ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পাঁচ বছরে নির্যাতিত আড়াই হাজার নারী-শিশু পেয়েছে আইনী সহায়তা

নীরবে সেবা দিয়ে যাচ্ছে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৭ জুলাই ২০১৭

নীরবে সেবা দিয়ে যাচ্ছে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ফারিয়ার (ছদ্মনাম) বয়স যখন ছয় বছর তার মা-বাবার মধ্যে ঝগড়া হয় এবং তার মা তাকে ও তার ছোট ভাইকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। ফারিয়ার মা শিক্ষিত হওয়ায় ঢাকায় আসার পর একটি গার্মেন্টসে কাজের সুযোগ পেয়ে যান। কিছুদিন পর অন্য এক লোককে তিনি বিয়ে করে সংসার শুরু করেন। এভাবে কেটে যায় দুই বছর। ইতোমধ্যে, ফারিয়ার বয়স পৌঁছেছে এগারোর কোঠায়। মায়ের অনুপস্থিতিতে ফারিয়ার সৎ বাবার কু-দৃষ্টি পড়ে তার ওপর। দিনের পর দিন তার সৎ বাবা ফারিয়াকে যৌন নির্যাতন করতে থাকে। একসময় তার মা বিষয়টি বুঝতে পারে। কিন্তু সে লোকটির বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ না নিয়ে বরং মা হয়ে নিজের মেয়ে ফারিয়াকে ঘর থেকে রাস্তায় বের করে দেন। মেয়েটি রাস্তায় ঘুরতে থাকে। একসময় থানা পুলিশ তাকে উদ্ধার করে তেজগাঁও থানাসংলগ্ন ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে (ভিএসসি) দিয়ে যায়। পরবর্তীতে তাকে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে আশ্রয় দেয়া হয়। এরপর ভিএসসির প্রত্যেকের ভাল ব্যবহারে সে আস্তে আস্তে ২৫ দিন পর সবকিছু খুলে বলে। কিন্তু তার মায়ের ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায় না। এরপর বাংলাদেশ পুলিশের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তার স্থায়ী ঠিকানা জানা যায় কিন্তু তার নেশাগ্রস্ত বাবা অনেকদিন ধরেই নিখোঁজ রয়েছে। এরপর তার দাদা-দাদি, চাচা, ফুফুদের ঠিকানা জানা যায় কিন্তু সবাই ফারিয়ার দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানায়। পরবর্তীতে স্থানীয়-জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় গত বছরের ডিসেম্বরে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের কর্মকর্তারা তার দাদা-দাদির হাতে ফারিয়াকে তুলে দেয়। ফারিয়ার মতো সমাজে বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুকে পেশাগত সেবা প্রদানের জন্য বাংলাদেশ পুলিশের সার্বিক তত্ত্বাবধানে এবং ইউএনডিপি, ইউরোপিয়ান কমিশন এবং ডিএফআইর অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে রাজধানীর তেজগাঁও থানাসংলগ্ন ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার। প্রতিদিন অসংখ্য নির্যাতিত নারী ও শিশু আইনী সহায়তা এবং কাউন্সেলিংয়ের জন্য আসছে। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের কর্মকর্তারা নারী হওয়ার কারণে অভিযোগ নিয়ে আগত নারীরা অকপটে তাদের সমস্যার কথা খুলে বলতে পারছেন। যাতে আইনী সহায়তা এবং সঠিক পদক্ষেপ নিতে সেন্টারের কর্মকর্তাদের সহায়ক হচ্ছে। ১৭ বছরের মাহবুবা (ছদ্মনাম) কলেজে পড়ে। বাড়ি চট্টগ্রাম শহরে। গত বছরের শুরুর দিকে তার সঙ্গে স্থানীয় সুদর্শন এক ছেলের পরিচয় হয়। প্রণয়ের পর ছেলেটি তাকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসে। মেয়েটি বাসা থেকে বেরিয়ে আসার সময় কিছু টাকা-পয়সা, অলঙ্কার নিয়ে আসে। তা দিয়ে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বাসা নিয়ে কিছুদিন একসঙ্গে থাকে। পরবর্তীতে তার প্রেমিক তাকে হোটেলে অবস্থান করিয়ে তাকে দিয়ে দেহ ব্যবসা শুরু করাতে বাধ্য করায়। একদিন থানা পুলিশ হোটেলে রেড করে খদ্দেরসহ তাকে আটক করে। মেয়েটির বয়স কম এবং তা সে তার কথিত প্রেমিকের প্রতারণার শিকার হয়ে দেহ ব্যবসায় জড়িয়েছে বলে জানায়। তখন পুলিশের কর্মকর্তা মাহবুবাকে ভিএসসিতে প্রেরণ করে। এরপর সেখানকার আশ্রয়কেন্দ্রে সে দু’দিন আশ্রয় পায়। এখানকার নারী পুলিশ তার মা-বাবাকে ডেকে যথাযথ কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে তাদের কাছে মাহবুবাকে প্রেরণ করে। বর্তমানে মাহবুবা স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে এবং লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের বিগত পাঁচ বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত পাঁচ বছরে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার থেকে সেবাপ্রাপ্ত ভিকটিমের সংখ্যা ২ হাজার ৫৫৭। এর মধ্যে ২০১৬ সালে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে আগত ৪৬২ মামলার মধ্যে ধর্ষণ মামলা ১২৭, অপহরণ ১০৩, শ্লীলতাহানি ৪৬, যৌতুক ১৭৩, দাহ্য পদার্থের শিকার ৪ ও অন্যান্য নির্যাতনের শিকার ৯টি মামলা গৃহীত হয়। পরবর্তীতে মামলার সত্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে চার্জশীট গঠন করে আদালতে প্রেরণের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয় ২৯১ মামলা। এবং বাকি ১৭১ মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। ভিকটিম সেন্টার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানা যায়, থানায় মামলার বিষয়েও অনেকে এখানে আশ্রয় নিয়ে থাকেন। বর্তমানে সেখানে ধর্ষণের শিকার একজন নারী আশ্রিত আছেন। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে নির্যাতিত নারী ও শিশুদের থাকার জন্য আটটি বেড রয়েছে, এখানে ৫ দিন পর্যন্ত থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া, বিশেষ ক্ষেত্রে আশ্রয় পাঁচদিনের অধিক সময়ও আশ্রয় দেয়া হয়। এক বছর আগে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে অভিযোগ করে প্রতিকার পেয়েছেন রাজধানী তালতলার এক গৃহবধূ মর্জিনা। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী যৌতুকের জন্য আমাকে নির্যাতন করতেন। একপর্যায়ে আমার বাচ্চাকে রেখে দেন। এই অবস্থায় আমি ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে অভিযোগ করলে তারা আমার বাচ্চাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেয়। এখন আমাদের ভাঙ্গা সংসার জোড়া লেগেছে।’ ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে ওই সেন্টারের উপ-কমিশনার (ডিসি) ফরিদা ইয়াসমিন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘নির্যাতিত নারী ও শিশুদের জন্য এ কেন্দ্রটি ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। এখানে মোট ৮৬ মহিলা পুলিশ কাজ করছেন। এর মধ্যে সহকারী কমিশনার থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত রয়েছে। তা ছাড়া প্রতিটি এনজিওর পক্ষ থেকে প্রতিদিন একজন করে আইনজীবী আসেন। চিকিৎসক-কাউন্সিলরও উপস্থিত থাকেন। সব মিলিয়ে আমরা টিমওয়ার্কের মতো কাজ করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে যৌতুকের কারণে নির্যাতিত নারীরা বেশি অভিযোগ নিয়ে আসেন। যখন আমাদের কাছে কোন ভিকটিম অভিযোগ নিয়ে আসে, তখন তাকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে খাতায় তার অভিযোগ লিপিবদ্ধ করি। আমরা তখন নারী নির্যাতন দমন আইন, ২০০৩ অনুযায়ী ১১ (গ) ধারায় মামলা গ্রহণ করি। এরপর ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা যাচাই করি অর্থাৎ চার্জশীট তৈরি করে আদালতে পাঠানো হয়। আমরা ভিকটিমকে জানিয়ে দেয় যে আপনার সামনে এই আইনগত পথ বা দিক রয়েছে। তখন ভিকটিমের চাহিদা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়। অধিকাংশ ভিকটিমই সংসার টিকিয়ে রাখতে মীমাংসার পথে যেতে চায়। তখন আমরা উভয় পক্ষকে ডেকে তাদের কথা মনোযোগ সহকারে শুনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করি। এ সময় আইনজীবী, চিকিৎসক, কাউন্সিলর, ডিউটি অফিসার ও আমি উপস্থিত থাকি। পরবর্তী সময়ে আমরা এটাকে টিকিয়ে রাখতে ঘটনার ফলোআপও করছি। এছাড়া, হারানো নারী ও শিশুদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দেয়া পর্যন্ত এখানে আশ্রয়ের বিষয়টিও আমরা নিশ্চিত করি। তবে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অর্থাৎ মারাত্মক ঘটনার ক্ষেত্রে আমরা সঙ্গে সঙ্গে আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের মুখ্য উদ্দেশ্য হলোÑ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধা দূর করে নারী ও শিশুর প্রতি সংঘটিত অপরাধ প্রতিবেদনের সুযোগ নিশ্চিত করা; ভিকটিমকে সময়োপযোগী ও পেশাগত সেবা প্রদান করা; ভিকটিমের সুরক্ষা ও আইনগত অধিকার রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করা; সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে ভিকটিমের সর্বোত্তম সেবা নিশ্চিত করা; ভিকটিমকে বারবার নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করা; নারী ও শিশুর প্রতি সংঘটিত অপরাধের তথ্য সংরক্ষণ করা এবং অপরাধ নিবারণের জন্য কার্যকর নীতি তৈরি করা। এই উদ্দেশ্যগুলো নিয়েই রাজধানীর তেজগাঁও ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার যাত্রা শুরু করে ২০০৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। পুলিশ রিফর্মস প্রজেক্টের আওতায় এ কেন্দ্রটি চালু করা হয়। পরে দেশের সাতটি বিভাগীয় শহরে ও রাঙ্গামাটি শহরে একটিসহ দেশে মোট আটটি ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ পুলিশ। সবগুলো ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারেই রয়েছে নির্যাতিত নারী ও শিশুদের জন্য রয়েছে ভিকটিমদের সঙ্কটকালীন আবাসিক সুবিধা ও তাৎক্ষণিক সহায়তা। সেই সঙ্গে রয়েছে মেডিক্যাল, মনস্তাত্ত্বিক কাউন্সেলিং, সঙ্কটকালীন সময়ে সর্বোচ্চ পাঁচদিন আশ্রয়ের সুবিধা, খাবার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। হারানো শিশুদের অভিভাবকের কাছে হস্তান্তর করা না গেলে অথবা কোন কারণে বৈধ অভিভাবক না পাওয়া গেলে সেন্টারটি থেকে এনজিওর মাধ্যমে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পুলিশের পাশাপাশি দশটি এনজিও আইনী সহায়তাসহ অন্যান্য কাজ করছে। এগুলো হচ্ছেÑ আইন ও সালিশ কেন্দ্র, এ্যাসোসিয়েশন ফর কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট, এ্যাসোসিয়েশন ফর কারেকশন এ্যান্ড সোশ্যাল রেক্লেমেশন, অপরাজেয় বাংলাদেশ, এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন, জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), ঢাকা আহছানিয়া মিশন ও মেরী স্টোপস। যোগাযোগের ঠিকানা : ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার (তেজগাঁও থানা সংলগ্ন), তেজগাঁও, ঢাকা; ফোন : ৯১১০৮৮৫, ০১৭৪৫৭৭৪৪৮৬।
×