ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

‘সুদ কমছে না সঞ্চয়পত্রে’ প্রধানমন্ত্রীকে অগ্রিম ধন্যবাদ

প্রকাশিত: ০৩:৩৬, ৭ জুলাই ২০১৭

‘সুদ কমছে না সঞ্চয়পত্রে’ প্রধানমন্ত্রীকে অগ্রিম ধন্যবাদ

২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট পাসের পর গত ৩ জুলাই তারিখের দৈনিক জনকণ্ঠে খুবই আশাপ্রদ একটা খবর ছাপা হয়েছে। এই খবরের শিরোনাম হচ্ছে : ‘সুদ কমছে না সঞ্চয়পত্রে।’ খবরের ভেতরে অর্থ সচিবকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ‘বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক, শারীরিক প্রতিবন্ধী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা, প্রবাসী ও মহিলাদের জন্য থাকছে বিশেষ স্কিম। সঞ্চয়পত্র সামাজিক সুরক্ষার সঙ্গে জড়িত।’ এই খবর সত্য হলে বলতেই হবে, এটা ভ্যাট আইন স্থগিতকরণের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। বহুল সমালোচিত ‘ভ্যাট আইন’ স্থগিতকরণের সিদ্ধান্তের পর প্রশ্ন ওঠে, তাহলে সঞ্চয়পত্রের সুদের হারের কী হবে? কথা ওঠে, কারণ, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রকে উল্লেখ করে খবর ছাপা হচ্ছিল যে, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমছে। কাগজগুলো সমানে এর ওপর স্টোরি করছিল। আর তা ‘দিচ্ছিল দেশের এক শ্রেণীর অর্থনীতিবিদ যারা বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এতদ্দেশীয় তল্পিবাহক। এই পোষ্যরা নানা আজগুবি কারণ ও যুক্তি দেখিয়ে মিডিয়ার একাংশকেও বিভ্রান্ত করছিল। এতে যোগ দেয় একশ্রেণীর ব্যাংকার যারা বুঝে, না বুঝে বলে সঞ্চয়পত্রের বেশি সুদের জন্য আমানত কমছে। এ অভিযোগ যে কত অসত্য তা আমানত বৃদ্ধি-হ্রাসের সঙ্গে সঞ্চয়পত্রের সুদের হারের তুলনামূলক বিচার করলেই বোঝা যাবে। এসব ভিন্ন কথা। মোটকথা নানা প্রচারণায় দেশের একটা বিরাট অংশের সঞ্চয়কারীর মধ্যে একটা ধারণা সৃষ্টি হয় যে, সরকার সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদের হার কমাবে। চারদিকে তৈরি হয় এক সমালোচনামুখর পরিবেশ। মধ্যবিত্তের প্রশ্ন, বৃদ্ধদের প্রশ্ন, অসহায় মহিলাদের প্রশ্ন, অবসরপ্রাপ্তদের প্রশ্নÑ সংসার চলবে কীভাবে? ব্যাংক সুদ নেই, আয়-রোজগার কম, চাকরিহীনতা বাড়বে, গার্মেন্টস চাকরি সংস্থানের সুযোগ কমছেÑ কীভাবে চলবে সংসার। রোজার আগে এবং রোজার মধ্যে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, বাজেট পাসকালীন সময়ে আবার এক দফা মূল্যবৃদ্ধি করেছেন ব্যবসায়ীরা। এমতাবস্থায় যদি সঞ্চয়পত্রে সুদ কমে তাহলে সংসার চলবে কীভাবে? এক কোটি টাকা ব্যাংকে মেয়াদী আমানত রাখলে সুদ পাওয়া যায় সর্বোচ্চ ছয় লাখ টাকা। তা থেকে ১০-১৫ শতাংশ হারে উৎসেই কেটে নেয়া হয় অগ্রিম আয়কর। হাতে থাকে বড়জোর ৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা। মাসে হয় কত? মাত্র ৪৫ হাজার টাকা। নিজের ফ্ল্যাটে বসবাস করলেও এই টাকায় সংসার চালানো কত কষ্টকর তা ভুক্তভোগীরাই জানেন। অনেক পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুই প্রবীণ থাকলে ওষুধ ও ডাক্তারি টেস্টেই চলে যাবে এই টাকা। একখানা ভাঙ্গা গাড়ি থাকলে ওই পরিবারকে উপোস করতে হবে। এসব জানা কথা। কিন্তু প্রশ্ন : এক কোটি টাকা কয়জন প্রবীণের, মধ্যবিত্তের সঞ্চয় আছে? এটা হবে বিরল ঘটনা। অবসরপ্রাপ্তরা কী কষ্টে আছেন তার এক প্রমাণ হচ্ছে সাম্প্রতিক অনেক ঘটনা। বর্ধিত সংখ্যক অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মচারী অর্থ মন্ত্রণালয়ে দরখাস্ত করছেন আর্থিক সহায়তার জন্য। অথচ এর কোন সুযোগ নেই। এসব উদাহরণ বাড়িয়ে লাভ নেই। মানুষের কষ্টের জীবন বর্ণনা আর করতে চাই না। দৃশ্যতই মনে হচ্ছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এই প্রেক্ষাপটে, হস্তক্ষেপ করেছেন। নতুবা অর্থ সচিব সঞ্চয়পত্রে সুদ কমবে না এ কথা বলতে পারতেন না। তাদের হচ্ছে কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন। দুই দিন আগেই তারা মিডিয়াকে বলেছেন, সুদ কমছে। এমতাবস্থায় বোঝা যায় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ঘটেছে। যেভাবে তিনি নতুন ভ্যাট আইনের ভয়াবহতা থেকে দেশবাসীকে বাঁচিয়েছেন, ঠিক একইভাবে বিপুলসংখ্যক মধ্যবিত্ত সঞ্চয়কারীকে বাঁচাবার জন্য তিনি হস্তক্ষেপ করেছেন। আমি তাকে অগ্রিম ধন্যবাদ জানাচ্ছি লাখ লাখ অসহায় মানুষের পক্ষ থেকে। কথা যখন উঠেছে তখন আরও কিছু কথা বলতে হয়। বলতে হয় সঞ্চয়পত্রের বিরোধিতাকারীদের কিছু মন্তব্য সম্পর্কে। বলা হচ্ছে সঞ্চয়পত্রের কারণে সরকারের সুদ ব্যয় বাড়ছে। সঞ্চয়পত্র কিনে বড়লোকেরা, ধনীলোকেরা। কেউ কেউ শ্যালিকা, গৃহকর্মীর নামেও কেনে। সঞ্চয়পত্র এবং মেয়াদী আমানত মানুষকে অলস করে দিচ্ছে। লোকেরা সুদের টাকা খেয়ে আরামে জীবনযাপন করছে। সঞ্চয়পত্রের কারণে শেয়ার বাজার হচ্ছে না, বন্ড মার্কেট হচ্ছে না। এসব যুক্তি দেখিয়ে তারা সঞ্চয়পত্র বিক্রি চিরদিনের জন্য বন্ধ করতে বলছেন। এসব বক্তব্য শুনে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় এসব জ্ঞানপাপীর ঘাড়ে আমেরিকা চেপে বসেছে। আমেরিকার নাগরিকরা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ঋণী থাকে। এরা সবচেয়ে বড় ধনী দেশ। জ্ঞানপাপীরা চায় আমাদেরও কোন সঞ্চয় না থাক, আমরাও ঋণের ওপর বাঁচি! অথচ আমাদের বর্তমান সরকারের নীতি সঞ্চয় বৃদ্ধি করা, সঞ্চয়কে উৎসাহ দেয়া। সঞ্চয়কে উৎসাহিত করার জন্য করদাতাদের সঞ্চয়পত্র কিনতে উৎসাহিত করা হয়। সঞ্চয়পত্রে বা শেয়ারে সঞ্চয়-বিনিয়োগ না করলে দেড়গুণ হারে কর দাতাকে ট্যাক্স দিতে হয়। ‘সিস্টেমই’ এ রকম। এমতাবস্থায় যদি কেউ বলে যে, করদাতারা অলস, অকর্ম্য এবং তারা সুদের টাকা খায় তাহলে এর চেয়ে অবিচার আর কী হতে পারে? দ্বিতীয় প্রশ্ন, ৬৫ বছর এবং তদুর্ধরা কী অলস ব্যক্তি? সবাই জানি মহিলাদের জন্য ‘পরিবার সঞ্চয়পত্র’ করা হয়েছে এবং এটি হয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায়। এটি আগে ছিল না। তিনিই করেছেন। উদ্দেশ্য তাদের অলস বানানোর জন্য নয়। উদ্দেশ্য নারীর ক্ষমতায়ন। নারীরা, মেয়েরা বাবা-মা, ভাই-বোন, চাচা-মামা, স্বামী ইত্যাদি সূত্র থেকে অনেক সময় টাকা পায়। তারা টাকা জমায়ও। অনেকে চাকরি করেন বা রোজগার করেন। এদের আর্থিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে এটা নারীর ক্ষমতায়নকে সহায়তা করে। তাই দেখা যায় প্রচুর সংখ্যক নারী পরিবার সঞ্চয়পত্র কেনেন এবং তা কেনেন সীমার মধ্যেই, অফুরন্ত সঞ্চয়পত্র কোনটাই কেনা যায় না। সব সঞ্চয়পত্রেরই ‘ক্রয়সীমা’ আছে। ইচ্ছা করলেই যে কেউ যে কোন পরিমাণ সঞ্চয়পত্র কিনতে পারে না। এর বিস্তারিত বিধিমালা আছে। অপব্যবহারের সুযোগ খুবই কম। উল্লেখ্য, নারীদের সঙ্গে করে যোগ হয়েছে ৬৫ বছর ও তদুর্ধ বয়স্ক পুরুষরা। তারা এই দেশে ‘নারীর সমান।’ প্রবীণ এই নাগরিকরা সারা জীবন কাজ করেছেন হয় চাকরি করেছেন, নয়ত ব্যবসা করেছেন, নয়ত ছিলেন পেশাজীবী। তারা অবসর জীবনে সঞ্চয়পত্রের ওপর বেঁচে আছেন। এদের যদি কেউ অলস ও অকর্ম্য বলে তাহলে ওই লোককে কী বলে আখ্যায়িত করব তা আমার জানা নেই। আসে শেয়ার বাজারের কথা, বন্ড মার্কেটের কথা। বন্ড মার্কেট হচ্ছে না কারণ সঞ্চয়পত্র। কীভাবে? বন্ড তো প্রতিষ্ঠান ছাড়া কেউ কিনতে পারে না- এটাই আমার জানা। নাকি আমি ভুল বলছি? তাহলে কীভাবে বলা হচ্ছে। বন্ড মার্কেট হচ্ছে না, কারণ মানুষ সঞ্চয়পত্র কেনে। শেয়ার বাজার হচ্ছে না, কারণ মানুষ সঞ্চয়পত্র কিনছে। কাকে বোঝাব যে, শেয়ার মার্কেটের ব্যর্থতার কারণ অনেক। কয়েক বছর আগে যে ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল শেয়ার বাজার তার কারণ ছিল ‘ব্যাংক-ফিন্যান্স’ যা ছিল একটা ভুল পদক্ষেপ। তাছাড়া শেয়ার বাজারে এ পর্যন্ত দুটো বড় জালিয়াতি সংঘটিত হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা শেয়ার বাজার থেকে লোপাট করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এসব শেয়ার দুর্বৃত্তের কোন বিচার আজ পর্যন্ত হয়নি। আইনী জটিলতা এ রকম। প্রধানত এই কারণেই এই বাজারটি একবার ওঠে, একবার নামে। অথচ এসব ঘটনাকে আড়াল করে বিশ্বব্যাংকের পোষ্যরা বলতে চায় শেয়ার বাজার হচ্ছে না সঞ্চয়পত্রের কারণে। সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, ব্যাংক আমানত, জমি-ফ্ল্যাট, সোনা, ডলার ইত্যাদি মানুষের সঞ্চয়ের মাধ্যম। সবের মিশ্রণেই টাকার বাজার। এসব নষ্ট করে যারা শুধু শেয়ার বাজারের কথা বলে তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সবার সচেতন হওয়া দরকার। আর দুই কথা বলা দরকার এক শ্রেণীর ব্যাংকারকে যারা বলেন সঞ্চয়পত্রের কারণে আমানত হ্রাস পায়। বোঝা যায় বিষয়টি। সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে মানুষের কাছ থেকে ঋণ নেয়। মানুষের হাতে টাকা কমে অথবা ব্যাংক আমানত কমে। টাকা যায় সরকারের হাতে। সরকার কী টাকা ‘বালিশের নিচে’ রাখে? না সরকার সেই টাকা উন্নয়নে খরচ করে। টাকা পায় ব্যবসায়ীরা, শ্রমিকরা, নানা শ্রেণীর ভোক্তারা। সেই টাকা আবার ব্যাংকে আসে। বড়জোর আমানতের কাঠামো (স্ট্রাকচার) বদল হয়। এটাই চিরকালের নিয়ম। টাকা-সঞ্চয়-আমানতÑ সব সময়ই গতিশীল। এমতাবস্থায় কী করে বলা হয় যে, সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়লে আমানত হ্রাস পায়? লেখক : সাবেক শিক্ষক ঢাবি
×