে এই সড়কসহ তিন পার্বত্য জেলার ধসে যাওয়া সড়কগুলো টেকসইভাবে মেরামত করার জন্য ডিজাইন করা হবে বলে জানিয়ে গেছেন। সড়ক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ভারি বর্ষণের কারণে সড়কের ভাঙ্গা অংশে মাটি ধরে রাখা যায়নি। নানিয়ারচর বগাছড়ি, রাঙ্গামাটি বান্দরবান ও বাঙ্গালহালি রাজস্থলী সড়কের কাজ পুরোদমে চলছে। রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও নানিয়ারচর, বগাছড়ি সড়ক গত ২৪দিন ধরে সম্পূর্ণভাবে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। সড়ক বিভাগের ৪ টি টিম এসব সড়ক পুনরায় চালু করার জন্য তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। এ সড়ক মেরামত না হওয়ায় আটকাপড়া ভারি যানবাহন অলস পড়ে আছে। ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে জেলার গুরুতপূর্ণ ৫টি সড়কে ভারি যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় জেলার ৫হাজার পরিবহন শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। খাগড়াছড়িতে খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটি সড়ক এখনও চালু করা যায়নি। সড়ক যোগাযোগ কর্মীরা সড়কটি পুনচালু করার কাজ পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছেন। দীঘিনালায় পাহাড় ধসের ঘটনায় তিনটি বিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা বহাল রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ অপর আরও ছয়টি তীক্ষè নজরদারিতে রাখা হয়েছে। জেলার ৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিতরা অবস্থান করছেন। অনেকে ভিটেমাটিতে যাওয়ার আশায় রয়েছেন। চেংগি, মাইনী নদীতে ঢলের পানি কমেছে। মহালছড়ি-রাঙ্গামাটি নদীতে নৌ চলাচল চালু রয়েছে। তবে সাজেকসহ পাহাড়ের বিভিন্ন পর্যটন স্পটে পর্যটকের কোন আনাগোনা নেই। কেননা, বৃষ্টি হলেই জেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড়গুলো থেকে ছোট আকৃতির মাটিধস অব্যাহত রয়েছে। যেখানে ধস নামছে সেখানে সড়ক বিভাগের কর্মীরা বুলডোজার চালিয়ে তা অপসারণ কাজে যুক্ত রয়েছেন।
×