ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দীপু মালিক

বিশ্ব ফুটবলে জার্মানির জয় জয়কার

প্রকাশিত: ০৬:৪২, ৫ জুলাই ২০১৭

বিশ্ব ফুটবলে জার্মানির জয় জয়কার

সেমিফাইনাল আর ফাইনাল ট্র্যাজেডির দল বলা হয় জার্মানিকে। ফুটবলের যে কোন আসরে সবসময়ই ফেবারিটের তকমা থাকে তাদের গায়ে। ফাইনাল আর সেমিতে হারের লম্বা মিছিলে যোগ না দিলে জার্মানদের বিশ্ব ফুটবলের সেরা দল আপনাকে বলতেই হতো। সেক্ষেত্রে ব্রাজিলের আগে তাদের নামটিই উচ্চারণ করতে হতো। তবে এখন বোধ হয় সেই সময়টি এসে গেছে। সাফল্যে সাম্বা ছন্দের দেশটিকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে ইউরোপের পাওয়ার হাউসরা। প্রথমবারের মতো ফিফা কনফেডারেশন্স কাপ জিতে সে স্বাক্ষরই রেখেছে জোয়াকিম লোর দল। ২ জুলাই রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গের ক্রেস্টোভোস্কি স্টেডিয়ামে ফাইনাল ম্যাচে কোপা আমেরিকার টানা দুইবারের চ্যাম্পিয়ন চিলিকে ১-০ গোলে হারিয়ে এ কৃতিত্ব দেখিয়েছে বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জার্মানি। পুরো ম্যাচে বলের দখল ও আক্রমণে এগিয়ে থাকলেও জার্মানদের কৌশলে হার মানতে বাধ্য হয়েছেন সানচেজ, ভিদালরা। আর তাতেই সাফল্যের বৃত্ত পূরণ হয়ে গেছে বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের। কেননা এর আগে বৈশ্বিক সব টুর্নামেন্টের ট্রফি জিতলেও কনফেডারেশন্স কাপই শুধু বাকি ছিল। সেটও এবার হয়ে গেল। এখন জার্মানদের শোকেসে চারটি বিশ্বকাপ, তিনটি ইউরো ও একটি কনফেডারেশন্স কাপের ট্রফি। ইউরোর ইতিহাসে জার্মানিই এককভাবে সর্বোচ্চ তিনবার শিরোপা জয় করেছে (১৯৭২, ১৯৮০, ১৯৯৬)। ইউরোতে সর্বোচ্চ তিনবার রানার্সআপ হওয়ার রেকর্ডও জার্মানদের (১৯৭৬, ১৯৯২, ২০০৮)। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে পাওয়া সাফল্যের (১৯৯৬ ইউরো) পর দীর্ঘ ১৮ বছর বড় কোন আসরের শিরোপা জয় করতে ব্যর্থ হয় অদম্য জার্মানরা। এ সময়ে কি ইউরো, কি বিশ্বকাপ প্রতিটি আসরেই তীরে এসে তরী ডুবে তাদের। ২০০২ বিশ্বকাপের ফাইনালে ব্রাজিলের কাছে হার, ২০০৬ ও ২০১০ বিশ্বকাপে তৃতীয়। অন্যদিকে ২০০৮ ইউরোর ফাইনালে স্পেনের কাছে হেরে রানার্সআপ হতে হয়েছিল। ধারাবাহিক এই কষ্টের বোঝাটা তারা নামাতে পারে ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপে। ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে দীর্ঘ দেড় যুগ পর বড় আসরের ট্রফি জেতে তারা। সাফল্যের এ ধারা এখনও ধরে রেখেছে তারা। দিনকয়েক আগে দেশটির যুবারা জিতেছে অনুর্ধ ২১ বিশ্বকাপের শিরোপা। সবমিলিয়ে এখন ফুটবল বিশ্বে চলছে জার্মানদের জয়জয়কার। এবারের আসরের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়ে ‘গোল্ডেন বল’ এ্যাওয়ার্ড জিতেছেন জার্মান অধিনায়ক জুলিয়ান ড্রাক্সলার। চিলিয়ান আইকন আলেক্সিস সানচেজ ‘সিলভার বল’ ও ‘ব্রোঞ্জ বল’ জিতেছেন ড্রাক্সলারের স্বদেশী মিডফিল্ডার লিওন গোরেটজকা। সর্বোচ্চ গোলস্কোরার তালিকায় জার্মানির একক আধিপত্য। ‘গোল্ডেন বুট’ এ্যাওয়ার্ড জিতেছেন উদীয়মান ফরোয়ার্ড টিমো ওয়ার্নার। সমান তিনটি গোল করলেও সতীর্থদের গোলে সহায়তা (এ্যাসিস্ট) না থাকায় যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানের পুরস্কার হাতে নেন গোরেটজকা ও ফরোয়ার্ড লার্স স্টিন্ডল। ফাইনালে স্বপ্নভঙ্গ হলেও ফিফা প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফান্টিনোর কাছ থেকে সেরা গোলরক্ষকের স্বীকৃতি ‘গোল্ডেন গ্লাভ’ পুরস্কার নিয়েছেন চিলির ব্রাভো। ফেয়ার প্লে এ্যাওয়ার্ড চ্যাম্পিয়ন জার্মানির। দু’দেশের সামনেই ছিল প্রথমবারের মতো কনফেডারেশন্স কাপ জয়ের হাতছানি। ফাইনালে যারা জিতবে তারাই এ কৃতিত্ব দেখাবে। চিলিকে হারিয়ে সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে জার্মানির। এর পর থেকে জার্মানদের চলছে উৎসব। তবে ফাইনালে হারলেও চিলিয়ানদের গৌরবও কোন অংশে কম নয়। দলটির কোচ এ্যান্টোনিও পিজ্জি জানিয়েছেন, তার শিষ্যরা যা করেছে তাতে গৌরব সঙ্গী করেই দেশে ফিরছেন। শিরোপা জয়ের পর উচ্ছ্বাসে ভাসছেন জার্মান কোচ জোয়াকিম লো। তার দৃষ্টিতে ইতিহাস গড়েছে তরুণ শিষ্যরা। শিষ্যদের প্রশংসা করে লো বলেন, এর দাম অনেক। কেননা জার্মানি তাদের ইতিহাসে কখনই এ শিরোপা জিততে পারেনি। তাই এই দল এবং এই জয়ের কথা ইতিহাসে লেখা থাকবে। এই দল অবশ্যই শিরোপার যোগ্য। এ কারণে আমরা সবাই খুব খুশি। ২০১৪ সালে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে ব্রাজিল থেকে বিশ্বকাপ নিয়ে ফেরে জার্মানি। এবার লোর দল জিতল কনফেডারেশন্স কাপ। দুই ট্রফির ভার নিয়ে যেন একটু মজাও করেন জার্মান কোচ। বলেন, এটা বিশ্বকাপের চেয়ে ভারি। টমাস মুলার, টনি ক্রুস, ম্যানুয়েল নিউয়ের, মেসুত ওজিলদের মতো নির্ভরযোগ্যদের রেখে তরুণদের নিয়ে কনফেডারেশন্স কাপের দল সাজিয়েছিলেন কোচ। তরুণ এই দলই বাজিমাত করেছে। বেয়ার্ন মিউনিখের মিডফিল্ডার জশুয়া কিমিচ তাই সতীর্থদের নিয়ে দারুণ খুশি। তিনি বলেন, আমি এবং আমার দল শিরোপা জিতে দারুণ গর্বিত। আসলে কেউই আমাদের গোনায় ধরেনি এবং আমরা দারুণ সব দলকে হারাতে পেরেছি। ম্যাচ শেষে চিলি খুবই হতাশ ছিল এবং আপনারাও দেখতে পেরেছেন, শিরোপাটা তাদের কাছে কতখানি ছিল। আমাদের শেষটা তুলনায় ভাল হয়েছে। এই দলের বিপক্ষে শিরোপা জেতা চমৎকার। আমরা সেইরকম পার্টি করব। এবারের আসরে সবচেয়ে বেশি তিনটি করে গোল করেছেন তিন জার্মান ফুটবলার গোরেটজকা, লার্স স্টিনডল ও টিমো ওয়ার্নার। জার্মানির অধিনায়ক জুলিয়ান ড্রাক্সলার নির্বাচিত হয়েছেন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়। ম্যাচ শেষে তিনি বলেন, আমরা ভাল খেলেছি। জয়টা আমাদেরই প্রাপ্য ছিল। যেকোন শিরোপা জয়ই খুব দারুণ বিষয়। কিন্তু এই তরুণ দলটা নিয়ে শিরোপা জয়টা আরও বিশেষ কিছু। গোলের একাধিক সুযোগ নষ্ট। হজম করা গোলটিও মার্সেলো ডিয়াজের হাস্যকর ভুলে। শেষ পর্যন্ত সেগুলোর চড়া মাশুল দিয়ে জার্মানির কাছে হেরে শিরোপা স্বপ্ন গুঁড়িয়েছে চিলির। তবে দলটির কোচ জুয়ান এ্যান্টোনিও পিজ্জি শিষ্যদের সমালোচনা করেননি। বরং বলেছেন গর্ব নিয়েই ঘরে ফেরার কথা। ম্যাচ শেষের প্রতিক্রিয়ায় হেরে গেলেও সবটুকু নিংড়ে দেয়ার তৃপ্তির কথা জানান চিলিয়ান কোচ। বলেন, আমার লক্ষ্য ছিল এই টুর্নামেন্টে আমাদের পুরো শক্তি ঢেলে দেয়া। আমার বিশ্বাস ছিল, যদি আমরা কোন শক্তি অবশিষ্ট না রেখে ঘরে ফিরি, তাহলে এর মানে হবে পুরোপুরি গর্ব নিয়ে ফেরা। আমি ভেবেছিলাম, আমরা ট্রফিটা নিয়ে ঘরে ফিরতে পারব। তবে আমরা গর্ব নিয়ে ফিরছি, কোন শক্তি সঞ্চিত নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ট্রফি ছাড়া ফিরছি। প্রথমবারের মতো কনফেডারেশন্স কাপ জয়ের হাতছানি ছিল চিলির সামনে। সেটা পূরণ হয়নি। তবে এই অভিজ্ঞতা সামনের পথ চলায় কাজে লাগবে বলে বিশ্বাস পিজ্জির। এ প্রসঙ্গে বলেন, এই প্রথম আমরা এই টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম। এটা আমাদের সবার জন্য, সব খেলোয়াড়ের জন্য দারুণ অভিজ্ঞতা। এমনকি আমাদের দলে যারা অনেক অভিজ্ঞ, তাদের জন্যও। পিজ্জি বলেন, আমরা যে উন্নতি করেছি, তার অর্থ হচ্ছে, বিশ্ব ফুটবলে আমরা দারুণ একটা অবস্থান অর্জন করেছি। আমরা উপলব্ধি করেছি অন্য দলগুলো আমাদের অনেক শ্রদ্ধা করে। কিন্তু আমি জোর দিয়েই বলছি, আমাদের উন্নতি করা চালিয়ে যেতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে সামনের দিকে।
×