ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হরিধানের উদ্ভাবক হরিপদ আর নেই

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ৭ জুলাই ২০১৭

হরিধানের উদ্ভাবক হরিপদ আর নেই

নিজস্ব সংবাদদাতা, ঝিনাইদহ, ৬ জুলাই ॥ ঝিনাইদহ সদর উপজেলার আহসাননগর গ্রামের হরিধানের উদ্ভাবক হরিপদ কাপালী (৯৫) আর নেই। বুধবার রাত ১টার দিকে আহসাননগর গ্রামের নিজ বাড়িতে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে চুয়াডাঙ্গার আলিয়ারপুর শ্মশানে তাকে সমাহিত করা হয়। সে সময় ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু, জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শাহ মোহাঃ আকরামূল হক, কৃষি কর্মকর্তা ড. খান মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, ইউপি চেয়ারম্যান কাজী নাজির উদ্দিন, সাংস্কৃতিক সংগঠন কসাস’র প্রতিষ্ঠাতা সাকিব আল হাসানসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও এলাকার বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন। হরিপদ কাপালি দীর্ঘ ৬ মাস বার্ধক্যজনিত কারণে শয্যাশায়ী ছিলেন। ১৯২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার সাধুহাটি ইউনিয়ের এনায়েতপুর গ্রামে হরিপদ কাপালির জন্ম। পিতা কুঞ্জলাল কাপালী ও মা শিরোধনী অনেক আগে মারা যান। সে সময় হরিপদ কাপালী আহসাননগর গ্রামে সনীতি রায়কে বিয়ে করে ঘর জামাই থাকেন। তার স্ত্রী এখনও জীবিত আছেন। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। রাজ কুমার নামে এক ছেলেকে লালন পালন করেছেন। তিনি গ্রামের একজন সাধারণ কৃষক। জানা যায়, ১৯৯৭ সালে নিজের ধানের জমিতে একটি ছড়া খুঁজে পান হরিপদ কাপালী। ধানের গোছা বেশ পুষ্ট এবং গাছের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। এ ছড়াটি তিনি নজরদারিতে রাখেন। ধানে শীষ বের হলে তিনি দেখতে পান শীষগুলো অন্য ধানের চেয়ে দীর্ঘ এবং প্রতিটি বাইলে ধানের সংখ্যাও অনেক বেশি। ধান পাকলে ধানের শীষগুলো তিনি আলাদা করে বীজ ধান হিসেবে রেখে দেন। ওই ধান থেকে পরের বছর তিনি বীজ তৈরি করেন। হরিপদ কাপালির নামের সঙ্গে মিল রেখেই এ ধানের নামকরণ করা হয় ‘হরিধান’। ১৯৯৯ সালে তিনি নিজ জমিতে এ ধানের প্রথম আবাদ শুরু করেন। ওই বছরই আলোড়ন সৃষ্টি করে হরিধান। রাস্তার পাশে জমি হওয়ায় চারদিকে এ ধানের নাম ছড়িয়ে পড়ে। ধান কাটা শুরু হলে পাশের গ্রামের কৃষকরাও বীজ নিয়ে যান তার কাছ থেকে। এরপর থেকে হরিধানের আবাদ বিস্তার লাভ করে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে, জেলা থেকে অন্য জেলায়। পত্র-পত্রিকায় হরিধানের ওপর প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে দূর-দূরান্তের কৃষক ও সাংবাদিকরা ছুটে যান আহসাননগর গ্রামে। টেলিভিশনেও খবর প্রচারিত হয়। প্রচারের পর হরিধানের সুনাম আরও ছড়িয়ে পড়ে। এখনও সারাদেশের মানুষ এই হরিধানের বীজ সংগ্রহ করে চাষ করছেন। এই ধানের উৎপাদন খরচ কম, ফলন বেশি, পোকামাকড়ও কম লাগে। অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টির মাঝেও হরিধানের ফলন ভাল হয়। বিঘাপ্রতি ২০-২২ মন হারে ফলন পাওয়া যায়। এই ধানের ভাত যেমন স্বাদের, তেমনি এর বিছালিও খুব নরম। গরুও খায় ভাল। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ ঝুঁকে পড়ে এ ধানের আবাদে। সরকারের কৃষি বিভাগ থেকে হরিধানের বীজ সংগ্রহ করে পরীক্ষামূলকভাবে মহেশপুরের দত্তনগর কৃষি ফার্ম ও সাধুহাটি খামারে চাষ করা হয়। হরিধানের ফলন দেখে অবাক হয়ে যান কৃষিবিজ্ঞানীরা। কৃষি কর্মকর্তারা বলেন, হরিধান একটি বিশেষ জাতের উচ্চ ফলনশীল ধান। হরিধান আবাদে কৃষক খুবই ভাল ফলন পাচ্ছেন। কৃষি কর্মকর্তাদের মাধ্যমেও এ ধানের প্রচার শুরু হয়। ফলে অল্পদিনের মধ্যে এর প্রসার ঘটে দেশব্যাপী। এদিকে এই হরিধান উদ্ভাবনের মধ্যদিয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে হরিপদ কাপালীর নাম। পেয়েছেন বিভিন্ন পর্যায়ের পুরস্কার ও সম্মাননা। নিজের অজান্তেই উদ্ভাবন করলেন এক নতুন প্রজাতির ধান, হরিধান। নিঃসন্তান হরিপদ কাপালী বলতেন আমার কোন সন্তান নেই কিন্তু এই ধানই আমার সন্তান। ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু বলেন, হরিপদ কাপালী ছিলেন অত্যন্ত গুণী একজন ব্যক্তি এবং সাদা মনের মানুষ। তার মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া কষ্ট। তার উদ্ভাবনী ‘হরিধান’ সারাদেশকে উপকৃত করেছে। তিনি মারা গেলেও রেখে গেছেন লালিত সন্তান ‘হরিধান’। তার শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়।
×