ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কুমিল্লায় গায়েবি শিক্ষক নিয়োগ

ভুয়া বিল ভাগবাটোয়ারা

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ৬ জুলাই ২০১৭

ভুয়া বিল ভাগবাটোয়ারা

মীর শাহ আলম, কুমিল্লা থেকে ॥ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ফাতেমা নার্গিস নামে ভুয়া শিক্ষককে মন্ত্রণালয় থেকে গায়েবি নিয়োগ দেয়ার চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। এর মাধ্যমে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা শিক্ষা অফিসারসহ সংশ্লিষ্টরা মোটা অঙ্কের উৎকোচ গ্রহণসহ যোগসাজশে সরকারের সাত লক্ষাধিক টাকা উত্তোলন করে আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বাতিশা ইউনিয়নের দৈয়ারা বরৈয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় জেলা ও উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকসহ এলাকায় তোলপাড় চলছে। তবে এ বিষয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার বলেন, ওই শিক্ষকের কোন তথ্য আমার দফতরে নেই, বিষয়টি দেখার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট উপজেলা শিক্ষা অফিসারের। জানা গেছে, চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বাতিশা ইউনিয়নের দৈয়ারা বরৈয়া রেজি: প্রাথমিক বিদ্যালয়টি দ্বিতীয় পর্যায়ে সরকারীকরণের জন্য ওই বিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষক ইমরান হোসেন, ফাতেমা আক্তার, তাসলিমা আক্তার ও ফাতেমা আক্তারসহ চারজনের নাম ২০১৩ সালের ১৪ জুলাই চৌদ্দগ্রাম উপজেলার তৎকালীন নির্বাহী অফিসার ও শিক্ষক যাচাই-বাছাই কমিটির আহ্বায়ক মোতাহার হোসেন, সদস্য সচিব ও তৎকালীন উপজেলা শিক্ষা অফিসার সাইদা আলমসহ পাঁচ সদস্যের কমিটির স্বাক্ষরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে যাচাই-বাছাই করে শিক্ষকদের নামের তালিকা ২০১৬ সালের ২৩ জুলাই চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বর্তমান শিক্ষা অফিসার ফাতেমা নাসরিনের স্বাক্ষরে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের মাধ্যমে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। এরপর ২০১৬ সালের ২০ জুন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্মারক নং-২০৩ মূলে দ্বিতীয় পর্যায়ে সরকারীকরণের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের তালিকা প্রকাশ করা হয়। ওই তালিকায় শিক্ষকদের নামের কলামে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের দৈয়ারা বরৈয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে ফাতেমা নার্গিসের নাম উল্লেখ না থাকলেও মন্তব্যের কলামে বলা হয় ‘বর্ণিত বিদ্যালয়ে ৪নং ক্রমিকের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা আক্তারের স্থলে ফাতেমা নার্গিস শিক্ষক হিসেবে দাবি করেন। বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে নিষ্পত্তি করা হবে।’ সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয় থেকে ফাতেমা নার্গিস নামের ওই শিক্ষকের নিয়োগের বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে নিষ্পত্তির কথা বলা হলেও জেলা কিংবা উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে ফাতেমা নার্গিসের চাকরিতে নিয়োগ, যোগদান কিংবা ২টি যাচাই-বাছাই কমিটি কর্তৃক মন্ত্রণালয়ে প্রেরিত তালিকার কাগজপত্রে ফাতেমা নার্গিসের নাম কোথাও না থাকলেও কোন রকম তদন্ত ছাড়াই রহস্যজনক কারণে দায়সারা প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। তবে মন্ত্রণালয় ও চৌদ্দগ্রাম উপজেলা শিক্ষা অফিসের দুর্নীতিপরায়ণ ও জালিয়াত চক্রের যোগসাজশে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২০১৬ সালের ১ ডিসেম্বর স্মারক নং-৪০৭ মূলে জারিকৃত অফিস আদেশে জাতীয়করণ করা চট্টগ্রাম বিভাগের ৯৯নং ক্রমিকে চৌদ্দগ্রাম উপজেলার দৈয়ারা বরৈয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের নামের তালিকার ২নং ক্রমিকে ফাতেমা নার্গিসের নাম গায়েবিভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং এ তালিকা থেকে ইতোপূর্বে প্রেরিত ২টি তালিকায় ২নং ক্রমিকে ফাতেমা আক্তারের নাম বাদ দেয়া হয়। সূত্র আরও জানায়, মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত শিক্ষকদের ওই তালিকায় গায়েবিভাবে ফাতেমা নার্গিসের নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর তা যাচাই-বাছাই না করে উপজেলা শিক্ষা অফিসের জালিয়াত চক্র যোগসাজশে বিদ্যালয়টির শিক্ষক হিসেবে ফাতেমা নার্র্গিসকে এরিয়ার বিল হিসেবে সাত লাখ চার হাজার ৪১১ টাকার বিল তৈরি করে হিসাবরক্ষণ অফিসের মাধ্যমে সোনালী ব্যাংক চৌদ্দগ্রাম শাখা (হিসাব নং- ১০০৬০২৪৯১) থেকে উত্তোলনপূর্বক আত্মসাত করা হয়। বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২নং ক্রমিকে যোগদান করা ফাতেমা আক্তারের জন্মতারিখ ১৬-১২-১৯৮২ এবং ৪নং ক্রমিকে যোগদান করা ফাতেমা আক্তারের জন্মতারিখ ৩০-০৬-১৯৮৯। মন্ত্রণালয় থেকে তদন্তের জন্য ৪নং ক্রমিকের শিক্ষক ফাতেমা আক্তার ও শিক্ষক হিসেবে দাবি করা ফাতেমা নার্গিসের কথা উল্লেখ করা হলেও মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষক তালিকার ২নং ক্রমিকে জালিয়াতির মাধ্যমে ফাতেমা নার্গিসের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয় (জন্মতারিখ ১০-০৯-১৯৭৬ এবং তার চাকরিতে ভুয়া যোগদানের তারিখ ০১-০১-২০০৭)। সরেজমিনে অনুসন্ধানকালে দেখা যায়, মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২০১৬ সালের ১ ডিসেম্বর সরকারী শিক্ষক তালিকা প্রকাশের আগ পর্যন্ত ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষক হাজিরা খাতাসহ কোন রেকর্ডপত্রে ফাতেমা নার্গিসের নাম ছিল না এবং ওই বিদ্যালয়ের ২০১৫ সালের আগস্ট, ২০১৬ সালের ডিসেম্বর ও ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসের মাসিক বিবরণী ও বিদ্যালয়ের হাজিরা খাতায়ও তার নাম নেই। জালিয়াতির মাধ্যমে গত জুন মাসে টাকা উত্তোলনের আগে যোগসাজশে ভুয়া সিল-স্বাক্ষরের মাধ্যমে কাগজপত্র তৈরি করা হয় এবং চলতি বছরের মে-জুন মাসের মাসিক বিবরণী ও বিদ্যালয়ের হাজিরা খাতায় ফাতেমা নার্গিসের নাম অন্তর্ভুক্ত দেখিয়ে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর নেয়া শুরু করা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চৌদ্দগ্রাম উপজেলা শিক্ষা অফিসের এক কর্মচারী জানান, উপজেলা শিক্ষা অফিসার ফাতেমা নার্গিসের চাপের মুখে প্রধান করণিক আবদুল লতিফ, বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ইমরান হোসেন, বিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি ও কমিটির সদস্যদের সিল-স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করা হয়। উপজেলা শিক্ষা ও হিসাবরক্ষণ কার্যালয়ের সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে উপজেলা শিক্ষা অফিসের গত ৬ জুনের বিল নং- ৫২৯, ৫৩০, ৫৩১ ও ৫৩২ মূলে ভুয়া শিক্ষক ফাতেমা নার্গিসের বকেয়া বেতন, উৎসব ভাতা, নববর্ষ ভাতা ও মহার্ঘ্য ভাতার নামে মোট সাত লাখ চার হাজার ৪১১ টাকা উত্তোলন করে ভাগবাটোয়ারা করে নেয়া হয়। সূত্র আরও জানায়, দ্বিতীয় ধাপে সরকারী হওয়া চৌদ্দগ্রামের তিনটি বিদ্যালয়ের ১১ শিক্ষকের বকেয়া বেতন-ভাতা একই সঙ্গে উত্তোলন করা হলেও ফাতেমা নার্গিসের ভুয়া কাগজপত্র তৈরি ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে রফায় বিলম্ব হওয়ায় তার টাকা উত্তোলনে প্রায় ২ মাস সময় লেগে যায়। অনুসন্ধানকালে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও স্থানীয় লোকজন জানায়, বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর ফাতেমা নার্গিস নামের ওই শিক্ষককে কখনও দেখিনি। এ বিষয়ে অভিযুক্ত শিক্ষক ফাতেমা নার্গিসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, তার এক ছোট ভাইয়ের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে কাগজপত্র দাখিল করে তিনি চাকরি পেয়েছেন এবং প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ওই বিদ্যালয়ে কাজ করে আসছেন বলে দাবি করেন। অন্য শিক্ষকরা যেভাবে বকেয়া বেতন-ভাতা পেয়েছে তিনিও সেভাবে পেয়েছেন এবং এ ক্ষেত্রে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ সঠিক নয় বলেও তিনি দাবি করেন। এদিকে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে টাকা উত্তোলনের বিষয়ে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা শিক্ষা অফিসের করণিক আবদুল লতিফ জানান, ওই বিদ্যালয়ের তিন শিক্ষকের বকেয়া বেতন-বিল একই সঙ্গে প্রস্তুত করে টাকা উত্তোলন করা হয়। পরবর্তীতে শিক্ষা অফিসার ফাতেমা নাসরিনের নির্দেশে আমাকে ওই শিক্ষকের (ফাতেমা নার্গিস) বকেয়া বেতন-বিল তৈরি করতে হয়েছে। বুধবার উপজেলা শিক্ষা অফিসার ফাতেমা নাসরিনের সরকারী ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ প্রতিবেদকের পরিচয় পেয়ে ফোনের সংযোগ কেটে দেন। একাধিকবার চেষ্টার পর অফিসের কম্পিউটার অপারেটর মাইনুল ফোন রিসিভ করে বলেন, ম্যাডাম স্কুল ভিজিটে চলে গেছেন। পরে তার মোবাইলে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার নুরুল ইসলাম জানান, ‘মন্ত্রণালয়ে প্রেরিত শিক্ষক যাচাই-বাছাইয়ের কোন তালিকায় ফাতেমা নার্গিসের নাম নেই এবং আমার অফিসেও তার সম্পর্কে কোন তথ্য নেই। তার নাম কীভাবে শিক্ষক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে প্রকাশ হলো কিংবা উপজেলা শিক্ষা অফিসারের অফিস থেকে কীভাবে বকেয়া বেতন-বিল প্রস্তুত এবং টাকা উত্তোলন করা হলো তা আমার জানা নেই। বিষয়টি চৌদ্দগ্রাম উপজেলা শিক্ষা অফিসার (টিও) ভাল জানেন এবং দায়ভারও তার।’
×