ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অপূর্ব কুমার কুণ্ড

লোকশিক্ষায় লোকনাট্যদল

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ৬ জুলাই ২০১৭

লোকশিক্ষায় লোকনাট্যদল

গ্রীসের নাগরিকদের জীবনে বিনোদন ফিরিয়ে আনতে আর রাজধানী এ্যাথেন্সের অচলায়তন সচল করতে নাটক মঞ্চায়ন যে এত বেশি প্রয়োজন তা জানা যেত না যদি না নাট্যকার এ্যারিস্টোফানিস তার রচিত নাটক দ্য ফ্রগস বা ব্যাঙ না লিখতেন। এ নাটকে দেখা যায়, এ্যাথেন্সের রাষ্ট্রীয় কর্ণধারদের দিকনির্দেশনার জন্য এবং মানুষের মনে বিনোদন ফিরিয়ে দিতে নাট্যদেবতা ডায়োনিসাস অবশেষে খুঁজে পান নাট্যকার এস্কাইলাসকে। এস্কাইলাস উপযুক্ত কারণ তিনি পূর্বসূরি নাট্যকার অরফিউসের কাছ থেকে নিয়েছেন, হত্যার বিপরীতে জীবনের সুরক্ষাদান ন্যায় এবং সত্য। মিউসিউসের কাছ থেকে শিখেছেন, জীবনের সমান্তরাল চিকিৎসার উৎকর্ষণ। হেসিয়ডের কাছ থেকে জেনেছেন, চাষ আর বাস একে অপরের পরিপূরক। আর হোমারের মহাকাব্য থেকে জেনেছেন, রণাঙ্গনে আর জীবনের কোলাহলে জয়ী হওয়ার কর্মকৌশল। সকলের কাছ থেকে ভাবও আদর্শ গ্রহণ করে স্বকীয় সৃজনকর্ম সম্পন্ন করতে পারায় এস্কাইলাস হয়ে উঠলেন এ্যাথেন্সবাসীর মুক্তির অনুরণন। অনেকটা সেভাবেই স্বাধীন বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় গ্রীসের সফোক্লিস থেকে ব্রিটেনের শেক্সপিয়ার, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মুনীর চৌধুরীর আধুনিকতা থেকে দেশজ লোকরীতি তথা সব রীতি ও বিষয়কে আত্মস্থ ও মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে নাট্যকার-নির্দেশক-অভিনেতা লিয়াকত আলী লাকী ও তার নাট্যদল লোক নাট্যদল আজ ৬ জুলাই প্রতিষ্ঠার তিন যুগ তথা ৩৬ বছর পূর্তির মহেন্দ্রক্ষণে আত্মবিশ্লেষণে গৌরবের, অর্জনে তৃপ্তির এবং পুরোটা সময় কর্মমুখর থাকতে পারার ঐতিহ্যের গর্বিত অংশীদার। অংশীদারিত্বের প্রশ্নে গড়ে প্রতিবছর ন্যূনতম নাটকের ত্রিশটি মঞ্চায়ন, নাটক মঞ্চায়নে মঞ্চ-পথ সমন্বিত করণ, ঢাকাসহ বাংলাদেশের সকল বিভাগে পরিভ্রমণ, দেশের বাইরে সর্বাধিক নাট্যোৎসবে অংশগ্রহণ, জাপান থেকে কিউবা, মোনাকো থেকে তুরস্ক, রাশিয়া থেকে ভারতবর্ষ সর্বত্র সফল মঞ্চায়ন, বড়দের পাশাপাশি শিশু ও যুব নাট্যোন্দলন সৃজন, সম্মানিত নাট্য ব্যক্তিত্বদের সম্মাননা পদক প্রদান, ধারাবাহিকভাবে নাট্য সংশ্লিষ্ট কর্মশালা, নাট্যবান্ধব সমাজ বিনির্মাণ লোকনাট্যদলের ভাবও আদর্শের বর্ণিল প্রতিফলন। প্রতিফলন আর উৎসমূলে ফিরে অবলোকন এবং লোকনাট্যদলের আগামী পথপরিক্রমা পরিকল্পন প্রভৃতির প্রেক্ষাপট নিয়ে গত ৫ জুলাই ২০১৭ থেকে আরম্ভ হয়ে আগামী ৮ জুলাই ২০১৭ পর্যন্ত বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায়, পরীক্ষণ থিয়েটার হল ও সেমিনার হলে উদযাপিত হচ্ছে লোকনাট্যদল ৩ যুগ পূর্তি উৎসব। উৎসবে উদ্বোধন, আলোচনা, সেমিনারের পাশাপাশি রয়েছে লোকনাট্যদলের কর্ণধার লিয়াকত আলী লাকী নির্দেশিত আটটি নাটকের মঞ্চায়ন। গতকাল জাতীয় নাট্যশালার উদ্বোধনী পর্ব শেষে মঞ্চায়িত হয় সুকুমার রায়ের অবাক জলপান। প্রশ্ন না শুনে উত্তর দেয়ার বাড়বাড়ন্ত আর নির্বোধের অতি আস্ফালনের নাটক অবাক জলপান দর্শককে নির্মল আনন্দে ভরিয়ে তোলে। অবাক জলপান শেষে মঞ্চায়িত হয় নাটক কঞ্জুস। প্রাণ থেকে অধিক অর্থ প্রিয় এক কৃপণ তথা কঞ্জুসের কৃপণতার নাটক কঞ্জুস। পুরান ঢাকার অধিবাসীদের জীবনাচার, হিন্দী গানের প্যারোডি আর অভিনেতা-অভিনেত্রীদের তারুণ্যদীপ্ত অভিনয় উৎসবের প্রথম দিনকে আনন্দে ভরিয়ে তোলে। আনন্দে ভরিয়ে তোলা নয় বরং বর্তমান সময়ে মূল্যবোধের ব্যাপক বিবর্তন নিয়ে সাহিত্যে নোবেল জয়ী চীনা নাট্যকার গাও সিং জিয়ানের নাটক ‘নকটার্নাল ওয়ানডারার’ অবলম্বনে আবদুস সেলিমের অনুবাদে নাটক মাঝরাতের মানুষেরা। জাতীয় নাট্যশালার ৬.৩০ এ আরম্ভ হওয়া আলোচনা শেষে মঞ্চন্থ হবে নাটকটি। নাটকটিতে দেখা যায়, চলন্ত ট্রেনে টিকেট চেকার মস্তানের কাছে টিকেট চেয়ে পায় না কারণ মস্তানের পকেট কাটা গেছে। দেহ পসারিণীর অবাক বিস্ময়, প্রলোভন ছেড়ে টিকেট চাওয়া কেন? নেশাখোরদের হিসাব মেলে না, ধূমপান নিষেধ বোর্ড টাঙিয়ে এভাবে মানবধিকারও লঙ্ঘন করা যেতে পারে! একমাত্র টিকেট কাটা যাত্রাটি পঞ্চাশ টাকা অধিক ফাইন গুনছে কারণ তৃতীয় শ্রেণীর টিকেট কেটে দ্বিতীয় শ্র্রেণীতে চড়ছে বলে, যদিও আস্ত ট্রেনের কোথাও তৃতীয় শ্রেণীর বগি নেই। বগির মতো খ- খ- অংশ অভিনয়ে ব্রিটিশ শাসনামল ধরে দেশ ভাগ, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর শৈশব-কৈশোর, তেজোদীপ্ত যৌবন, দেশ স্বাধীন, স্বপ্ন সৃজন-ভঙ্গ-পুনর্নির্মাণ প্রকৃতির প্রেক্ষাপট নিয়ে নাটক মুজিব মানে মুক্তি শুক্রবার জাতীয় নাট্যশালায় বিকেল ৪টায়। বিকেল পাঁচটায় ডাকঘর এবং ছয়টায় রথযাত্রা সন্ধ্যা ৭টায় একই দিন পরীক্ষণ থিয়েটার হলে ময়মনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে পদাবলি যাত্রা সোনাই মাধব। দেওয়ান ভাবনার আগ্রাসানের সামনে দাঁড়িয়ে মাধবের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শনে সোনাইয়ের আত্মত্যাগ নিয়ে যে মরমীগাথা তা দর্শকদের চোখে অশ্রু ঝরায়। ঝড়-বৃষ্টি-রোদ তথা সকল অবস্থায় লোকনাট্যদল যেভাবে কর্মমুখর সময় পার করেছে, করছে এবং করবে বলে দৃঢ় সঙ্কল্প তা প্রবন্ধে উপস্থাপন করবেন প্রাবন্ধিক আশীষ গোস্বামী তার প্রবন্ধে ‘লোকনাট্যদলের কর্মমুখর তিন যুগ’ শিরোনামে উৎসবের সমাপনী দিন তথা শনিবার সকাল ১১টায় শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার হলে। উৎসব সমাপনী হবে ওই দিন লীলাবতী আখ্যান নাটক মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে। লোকনাট্যদলের তিন যুগ পূর্তি উৎসব উদযাপিত হবে ব্যাপক লোকের অংশগ্রহণে, এই বিশ্বাস ও আস্থায় লোক নাট্যদলের সকল নাট্যকর্মী, নাট্যানুরাগী দর্শকদের আসার অপেক্ষায় আপ্যায়নের বরণ ঢালী নিয়ে হৃদ্যতা ও ভালবাসায়।
×