ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পাকিস্তানের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ!

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ৫ জুলাই ২০১৭

পাকিস্তানের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ!

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বাজিমাত করল পাকিস্তান। কেনিংটন ওভালের গ্রান্ড ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে হারিয়ে স্বপ্নের শিরোপা উুঁচিয়ে ধরল সরফরাজ আহমেদের দল। ৩৩৮ রানের পাহাড় গড়ার পর প্রতিপক্ষকে ১৫৮ রানে গুটিয়ে দেয় পাকিস্তান। যা সত্যি অবিশ্বাস্য। কারণ এবারের আসরে তাঁরা মোটেও ফেবারিট ছিল না, অন্যদিকে বিরাট কোহলির ভারত আগেরবারের চ্যাম্পিয়ন। যে পাকিস্তানকে কেউ গোনায় ধরেনি, ওভালে চিরশত্রু ভারতকে লজ্জায় ডুবিয়ে সেই তাদেরই হাতে ওয়ানডে ফরমেটের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেতাব। সেটিও এমন দু-জনের পারফর্মের ওপর ভর করে টুর্নামেন্টের আগে অনেকেই যাঁদের চিনতেনই না। বিরাট কোহলি, ইয়ন মরগান, স্টিভেন স্মিথ, এবি ডি ভিলিয়ার্সদের মøান করে পাকিদের সাফল্যের নেপথ্যের নায়ক ফখর জামান ও হাসান আলি নামের দুই নবীন। আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির অষ্টম আসরে পাকিস্তানের এটি প্রথম শিরোপা। আগের সাত চ্যাম্পিয়ন দক্ষিণ আফ্রিকা (১৯৯৮, রানার্সআপ ওয়েস্ট ইন্ডিজ), নিউজিল্যান্ড (২০০০, রানার্সআপ ভারত), শ্রীলঙ্কা-ভারত যৌথভাবে (২০০২), ওয়েস্ট ইন্ডিজ (২০০৪, রানার্সআপ ইংল্যান্ড), অস্ট্রেলিয়া (২০০৬, রানার্সআপ ওয়েস্ট ইন্ডিজ), অস্ট্রেলিয়া (২০০৯, রানার্সআপ নিউজিল্যান্ড) ও ভারত (২০১৩, রানার্সআপ ইংল্যান্ড) ভারত-পাকিস্তান ফাইনালে ওঠায় বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনই নড়েচড়ে বসেছিল। কিন্তু ম্যাচটা হয়েছে একতরফা। ফেবারিট কোহলিরা পাত্তাই পায়নি সরফরাজদের কাছে। তরুণ ফখর জামান (১১৪), অভিজ্ঞ আজহার আলি (৫৯) ও মোহাম্মদ হাফিজের (৫৭*) দূরন্ত ব্যাটিংয়ে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৪ উইকেটে ৩৩৮ রানের পাহাড় গড়ে পাকিস্তান। জবাবে মোহাম্মদ আমির (৩/১৬), হাসান আলির (৩/১৯) দুর্ধর্ষ বোলিং সামলাতে ব্যর্থ গতবারের চ্যাম্পিয়ন ভারত ৩০.৩ ওভারে ১৫৮ রানেই অলআউট! গ্রুপ পর্বে বড় হারের পর অনেকে শত্রুদেশের বিপক্ষে পাকিদের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। ওভালে সেই তাদেরই উড়িয়ে দিয়ে স্বপ্নের শিরোপা সরফরাজদের হাতেÑ এর চেয়ে ভাল জবাব আর হতে পারত না! পাকিস্তান বড় স্কোর গড়ার পরও প্রতিপক্ষ ভারত বলেই ক্রিকেটপ্রেমীরা ভাল ক্রিকেট দেখার অপেক্ষায় ছিলেন। তাতে অবশ্য গুড়েবালি। ৩৩ রানের মধ্যে টপ-অর্ডারের তিন তারকা রোহিত শর্মা (০), বিরাট কোহলি (৫), আর শিখর ধাওয়ানকে (২১) সাজঘরে ফিরিয়ে শুরুর আগেই ম্যাচ শেষ করে দেন আমির! নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারানো ভারতকে ক্ষণিকের আনন্দ দিয়েছেন হারদিক পান্ডিয়া। ৪ চার ও ৬ ছক্কায় ৪৩ বলে ৭৬ রান করে রানআউট হন তিনি। যুবরাজ সিং ২২ ও রবিন্দ্র জাদেজা ১৫ ছাড়া আর কেউ দুই অঙ্ক ছুঁতে পারেননি। লেগস্পিনার শাদাব খান নিয়েছেন ২ উইকেট। ওয়ানডে অধিনায়কের দায়িত্ব পাওয়ার পর সরফরাজ আহমেদের এটি ছিল প্রথম টুর্নামেন্ট। শুরুতেই বাজিমাত। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে উড়িয়ে দিয়ে স্বপ্নীল-সাফল্য। আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির অষ্টম আসরে প্রথম শিরোপার স্বাদ পেল পাকিস্তান। সরফরাজ তাই যারপরনাই উচ্ছ্বসিত। গর্বভরে বলছেন, ‘মানুষ কী বলল সেটা নয়, আমরাই চ্যাম্পিয়ন।’ উচ্ছ্বসিত সরফরাজ বলেন, ‘এই টুনার্মেন্টের সাফল্য আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে সহায়তা করবে। হারানোর কোন চিন্তা ছাড়াই এখানে খেলতে এসেছিলাম এবং আমরা এখন চ্যাম্পিয়ন। এটা আমার এবং দেশের জন্য বেশ গর্বের। আমাদের সমর্থন দেয়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘ভারতের বিপক্ষে গ্রুপ ম্যাচে হারের পর ছেলেদের বলেছিলাম, আমাদের জন্য টুর্নামেন্ট শেষ হয়ে যায়নি। আমরা বেশ ভাল খেলেছিলাম এবং এখন ফাইনালেও জয় পেয়েছি। ফখর খুবই কার্যকর একজন খেলোয়াড়। নিজের প্রথম আইসিসি টুর্নামেন্টেই সে চ্যাম্পিয়নের মতো খেলেছে। পাকিস্তানের জন্য সে অসাধারণ একজন খেলোয়াড় হতে পারবে।’ ৩৩৯ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নামা ভারতকে মাত্র ১৫৮ রানেই অলআউট করে পাকিস্তানী বোলাররা। তাই নিজেদের বোলারদের প্রশংসা করে সরফরাজের বক্তব্য, ‘আমি সব প্রশংসা বোলারদের দিতে চাই। আমির, হাসান আলী, সাদাব, জুনায়েদ, হাফিজসহ প্রত্যেকে সত্যিই বেশ দারুণ বোলিং করেছে। আমাদের দলটি তরুণ আমি সবাইকে এ জয়ের কৃতিত্ব দিতে চাই।’ গ্রুপ পর্বে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের কাছে ১২৪ রানের লজ্জার হার দিয়ে আসর শুরু করে পাকিস্তান। আহমেদ শেহজাদ-ওয়াহাব রিয়াজদের মতো তারকার ভিড়ে সেই ম্যাচে এই দু-জনের কারোই একাদশে জায়গা হয়নি ফখর জামান ও হাসান আলির। শেষ চারের আশা বাঁচিয়ে রাখতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জিততেই হবে, এমন কঠিন ম্যাচেই চূড়ান্ত রিস্কটা নেয় পাকিস্তান ম্যানেজমেন্ট। ওয়াহাবকে ড্রপ দিয়ে পেসার হাসানকে ফেরানো হয়, আর ওপেনিংয়ে আজহার আলির সঙ্গী হন অভিষিক্ত ফখর। ৩১ রান করে প্রতিভার জানান দেয়া ফখর এরপর প্রতিটি ম্যাচে নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন। গ্রুপ পর্বে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে শেষ ম্যাচে ৫০, সেমিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৫৭, অতপর ফাইনালের এই সেঞ্চুরি! রাঘব-বোয়াল সব বোলারদের তুলোধুনো করে রানের বন্য বইয়ে দিয়েছেন ২৭ বছর বয়সি আনকোড়া এক ব্যাটসম্যান। ১ সেঞ্চুরি ও ২ হাফ সেঞ্চুরিতে ৪ ম্যাচে ৬৩ গড়ে করেছেন ২৫২ রান। স্ট্রাইক রেট ১১৩। অন্যদিকে প্রথম ম্যাচে ভারতের কাছে হারের পর ঘুড়ে দাঁড়ানোর মূল কারিগর হাসান আলি। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ২৪ রানে ৩ উইকেট। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাঁচন-মরণ ম্যাচে ৩ উইকেট ৪৩ রানের বিনিমেয়। সেমিতে ইংলিশদের উড়িয়ে দেয়ার দিনে তো আগের তিন ম্যাচকেই ছাড়িয়ে গেলেন। ৩৫ রানে ৩ উইকেট নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ম্যাচসেরা। ফাইনালে ফের ৩ উইকেট। আসরে পাঁচ ম্যাচের প্রতিটাতেই উইকেট পেয়েছেন। এর মধ্যে সর্বশেষ চার ম্যাচে টানা ৩টি করে! আর সব মিলিয়ে মোট ১৩ উইকেট পাওয়ায় টুর্নামেন্ট সেরা নির্বাচিত হয়েছেন। বল হাতে আসরজুড়ে সর্বোচ্চ উইকেটের জন্য গোল্ডেন বলের পুরস্কার। ১৪.৬৯ গড়ে ৪.২৯ ইকোনমি রেটে এ পুরস্কার পান তিনি। দুর্দান্ত ক্রিকেটশৈলী প্রদর্শন করে বিশ্বব্যাপী প্রশংসা কুড়িয়েছে সরফরাজ আহমেদের দল। দেশটির মিডিয়ার প্রথম পাতা জুড়ে এখন কেবল ফখর জামান-হাসান আলিদের ছবি। মাঠে না থেকেও তুখোড় তারকা শহীদ আফ্রিদি এটিকে স্মরণীয় সাফল্য বলে উল্লেখ করেছেন। কষ্ট চেপে সরফরাজদের অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রতিপক্ষ অধিনায়ক বিরাট কোহলিও। এমনকি পাকিস্তানে মুগ্ধ বলিউডের বড় বড় সব অভিনেতা। সেই তালিকায় আছেন অমিতাভ বচ্চনও। টুইটারে বিগ বি লিখেছেন,‘চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে জেতায় পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে শুভেচ্ছা। সত্যিই, তোমরা সেরা দল।’ এভাবে একের পর এক টুইট করে সরফরাজদের প্রশংসায় ভাসিয়েছেন ফারহান আকতার, রণবীর সিং, সিদ্ধার্থ মালহোত্রা, রণদীপ হুদা, দিয়া মির্জা, বরুন দেয়ানসহ আরও অনেকেই। শহীদ আফ্রিদি বলেন, ‘ফাইনালের মতো এমন নিখুঁত পারফর্মেন্স আমি খুব কমই দেখেছি এবং ছন্দে থাকা হট-ফেবারিট ভারতের বিপক্ষে এ জয় সুখকর। এই পাকিস্তান আমাকে ও দেশকে গর্বিত করেছে। সরফরাজ আহমেদের দলের এমন বিস্ময়কর সাফল্যে আমি সম্পূর্ণভাবে আনন্দে আত্মহারা।’ ১৯৯২ সালে ফেবারিট না হয়েও এভাবে বিশ্বকাপ জিতেছিল ইমরান খানের পাকিস্তান। আফ্রিদি আরও যোগ করেন, ‘এমন ঘুরে দাঁড়ানো সাফল্য বিশ্বজুড়ে পাকিস্তানীদের পরম আনন্দের উপলক্ষ এনে দিয়েছে। ম্যাচ শেষের পরই ১৯৯২ বিশ্বকাপ ও ২০০৯ টি-২০ ওয়ার্ল্ডকাপের মতো দেশজুড়ে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জয়ের উৎসব উদযাপনে মেতে উঠেছে সবাই।’ আফ্রিদি বলেন, ‘২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জয় পাকিস্তানী সমর্থকরা দীর্ঘ সময় মনে রাখবেন। ভক্তরা, বিশেষ করে তরুণরা, যারা দেখেছে তাদের টিম ভারতকে উড়িয়ে দিয়েছে, যা ভবিষ্যতের তারকা হতে সাহায্য করবে।’ প্রতিপক্ষ অধিনায়ক কোহলিরও প্রশংসা পেয়েছে দারুণ খেলা পাকিস্তান, ‘পাকিস্তান দলকে অভিনন্দন জানাই। তারা বিস্ময়কর একটি টুর্নামেন্ট খেলেছে। বাজে শুরুর পর যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তাতে বোঝা যায় তাদের দলে প্রতিভার অভাব নেই। নিজেদের দিনে যে কোন দলকেই যে তারা হতাশ করতে পারে সেটা আরেকবার প্রমাণ করেছে।’ বলেন তিনি।
×