ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চার শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ॥ ৬০ গ্রাম প্লাবিত

কক্সবাজার সিলেট ॥ পানিবন্দী ৮ লাখ

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৬ জুলাই ২০১৭

কক্সবাজার সিলেট ॥ পানিবন্দী ৮ লাখ

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ প্রবল বর্ষণ আর পাহাড়ী ঢলের কারণে বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় স্থায়ী বন্যা দেখা দিয়েছে। সুরমা নদীর পানিও বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে কক্সবাজার জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষত না শুকাতেই ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে আবারও তলিয়ে গেছে অন্তত ৬০ গ্রাম। পানিবন্দী আছে ৫ লাখ মানুষ। এর ফলে প্রয়োজনীয় ত্রাণ না থাকায় দুর্গত মানুষের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। এসব এলাকায় ত্রাণ তৎপরতা জোরদার করার দাবি উঠেছে। অন্যদিকে কুড়িগ্রামে দ্রুত বাড়ছে ব্রহ্মপুত্রের পানি। ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী। খবর স্টাফ রিপোর্টারদের পাঠানো। সিলেট অফিস জানায়, পাহাড়ী ঢল অব্যাহত থাকায় নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্নস্থানে বন্যার কারণে বাড়িঘর ও নলকূপ পানিতে ডুবে যাওয়ায় বিশুদ্ধ খাবার পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এসব এলাকায় পানিবাহিত রোগ ও ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছে। টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে সিলেট ও মৌলভীবাজারের বিস্তীর্ণ এলাকায় স্থায়ী বন্যা দেখা দিয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় পানিবন্দী মানুষের দুর্ভোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, দুই জেলার ১১৪৪টি গ্রামের প্রায় ৩,০৩,৭৫৫ জন মানুষ বন্যাকবলিত হয়েছে। বন্যায় ডুবে যাওয়ায় বা সংযোগ সড়ক প্লাবিত হওয়ায় ইতোমধ্যে দুই জেলায় ৪০০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়াও দুই জেলায় মোট ৪৪টি আশ্রয় কেন্দ্র চালু করেছে প্রশাসন যাতে মোট ১০৯৬টি পরিবার আশ্রয় গ্রহণ করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী সুরমা নদীর পানি সিলেটের কানাইঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৫৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে ও সুনামগঞ্জ পয়েন্টে ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুশিয়ারা নদীর পানি বিয়ানীবাজারের শেওলা পয়েন্টে ৭৩ সেন্টিমিটার ও শেরপুর পয়েন্টে ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিলেট জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী সিলেটে বন্যাকবলিত জকিগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, ওসমানীনগর ও বালাগঞ্জ, দক্ষিণ সুরমা ও কানাইঘাট উপজেলার মোট ৪৬৬টি গ্রামের ১,৩৮,৭৫৫ জন মানুষ বন্যাকবলিত হয়েছেন। আর জেলার ১১টি আশ্রয় কেন্দ্রে ১৪৫টি পরিবার আশ্রয় গ্রহণ করেছে। মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, জেলার মধ্যে বড়লেখা, জুড়ী ও কুলাউড়া উপজেলা মূলত বন্যাকবলিত হয়েছে। এছাড়াও রাজনগর, সদর উপজেলা ও কমলগঞ্জের আংশিক এলাকা বন্যাকবলিত রয়েছে। জেলায় ৩৩টি ইউনিয়নের ৭২২টি গ্রাম বন্যায় প্লাবিত হয়েছে যার মধ্যে ১,৬৫,০০০ মানুষ বন্যা আক্রান্ত হয়েছেন। মৌলভীবাজারে বন্যার্তদের আশ্রয়ে ৩৩টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে, যাতে ২৭৭টি পরিবার আশ্রয় গ্রহণ করেছে। বন্যার পানিতে রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় প্রতিটি গ্রামের সঙ্গে উপজেলা ও জেলা সদরের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। কক্সবাজার স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার থেকে জানান, গত তিনদিন ধরে আষাঢ়ী ভারি বর্ষণে কক্সবাজারের চার উপজেলার পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বন্যা পরিস্থিতির অবনতি দেখা দেয়ায় স্থানীয় লোকজন নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষত না শুকাতে আবারও জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পাহাড়ী ঢল ও জোয়ারের পানিতে উপকূলীয় এলাকা পানির সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। বিপদসীমার ওপর পানি চলাচল করছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ। মিঠাপানির তিন নদী চকরিয়ার মাতামুহুরি, ঈদগাঁওর ফুলেশ্বরী ও কক্সবাজারের বাঁকখালীতে পাহাড়ী ঢল নেমে এবং পূর্ণিমার জোয়ারের তীব্রতায় ভেঙ্গে গেছে ঈদগাঁওর রাবারড্যাম এলাকার নদীর বাঁধসহ একাধিক বেধিবাঁধ। এতে নিম্নাঞ্চলের অন্তত ৬০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ডুবে গেছে অর্ধশত গ্রামের রাস্তা-ঘাট, বাসা-বাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ফসলের মাঠ। ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে অভ্যন্তরীণ প্রায় সড়ক। কক্সবাজার সদর, রামু, উখিয়া, চকরিয়া ও পেকুয়ার নিম্নাঞ্চলের প্রায় বসতি পানির নিচে। জেলা প্রশাসক মোঃ আলী হোসেন জালালাবাদ ঈদগাঁহ-পোকখালী সড়কের ভাঙ্গন কবলিত স্থান ও জালালাবাদ রাবারড্যাম পয়েন্টে ভাঙ্গনকৃত বেড়িবাঁধ পরিদর্শন করে লরাবাক গ্রামেসহ ভাঙ্গন কবলিত স্থানগুলো পুনঃমেরামতের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ প্রদান করেন। প্রবল বৃষ্টিতে কক্সবাজার জেলার অধিকাংশ এলাকায় বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। দিনের পর দিন বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে সদরের বৃহত্তর ঈদগাঁওতে। টানা বৃষ্টি এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলের কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিদিন প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। পানির তীব্রতায় ক্রমশ বাড়ছে ভাঙ্গন এবং পরিসর বৃদ্ধি পাচ্ছে ভাঙ্গন এলাকার। এখানে গত দু’দিন ধরে বন্ধ রয়েছে বিদ্যুত সরবরাহ এবং ঈদগাঁও’র সঙ্গে ফরাজীপাড়া এবং পোকখালীর সড়ক যোগাযোগ। বন্যার পানিতে ব্যাপকভাবে প্লাবিত হয়েছে ঈদগাঁও দরগাহপাড়া, ভোমরিয়াঘোনা, কালিরছড়া, ভাদিতলাসহ বহু গ্রাম। চৌফলদন্ডীর ঘোনাপাড়া, নতুন মহাল, কালু ফকিরপাড়া, উত্তর পাড়া, সিকদার পাড়া এবং মাইজপাড়ায় সাগরের জোয়ার ও বৃষ্টির পানি ঈদগাঁও’র রাবার ড্যামের ভাঙ্গা অংশ দিয়ে প্রবেশ করা ঢলের পানিতে গ্রামগুলো প্লাবিত হয়েছে। পোকখালী ইউপি চেয়ারম্যান রফিক আহমদ জানান, গোমাতলী গ্রামের অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়ে পড়েছে। ভেঙ্গে পড়েছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। ভারুয়াখালী ও ইসলামপুরের নিম্নাঞ্চলও বন্যা, বৃষ্টি এবং জোয়ারে ৩-৪ ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এদিকে বার্ষিক পরিকল্পণা অনুযায়ী শনিবার থেকে শুরু হতে যাচ্ছে বৃহত্তর ঈদগাঁও’র মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা। বন্যায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার কারণে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার লোকজন জরুরী ভিত্তিতে ত্রাণ তৎপরতা শুরু করার দাবি জানিয়েছে। মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলের পানিতে নদীর বাঁধ উপচে পানি প্রবেশ করায় বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। পানিতে তলিয়ে গিয়ে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। চকরিয়া-মহেশখালী সড়কের চকরিয়ার বাটাখালী পয়েন্টে সড়ক দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় বাধ্য হয়ে লোকজন নৌকায় যাতায়াত করছে। ডুলাহাজারা পাগলির বিল ছড়াখালের বাঁধ ভেঙ্গে লোকালয়ে পানি ঢুকে কয়েকটি গ্রামের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। কুরুইল্যারকুম পয়েন্টে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে ঢুকে পড়ছে বানের পানি। খুটাখালীতে পিয়াজ্জ্যাকাটা, হরইখোলা, পূর্বপাড়া, অফিসপাড়া, নাপিতপাড়া, চড়িবিল, দরগাহপাড়া, কিশলয় স্কুল, ফরেস্ট অফিস, মাইজপাড়া, হাফেজখানা, দক্ষিণ পাড়া, খুটাখালী উচ্চ বিদ্যালয়, জলদাশ পাড়া, উত্তর ফুলছড়ি পেকুয়ার পূর্ব মেহেরনামা, মোরার পাড়া ও শীলখালী হাজীর ঘোনা, মাঝের ঘোনা, জারুলবনিয়ার এলাকার শত শত ঘরবাড়ি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। রামু উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রিয়াজ উল আলম জানান, ভারি বর্ষণে রামুর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কসমূহ বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বর্তমানে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। ধাপে ধাপে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্ষেত খামার, বিভিন্ন ধমীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান পানিতে ডুবে যায়। যেভাবে উজান থেকে পানি নেমে আসছে, তাতে নদীর পানি আরও বাড়বে। এসব বিষয়ে নদী সংলগ্ন এলাকাগুলোর সার্বিক খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে। জেলা প্রশাসক মোঃ আলী হোসেন বলেন, ‘চকরিয়ায় বন্যা পরিস্থিতি প্রকট আকার ধারণ করেছে। ঈদগাহ এবং রামুতেও পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। সব স্থানের বন্যা কবলিত মানুষকে সহযোগিতা করা হবে। এরই মধ্যে চকরিয়ার জন্য এক লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অন্যান্য এলাকার জন্যও বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আবহাওয়া অধিদফতর কক্সবাজার স্টেশনের আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক বলেন, রবিবার সকাল থেকে শুরু হওয়া ভারি বর্ষণ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। কুড়িগ্রামে চরের নিচু এলাকা প্লাবিত কুড়িগ্রামের প্রধান-প্রধান নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্রের পানি বাড়ছে দ্রুত গতিতে। গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রের চিলমারী ও নুনখাওয়া পয়েন্টে ৩২ সেন্টিমিটার করে পানি বেড়েছে। এই গতিতে পানি বাড়লে দু’একদিনের মধ্যে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। পানি বাড়ার ফলে এরই মধ্যে দুই শতাধিক চর ও দ্বীপচরের নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। অনেকের ঘরবাড়িতে পানি ঢুকেছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় ১০ হাজার পরিবারের ৫০ হাজার মানুষ। ডুবে গেছে পাট, আউশ, সবজিসহ কিছু ফসল। এছাড়াও ভাঙ্গনে গৃহহীন হয়েছে প্রায় শতাধিক পরিবার। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ধরলা নদীতে ১২ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্র নদের নুনখাওয়া পয়েন্টে দশমিক ৩২ সেন্টিমিটার এবং ব্রহ্মপুত্র নদের চিলমারী পয়েন্টে দশমিক ৩০ সেন্টিমিটার ও কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তায় ১ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। চিলমারীতে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার দশমিক ৬৫ সেন্টিমিটার এবং নুনখাওয়া পয়েন্টে ২ দশমিক ২৪ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী সরকার জানান, ব্রহ্মপুত্রের পানি বাড়ার ফলে ইউনিয়নের ১০টি চরের প্রায় দেড় হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়েছে। পোড়ারচরের বাসিন্দা শরিফুল হক জানান, পানিবন্দী প্রায় ৩৫টি পরিবার আবাসন প্রকল্পের গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। মেম্বার মানিক মিয়া জানান, ভগবতিপুরে প্রায় ৫০টি পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
×