ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ফরহাদ মজহারের ঘটনায় জড়িত আইএসআই!

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৭ জুলাই ২০১৭

ফরহাদ মজহারের ঘটনায় জড়িত আইএসআই!

শংকর কুমার দে ॥ কবি, প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার ফরহাদ মজহার সাধারণত ভোরে ঘুম থেকে না উঠলেও সোমবার ভোর পাঁচটায় তিনি ঘুম থেকে উঠে ওষুধ কিনতে বাড়ির বাইরে যাবেন তা অপহরণকারীরা আগে থেকেই জানত কি? নাকি অপহরণকারী চক্রের কারও সঙ্গে তার পূর্ব পরিচয় ছিল যে বা যারা তাকে কৌশলে খুব ভোরে বাড়ি থেকে বের করে এনে অপহরণ করেছে? নতুবা তিনি ঘর থেকে বের হওয়ার সময় ব্যাগ, পাঞ্জাবি, মোবাইল ফোনের চার্জার নিয়ে ওষুধ কিনতে এসব নিয়ে বাড়ি থেকে বের হবেন কেন ? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ফরহাদ মজহারকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। তার বাড়ি ও আশপাশের এলাকার সিসি টিভির ফুটেজ সংগ্রহ করেছে তদন্তকারীরা। সেদিন ভোরে যারা নাইটগার্ড, সিকিউরিটি গার্ড ও দোকানি ছিলেন তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ফরহাদ মজহারকে জিজ্ঞাসাবাদ করে অপহরণের ঘটনার রহস্য উদঘাটন করে অপহরণকারী চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা করা হচ্ছে। যশোরে যেই হানিফ পরিবহনের বাস থেকে ফরহাদ মজহারকে নাটকীয়ভাবে উদ্ধার করা হয়েছিল সেই হানিফ এন্টারপ্রাইজের খুলনা-শিববাড়ী কাউন্টারের ম্যানেজার নাজমুস সাদাত সাদী ঢাকায় এসে আদালতে ১৬৪ ধারায় সাক্ষী হিসাবে জবানবন্দী দিয়েছেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) সূত্রে এ খবর জানা গেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) এক কর্মকর্তা বলেন, অপহরণের পূর্বাপর ঘটনা বিশ্লেষণ করলে অপহরণের ঘটনা ঘটানোর পেছনে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে বিরোধী শিবিরের আন্দোলনের রাজনৈতিক ইস্যু তৈরি করার ছক কষার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আর এই ঘটনায় দেশীয় কোন দুর্ধর্ষ পেশাদার অপরাধী চক্রকে ব্যবহার করা হয়েছে, যার পেছনে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) মদদ থাকতে পারে। বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে নানা ধরনের ছক কষার মাধ্যমে আত্মঘাতী জঙ্গী সংগঠন নব্য জেএমবিকে সংগঠিত করে টার্গেট কিলিং, খুন, গুম, অপহরণের মতো অপরাধ ঘটানো হচ্ছে এবং তা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সহায়তায় প্রচার মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে অপপ্রচার করানো হচ্ছে। ফরহাদ মজহার ডানপন্থী লেখক, কলামিস্ট হিসেবে তাকে অপহরণ, খুন, গুম কিংবা ভারতে পাচার করে দেয়ার চেষ্টা সফল হলে সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হলে তা বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা যাবে। আর এ জন্য সরকারের প্রতিপক্ষ বিএনপি-জামায়াত-শিবিরসহ তাদেরকে জোটবদ্ধ করে ফরহাদ মজহার অপহরণের ঘটনাটি আন্দোলনের জন্য পুঁজি করে রাজনৈতিক ইস্যু করে মাঠ গরম করা সহজ হবে। হানিফ পরিবহনের ম্যানেজারের জবানবন্দী ঢাকায় এসে আদালতে জবানবন্দী দিয়েছেন যশোরে যেই হানিফ এন্টারপ্রাইজের বাস থেকে ফরহাদ মজহারকে নাটকীয়ভাবে উদ্ধার করা হয়েছিল সেই হানিফ এন্টারপ্রাইজের খুলনা-শিববাড়ীর কাউন্টারের ম্যানেজার নাজমুস সাদাত সাদী। বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকার মহানগর হাকিম খুরশিদ আলমের খাস কামরায় ১৬৪ ধারায় সাদীর বিচারিক জবানবন্দী রেকর্ড করেন বলে আদালত পুলিশের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা এসআই নিজাম উদ্দিন। সাক্ষী হিসেবে সাদীকে আদালতে হাজির করে জবানবন্দী নেয়ার আবেদন করেন ফরহাদ মজহার অপহরণ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মোঃ মাহবুবুল হক। ঘটনার সেদিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বিচারকের কাছে জবানবন্দী দিয়েছেন নাজমুস সাদাত সাদী। খুলনার শিববাড়িতে হানিফ এন্টারপ্রাইজের কাউন্টার ব্যবস্থাপক নাজমুস সাদাত সাদী পরদিন গণমাধ্যমকে জানান, ফরহাদ মজহার সেদিন তার কাউন্টার থেকে গফুর নামে টিকেট কাটেন। সোয়া ৯টার দিকে কোচটি রয়্যাল মোড় শিববাড়িতে এলে ফরহাদ মজহার গাড়িতে ওঠেন। টিকেট বিক্রির সময় ফরহাদ মজহারকে চেনেননি জানিয়ে সাদী সেদিন বলেছিলেন, র‌্যাব সদস্যরা ছবি দেখানোর পর তিনি চিনতে পারেন। ওই বাসের যাত্রী চিত্রনির্মাতা শাহরিয়ার পলক সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, রাত পৌনে ১১টার দিকে নওয়াপাড়ায় বাস থামিয়ে সুপারভাইজার বলেন, তারা যাত্রী ফেলে এসেছেন, সেজন্য অপেক্ষা করতে হবে। তার ৪০ মিনিট পর র‌্যাব-পুলিশের গাড়ি আসে এবং ৭/৮ জন বাসে উঠে তল্লাশি করে শেষ আসনে ঘুমন্ত অবস্থায় পায় ফরহাদ মজহারকে। ফরহাদ মজহারের পরনে তখন সাদা পাঞ্জাবি, নীল চেকের লুঙ্গি এবং মাথায় পাগড়ির মতো সাদা কাপড় প্যাঁচানো ছিল। সঙ্গে কাপড়ের একটি ব্যাগও ছিল বলে জানান শাহরিয়ার। তাকে উদ্ধারের পর পুলিশের খুলনা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক দিদার আহম্মেদ বলেছিলেন, এটা ‘অপহরণের নাটক’ বলে মনে হয়েছে তাদের। ডিবি সূত্র জানায়, ডানপন্থী অধিকার কর্মী হিসেবে পরিচিত কবি-প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার সোমবার ভোরে ঢাকার শ্যামলীর রিং রোডের বাসা থেকে বেরিয়ে অপহৃত হন বলে তার পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে আদাবর থানায় মামলা হয়। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে অনুসন্ধান শুরু করার পর রাতে যশোরে হানিফ এন্টারপ্রাইজের একটি বাস থেকে ফরহাদ মজহারকে উদ্ধার করা হয়। যশোর থেকে ঢাকায় নিয়ে আসার পর ফরহাদ মজহারকে গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে তিনি হাকিম আদালতে ১৬৪ ধারায় বিচারিক জবানবন্দী দেন এবং বিচারকের কাছ থেকে নিজের জিম্মায় বাড়ি ফেরার অনুমতি পান। রাতে তাকে ঢাকার বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করেন স্বজনরা। গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ফরহাদ মজহার বলেছিলেন, সোমবার ভোরে ওষুধ কেনার জন্য তিনি বাসা থেকে বের হলে কয়েকজন একটি মাইক্রোবাসে করে তাকে তুলে নিয়ে যায়। আর মামলায় বলা হয়, সেদিন ভোর ৫টার দিকে ঘুম ভেঙ্গে গেলে ফরহাদ মজহারকে না দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েন ফরিদা। সকাল ৫ টা ২৯ মিনিটে তিনি স্বামীর ফোন থেকে কল পান। ফরহাদ মজহার তাকে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলেন, ‘ওরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে, মেরে ফেলবে’। এরপর ফোনটি কেটে যায়। পরে পুলিশের উপস্থিতিতেই সারাদিনে ফরহাদ মজহারের ফোন থেকে আরও চার বার কল পান ফরিদা। সেসব ফোনালাপে ফরহাদ মজহার জানান, অপহরণকারীরা ৩৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ চায়। ওইদিন রাতে যশোরের বাসে ফরহাদ মজহারের খোঁজ পাওয়ার আগে খুলনা নিউমার্কেট এলাকার ‘নিউ গ্রীল হাউস’র মালিক আব্দুল মান্নান দাবি করেন, তার রেস্তরাঁয় ফরহাদ মজহার ভাত খেয়েছেন। টিভিতে ফরহাদ মজহারের ছবি দেখে তিনি র‌্যাবকে খবর দিলে রাত সাড়ে ১১টার দিকে যশোরের নওয়াপাড়ায় খুলনা থেকে ঢাকাগামী একটি বাস থামিয়ে শেষের সারির আসনে ফরহাদ মজহারকে পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পর্দার অন্তরাল থেকে যারা আত্মঘাতী জঙ্গী সংগঠন নব্য জেএমবিকে সংগঠিত করে টার্গেট কিলিং, খুন করিয়েছে সেই তারাই আবার নেপথ্যে থেকে ফরহাদ মজহার অপহরণ করিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এ জন্য দেশীয় পেশাদার দুর্ধর্ষ অপরাধী চক্রকে ব্যবহার করে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই মদদ দিয়ে থাকতে পারে এমন আভাস-ইঙ্গিত বহন করছে। তাকে অপহরণ করে খুন, গুম কিংবা ভারতে পাচার করে দিতে সফল হলে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক ইস্যু তৈরি করে মাঠ গরম করার ছক কষা হয়েছিল বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। ফরহাদ মজহার নিজেই আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়ে বলেছেন, আমাকে কারা অপহরণ করেছে তাদেরকে আমি চিনতে পারিনি। তবে তাদের কথাবার্তায় বুঝতে পারি এই সরকারকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে হেয় করতে চায় এমন একটি গোষ্ঠী আমাকে অপহরণ করেছিল। ফরহাদ মজহারের আদালতে দেয়া জবানবন্দীটি অপহরণ রহস্য উদঘাটনের একটি ক্লু ধরে তদন্ত করা হচ্ছে বলে ডিবি কর্মকর্তার দাবি।
×