ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আটকেপড়া বাংলাদেশী

প্রকাশিত: ০৩:৩৫, ৭ জুলাই ২০১৭

আটকেপড়া বাংলাদেশী

মানবিক সঙ্কট অসহায়জনক পরিস্থিতি তৈরি করে। মানবতা ধুলায় লুণ্ঠিত হলে মানুষের বেঁচে থাকার পথে তৈরি হয় প্রতিবন্ধকতা। জীবন-মরণের সীমানায় দাঁড়িয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির মোকাবেলা করা হয়ে ওঠে সুকঠিন। এমনই এক করুণ কষ্টকর দুর্ভোগে পতিত হয়েছে প্রায় দুই হাজার বাংলাদেশী এবং তা তুরস্কে। কবি নজরুলের কল্যাণে তুরস্ক বা তুর্কী শব্দ অতি পরিচিত বাংলাদেশীদের কাছে। অবশ্য এক সময় তুর্কীরা এই দেশও শাসন করেছে। সে সব ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। তুরস্কের জাতির পিতা কামাল আতাতুর্কের নাম এদেশে সুপরিচিত। তার নামে সড়ক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। কিন্তু সেই তুরস্ক আর নেই, যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা জনজীবনকে আধুনিক ও উন্নততর জীবনবোধে আপ্লুত করেছিল। এশিয়া ও ইউরোপ এই দুই মহাদেশের মধ্যে বিস্তৃত দেশটি বহিরঙ্গে ও অন্তরঙ্গে অনেক বদলে গেছে। উদারতার আকাক্সক্ষা সেখানে ম্লান। মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংঘাত যুদ্ধবিগ্রহে দেশটি নানা কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধরা আইএসে যোগ দিতে সিরিয়ায় যেতে তুরস্ককে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করেছে দীর্ঘদিন ধরে। তাছাড়া লিবিয়া, ইরাক, সিরিয়ার শরণার্থীদের আশ্রয়স্থলে পরিণত তুরস্ক এখন। এই রাষ্ট্র থেকে ইউরোপে পাড়ি জমানোর পথ সহজ বলেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর অসহায় মানুষ তুরস্ককে বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিল। যুদ্ধরত দেশগুলো ছাড়াও ইরান, লেবানন ও জর্দানে বৈধভাবে কর্মরত বাংলাদেশীরাও তুরস্কে ভিড় জমাচ্ছে। লক্ষ্য তাদের ভাগ্য পরিবর্তন ও আয়-রোজগার বাড়াতে ইউরোপের দেশগুলোতে পাড়ি জমানো। কিন্তু বৈধভাবে প্রবেশাধিকার না থাকায় তারা অবৈধভাবে ঢোকার জন্য তুরস্কে অবস্থান করছে। এদের সংখ্যা ২ হাজারের মতো, যা আরও বাড়তে পারে। তাদের জানা নেই কিংবা জানা থাকলেও গুরুত্ব পাচ্ছে না যে, তুরস্ক হয়ে ইউরোপে পাড়ি জমানোর সম্ভাবনা এই মুহূর্তে একেবারেই নেই। আর অবৈধভাবে যাওয়াও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ ইউরোপ শরণার্থীরা অভিবাসীদের প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছে অনেকদিন আগেই। বরং অনেক শরণার্থীকে তুরস্কে ফেরত পাঠানো হয়েছে এই শর্তে যে, তুরস্ক এদের আশ্রয় দেবে এবং ইউরোপ এদের জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা দেবে। সিরিয়াসহ অন্যান্য সীমান্ত এলাকায় তুরস্ক শরণার্থী শিবির স্থাপন করেছে। এই শরণার্থীদের মধ্যে বাংলাদেশী না থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ তারা তুরস্ক নয়, বরং ইউরোপে যেতে আগ্রহী। বর্তমানে ইউরোপে যাত্রা সহজসাধ্য নয়। তুরস্কে বাংলাদেশ দূতাবাসের মতে, যারা অবৈধভাবে তুরস্কে অবস্থান করছেন অথবা যারা তুরস্কের ডিটেনশন সেন্টার থেকে ছাড়া পাচ্ছেন তাদের অনেকে আবার ইউরোপে যাওয়ার জন্য সমুদ্রপথ পাড়ি দেয়ার চেষ্টাকালে মৃত্যুমুখে পড়েছেন। এদের অনেকেই তুরস্কে সক্রিয় মানব পাচারকারীদের প্রলোভনে পড়ে সর্বস্ব খুইয়েছেন। সম্প্রতি ইস্তান্বুলে একজন বাংলাদেশী মারা গেছেন। এমন তথ্যও মেলে যে, বাংলাদেশীরা তুরস্কে সক্রিয় বিভিন্ন সংঘবদ্ধ সংগঠনের খপ্পরে পড়ে টাকার লোভে বিভিন্ন সন্ত্রাসমূলক কার্যক্রমে জড়িত হয়ে পড়ছে, যা দুঃখজনক হলেও বাস্তব। এমনিতেই অবৈধভাবে আসা ব্যক্তিদের জন্য তুরস্ক কখনই বৈধ কর্মসংস্থানের সুযোগ দেয় না। ফলে এসব লোক দীর্ঘদিন ধরে স্বল্প বেতনে বিপজ্জনক কাজ করে আসছে। এই বেতন তাদের আর্থিক উত্তরণের কাজে লাগে না। জীবন ধারণেই ব্যয় হয়ে যায় সব। ইউরোপে পাড়ি জমানোর দিবাস্বপ্ন তাদের ব্যর্থ হতে বাধ্য। মূল কারণ ইইউর বিদ্যমান অভিবাসননীতি। ইইউভুক্ত বিভিন্ন দেশে প্রায় তিরানব্বই হাজার অবৈধ বাংলাদেশী রয়েছেন বলে ইইউ দাবি করেছে। এমনকি তাদের ফিরিয়ে আনা না হলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভিসায় কড়াকড়ি আরোপ করা হতে পারে। এই যেখানে অবস্থা সেখানে তুরস্ক থেকে ইউরোপে পাড়ি জমানোর অর্থ এক চুল্লি থেকে আরেক চুল্লিতে প্রজ্বলিত হওয়ার পথ বেছে নেয়া। তুরস্কে আটকেপড়া দুই হাজার বাংলাদেশী নাগরিকের সঙ্কটের মুখোমুখি হবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এদের প্রত্যাবাসনে শ্লথগতি সঙ্কটকে আরও তীব্রতর করবে। বাংলাদেশ সরকার ও দূতাবাসের উচিত এই বাংলাদেশীদের বৈধভাবে তুরস্কে অবস্থানের জন্য দেন-দরবার করা। সঙ্কটের মুখে পড়া এই মানুষগুলোর বিষয়ে মানবিক হবার জন্য তুরস্কের প্রতি আহ্বান জানানো যেতে পারে। তবে আশার কথা এই যে, বাংলাদেশ সরকার তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে।
×