ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

ইউরোপের নতুন ত্রাণকর্তা

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ৫ জুলাই ২০১৭

ইউরোপের নতুন ত্রাণকর্তা

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ আরেক বিস্ময়কর বিজয় অর্জন করেছেন। গত ১১ ও ১৮ জুন দুই পর্বের পার্লামেন্টারি নির্বাচনে তার দল “এন মার্চ”-যার অস্তিত্ব বছর খানেক আগেও ছিল না সেটি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। ৫৭৭ আসনের মধ্যে তার দল পেয়েছে ৩০১টি আসন এবং মিত্র দল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টে (মোডেম) এর সঙ্গে একত্রে মিলে পেয়েছে ৩৫০টি আসন। এর মাত্র ৬ সপ্তাহ আগে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অবিস্মরণীয় বিজয় অর্জন করে ম্যাক্রোঁ বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলেছিলেন। ম্যাক্রোঁর দল ও তার কোয়ালিশন সঙ্গী মিলে মোট আসনের ৬০.৭ শতাংশ পেল। এতে পার্লামেন্টে প্রেসিডেন্ট বেশ শক্তিশালী অবস্থানে থাকার সুযোগ পেলেন। ফ্রান্সের এই দু’দুটি নির্বাচনকে এক অর্থে বিপ্লব বলা চলে। এই দুই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ফ্রান্সের জনগণ রুখে দাঁড়িয়েছে একটি রাজনৈতিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে যারা এতদিন দেশ পরিচালনায় এবং গণমানুষের আশা আকাক্সক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। জনগণের অসন্তোষের মূলে ম্যাক্রোঁ এক নতুন প্রত্যাশা ও নতুন জবাব নিয়ে হাজির হয়েছেন যা পাশ্চাত্যের গণতন্ত্রের নতুন জোয়ার এসেছে। তিনি এক নতুন রাজনীতির অঙ্গীকার করেছেন যা বাম ও ডানের মধ্যেকার বিভাজন দূর করে দেবে। তিনি ফ্রান্সে এবং জার্মানির সহায়তায় ইউরোপীয় ইউনিয়নে নতুন গতিশীলতা ও আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে চান। প্রশ্ন হলো সেটা কি তিনি পারবেন? বলা হচ্ছে ম্যাক্রোঁ হচ্ছে সঠিক সময়ের সঠিক ব্যক্তি। ভোটাররা ফ্রান্সের বাসি ও বন্ধ্যা রাজনীতিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তারা এই বৃত্তের কাউকে চাইছিল। ম্যাক্রোঁ এসটাবলিসমেন্ট থেকে এসেছেন। তিনি এলিট কলেজের স্নাতক। প্রাক্তন ব্যাঙ্কার এবং পূর্বসূরির অধীনে অর্থমন্ত্রী ছিলেন। তবে তিনি কখনও কোন দল করেননি। নবগঠিত এন মার্চ দলটিকে তিনি এমনভাবে তৈরি করেছেন যাতে করে অতীতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য কাজ করতে পারে। দলের অর্ধেক সংখ্যক প্রার্থীই ছিল রাজনীতিতে নবাগত। অর্ধেক প্রার্থী মহিলা। দলের প্রার্থীদের গড় বয়স ৪৩। ম্যাক্রোঁ মধ্যপন্থী। তবে বাম ও ডানদের নীতি নিজের প্রয়োজনমত গ্রহণে তার দ্বিধা নেই। ডানদের মত তিনি চাকরি ও সম্পদ সৃষ্টির জন্য বাজার ও ব্যবসা বাণিজ্য উন্মুক্ত করার পক্ষপাতী। আবার বামদের মত তিনি বিশ্বাস করেন সবকিছু পরিচালনা ও রক্ষা করার জন্য সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। মুক্তদ্বার ও রুদ্ধদ্বারের মধ্যে লড়াইয়ে ম্যাক্রোঁ বাণিজ্য ও অভিবাসন ব্যাপক পরিসরে উন্মুক্ত করার পক্ষে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি একজন উদারপন্থী। বহু দশক ধরে রাজনীতিকরা সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন। কিন্তু সমাধান দিতে পারেননি। ম্যাক্রোঁ কোন না কোনভাবে ফরাসীদের মনে এই প্রত্যয় জন্মিয়েছেন যে সমাধান সম্ভব, অগ্রগতি অর্জন সম্ভব। অভিবাসন ও বিদেশী প্রতিযোগিতা সম্পর্কে বিভিন্ন মহলের হুঁশিয়ারিকে অগ্রাহ্য করে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে এ দুটো ফ্রান্সকে শৃঙ্খলিত করবে না বরং নতুন প্রাণের সঞ্চার করবে। ইইউ সম্পর্কে সংশয়বাদীদের হতাশ করে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে সংস্থাটি ফ্রান্সের শক্তিকে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলবে। প্রেসিডেন্ট পদে ম্যাক্রোঁ ও পার্লামেন্টে তার দলের বিজয় ফরাসী রাজনীতির এতদিনের হিসাব কিতাব সব উল্টে দিয়েছে। এটা তিন ধরনের পরিণতি বয়ে আনতে পারে। এক, ফ্রান্সের দলীয় রাজনীতির চেহারা নতুন করে নির্ধারিত হবে। দুই, রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের শঙ্কা বদলে যাবে এবং তিন, সংস্কারের জন্য নতুন গতিশীলতা সৃষ্টি হবে। তবে ম্যাক্রোঁর সামনে চ্যালেঞ্জ কম নয়। তার একটা হলো বেকারত্ব। বিশেষ করে তরুণদের বেকারত্বের হার অনেক বেশি। গত ৫ বছর ধরে ফ্রান্সের বেকারত্বে হার ১০ শতাংশ যা জার্মানির চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। আর ২৫ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে এই হার গত বছর ছিল ২৫ শতাংশ। বেকারত্ব লাঘব বা চাকরি সৃষ্টির জন্য ম্যাক্রোঁ শ্রম আইন সংস্কারে হাত দেবেন। তাতে কতটুকু সফল হবেন সেটাই এখন দেখার বিষয়। কারণ শ্রম বাজার সংস্কারের অতীতের অনেকরই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। অবশ্য অর্থনৈতিক পটভূমিটা ম্যাক্রোঁর অনুকূলে রয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়তে শুরু করেছে। এবছর প্রবৃদ্ধির হার ১.৪ শতাংশ ও আগামী বছর ১.৭ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস আছে। ব্যবসায়ীদের আস্থা ছয় বছরের মধ্যে এখন সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছে। তারপরেও ম্যাক্রোঁর সামনে পাঁচটা বড় চ্যালেঞ্জ থেকে যাবে। প্রথমত বিভক্ত ফ্রান্সকে ঐক্যবদ্ধ করা। দুই ফ্রান্স ভৌগোলিকভাবে বিভক্ত-একটি নগরকেন্দ্রিক। এরা অধিকতর সমৃদ্ধ ও সংস্কারের পক্ষপাতী অন্যটি গ্রামাঞ্চলের অনুন্নত এলাকা। এই এলাকার মানুষই মূলত লা পেনকে ভোট দিয়েছে। এই দুই অংশের মধ্যে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীগত বিভাজন দূর করাই হবে ম্যাক্রোঁর সামনে মস্ত চ্যালেঞ্জ। শ্রমআইন সংস্কার হবে তার আরেকটি চ্যালেঞ্জ। তিনি ২০২২ সালের মধ্যে বেকারত্বের হার ৭ শতাংশে নামিয়ে আনতে চান। তার জন্য সপ্তাহে ৩৫ ঘণ্টার শ্রম সময় সংক্রান্ত বিধিনিষেধ শিথিল করতে চান। সন্ত্রাসের হুমকি মোকাবেলা হবে ম্যাক্রোঁর আরেক মস্ত চ্যালেঞ্জ। ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে এপর্যন্ত সন্ত্রাসী হামলায় ফ্রান্সে ২৩০ জন নিহত হয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তার যে সক্ষমতা আছে তা প্রমাণের জন্য ম্যাক্রোঁকে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। তার সামনে আরেক চ্যালেঞ্জ হলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংস্কার। এ সম্পর্কে ম্যাক্রোঁর সাহসী ধ্যানধারণা আছে। তবে তিনি কতটুকু সফল হবেন সেটাই এখন দেখার ব্যাপার। সূত্র : দি ইকনোমিস্ট
×