ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অরুণ কুমার বিশ্বাস

রম্যকথন ॥ বানরের তৈলাক্ত বংশারোহণ

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ৫ জুলাই ২০১৭

রম্যকথন ॥ বানরের তৈলাক্ত বংশারোহণ

তেল কী ও কত প্রকার- এ বিষয়ে বোধ করি পাঠকমহল সম্যক অবহিত আছেন। ইদানীং শোনা যায়, বিশ^বাজারে তেলের খুব প্রাদুর্ভাব। কারণটা কী অনুমান করতে পারছেন তো! তেলের মূল্য ক্রমশ পড়তির দিকে। ফলে যা হচ্ছে- বিশিষ্ট তেলুরা এখন হালে পানি পায় না। যে জিনিসের দাম কম ও সাপ্লাই বেশি, তা প্রাপ্তিতে আনন্দ কী! কর্পোরেশনের কলের মতো- নতুন প্রেমের আঠা যেমন, বাঁধে বটে তবে ভোলায় না। যারা তেল প্রদানে অভ্যস্ত, তারা এখন তেলের বদলে অন্য কিছু মর্দনে উৎসাহী হচ্ছে। নইলে ঘরের বউ ও অফিসের বসের কাছে মুখ থাকছে না। এ কী বিষম গেরো বলুন! তেল আর আতেলের মাঝে কিন্তু সম্পর্কটা বড় সুবিধের নয়। এরকম একটা কথা প্রচলিত আছেÑ আতেল তেল খায় না। সত্যিই তাই! এ বিষয়ে গভীর পর্যালোচনায় যাওয়ার আগে আসুন আতেল শব্দটি নিয়ে একটু আতলামি করে আসি। বা মাতলামিও বলতে পারেন। তেল-আতেলে-মাতালে গভীর শত্রুতা। ইংরেজী ইন্টেলেকচুয়াল শব্দের একরকম বাংলা তর্জমা আতেল। বাংলা একাডেমি প্রণীত ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে আতেলের এবংবিধ অর্থ পাওয়া যায়। ওপার বাংলার সংসদ অভিধানে অবশ্য অলোচ্য শব্দটি নেই। তার মানে কি ধরে নেব সব আতেলের জন্ম ও বসবাস এখানেই, মানে বাংলাদেশে! সব না হোক বেশ কিছু আতেল যে এই বঙ্গে করে খাচ্ছে সে কথা সহজেই অনুমেয়। আতেলরা ভিন্ন প্রজাতির মানুষ। এরা সংখ্যায় কম, অথচ একত্রে থাকতে পারে না। কারণ কোন আতেলই নিজেকে বাদে অন্যকে আতেল মানতে নারাজ। আতেলে আতেলে মোটেও সদ্ভাব নেই। একজন চুলে তেল দিলে অন্যজন ঘি মাখবে। কেউ নেকটাই ঝোলালে অন্যটি বাঁধবে বো-টাই। একজন জুতা পরলে অন্যজন পরবে চটি বা খড়ম। যেন বৈপরীত্যেই ওদের আনন্দ। এরা অনেকটা কাঁকড়ার মতো, কেউ কাউকে পথ ছাড়বে না, তাতে সে নিজে যেতে পারুক বা না পারুক। কথায় বলে না, নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা ভঙ্গের মাঝেও পুলক আছে। এই যে আমার বন্ধু সনৎ। চরম আতেল। খাঁটি সাধুভাষা ছাড়া কথা কয় না, করলা ছাড়া খায় না, পোশাক-পরিচ্ছেদে অলওয়েজ মাত্রাজ্ঞান মেনে চলে। শুচিবায়ুও আছে। কথা শুরু ও শেষের মাঝে অন্তত কুড়িবার গলা খাঁকরাবে। অহেতুক লোকের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা। নামখানা দেখুন- কোনরকম কারযুক্ত নয়। স-ন-ৎ! আগে দেখেছেন কখনও! নিজের দেয়া নাম। ও মনে করে নামের সঙ্গে অকারণ প্রেফিক্স-সাফিক্স যোগ করার কোন মানে হয় না। স্র্রেফ নামে ভারি। যাকে বলে বেহুদা রিমিক্স। ওর বয়স আর কত- এই ধরুন টেনেটুনে তেত্রিশ। কিন্তু ভাবখানা এমন যেন রাজ্যের বিদ্যা মাথায় নিয়ে ঘুরছে। চোখে চশমা তো থাকবেই, নইলে আর আতেল কেন! দেখেই যদি আতেল চেনা না গেল, তাহলে আর এত কষ্ট করে আতলামি করে কী লাভ! বৃন্দাবনে গিয়ে বাঁশি বাজালেই হয়। মেলা গোপ-গোপিনী জুটে যাবে। সনৎ বেজায় জানাশোনা ছেলে। নামী প্রতিষ্ঠান থেকে মাস্টার্স করে জাপানে গিয়ে আলঙ্কারিক ডক্টরেট হাতিয়ে এসেছে। দূরে থেকে দেখেই বোঝা যায়, সনৎ মানে, আতেল আসছে। সত্যি বলতে, ওর আতলামি মাতালকেও হার মানায়। মাতাল বোতল পেলেই পুলকিত হয়ে ওঠে। তখন আপনি তাকে যা জিজ্ঞাসিবেন, উহারই ঠিক ঠিক উত্তর দেবে। চাই কি ঘরে কোথায় কত টাকা-পয়সা লুকিয়ে রেখেছে বা বউকে লুকিয়ে কতবার শ্যালিকার সঙ্গে ইনডোর ডেট করেছে, কোন কিছুই বাদ রাখবে না। মাতালের সর্বসুখ এবং স্বর্গসুখ বোতলেই নিহিত। কিন্তু আমার আতেল বন্ধু কোন রকম ধারাপাত মানে না। সে তার মতোই। লাল ক্যাটকেটে টাই আর ধূসর একখানা কোট তার থাকতেই হবে। এর কোন রকম নড়চড় হবে না। নইলে আতেলের তাল কেটে যায় যে। সেই সবজান্তা ভাবখানা আর থাকে না। মার্কামারা অক্সফোর্ড সুজ তার পায়ে। জুতায় কালি পড়েনি কোনকালে, তাই ওটা আদৌ কালো রং ছিল নাকি অন্যকিছু, বোঝা দুষ্কর। কিন্তু বেশবাসে এই নজরহীনতাই তাকে প্রকৃত আতেল করে তুলেছে। যেন দুনিয়ায় শুধু জ্ঞান সত্যি, বাকি সব ভুয়া। ব্যাটা কেয়ারফুলি কেয়ারলেস! স্র্রেফ ভড়ং! ধরুন গে অনেকদিন পর পুরনো বন্ধুরা একসঙ্গে হলেন। খেতে বসেছেন কোথাও, অমনি সনৎ আতলামি শুরু করে দিল। খাচ্ছেন ফুচকা, আতেল অমনি ফুচকা বিষয়ক একখানা লেকচার ঝেড়ে দেবে এবং এই মর্মে সদয় সিদ্ধান্ত প্রদান করবে যে, ফুচকা অতিশয় নিচু জাতের খাবার। ফকির-মিসকিনরা খায়। এতে প্রচুর ধুলাময়লা মিশে থাকে। খেলে নির্ঘাত ভেদবমি। ওলাওঠা হয়ে মারা গেলেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কত লোক যে খাচ্ছে! মরছে না তো! আপনি হয়ত একটু প্রতিবাদী হলেন। ব্যস, অমনি আতেল তেলেবেগেুনে জ¦লে উঠবে। মারমুখী সুরে বলবে, কারা খাচ্ছে, অ্যাঁ? ওরা কি মানুষ! ওরা হলো গিয়ে নর্দমার কীট। ওরা প্রলেতারিয়েত, তোমার আমার মতো এলিট নয়। ওদের সঙ্গে আমাদের তুলনা চলবে কেন। কাকের সঙ্গে কোকিলের তুলনা হয়! মনে মনে বলি, সত্যি বটে। তোমার মতো ডাস্টবিনের কাকের সঙ্গে ভদ্রলোকের মিল কি করে হবে! আতেল কিন্তু এখানেই থেমে নেই। এবার সে ক্লাস-কনফ্লিক্ট বা শ্রেণী সংঘাত নিয়ে জবরদস্ত একখানা অভিসন্দর্ভ মুখে মুখে আউড়ে দেবে। মাঝে মাঝে নামি লেখকের কোটেশনও বলবে। কারণ তার মগজে বিদ্যার উকুন কুটকুট করে কামড়াচ্ছে। আপনার আমার সাধ্যি কি সেই উকুন নখে টিপে মেরে দিই। সেদিন হয়েছে কি, আতেল বন্ধুর সঙ্গে এক জনসভায় গিয়েছি। সেখানে মেলা কেষ্টবিষ্টু হাজির। সরকারের উঁচুতলার লোকও আছেন, আছে মিডিয়াকর্মী। আমি আগে থেকেই জানি, সরকারী লোকদের সে মোটেও দেখতে পারে না। ওর ধারণা, যারা গবর্নমেন্ট জব করে তারা আসলে তত জানেঅলা নয়। স্র্রেফ লাল ফিতার কেরামতি দিয়ে করে খাচ্ছে। আসল জ্ঞানী হলো গিয়ে সে নিজে, আমার আতেল বন্ধু। আমি একুট দ্বিমত করতেই সে খেকুরে গলায় বলল, আরে তুই কি বুঝিস? তুই জাপান গেছিস! ওদের মতো ভদ্রলোক হয়! এই যে এরা সরকারের নথি বগলদাবা করে নিয়ে দৌড়ায়, ওরাই বা কী জানে! কর্পোরেটে গিয়ে দেখ, ওরা কত পলিশ। দেখেই বোঝা যায় কে জিও, আর কে এনজিও। এনজিও না হয় বুঝলাম। জিওটা কি বন্ধু? আমি হুড়কো দেই। আ হা হা হা! জিও জানিস না! গাধা কোথাকার। জিও মানে গবর্নমেন্ট অফিসার। এবার আতেল মিডিয়া নিয়ে পড়ল। ওর কথামতো মিডিয়া মানে রং বদল। সব হলো ইয়েলো জার্নালিজম। ওরা কেবল টিআরপি চেনে। মামুলি খবরকে রাতারাতি ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে যা নয় তাই বলে সংবাদ বানিয়ে কিভাবে দুপয়সা কামাই করা যায়, সেই ধান্ধায় মশগুল। কী বুঝলেন! আতেলের কাছে সব মিথ্যা, শুধু সে নিজে সত্যি। সত্যবাদী যুধিষ্ঠির। তামাম দুনিয়া মিথ্যার বেসাতি খুলে বসেছে। ছি ছি ছি! এই দেশে মানুষ থাকে! এবার সে দেশ নিয়ে পড়ল। এখানে নাকি অনিয়ম আর অনিয়ম। মাছ মরেও শান্তি পায় না, মাছে ফরমালিন মেশানো হয়। ডাব খাবে, কোন্ ভরসায়! ডাবে তো কেরোসিন! অজ্ঞান করে রাস্তায় ফেলে যাবে। কথা সত্যি, মাছে ফরমালিন থাকতেও পারে। নইলে মাছ পচে যায়। আমি মিউমিউ করে বলি। আতেলের সামনে বেশি কথা বলা বা উচ্চৈঃস্বরে বলা রীতিমতো বিপজ্জনক। তেল শব্দটা আতেলের ভীষণ অপছন্দ। বলে, যারা অদক্ষ আর লোভী তারাই নাকি তেল দেয়। আর যারা তেলখোর? আমি প্রশ্ন তুলি, মুফতে আতেলের গা থেকে যদি একটু জ্ঞান ধার পাওয়া যায়! আতেল কী যেন ভাবছে। নাকি কথার পসরা সাজায়। আমি তাড়া দেই। কী হলো, এবার চুপসে গেলে যে! তোমার জ্ঞানের সাগর শুকিয়ে গেছে বুঝি! অমনি আতেল তেড়েফুড়ে উঠলো। এতবড় কথা! আমার জ্ঞানে ভাটা। বলেছে কোন্ পাঁঠা! কভি নেহি। আমি শুধরে দিয়ে বলি, আমি পাঁঠা নই, তোর বন্ধু। এক অধম লেখক। লেখা না ছাই। কী সব লিখিস তোরা। লেখকের ভয়ে পাঠক তো এখন বইমেলায় যাওয়া ছেড়েই দিয়েছে! তোরা নাকি পাঠক দেখলেই খপ করে হাতের কব্জি মুঠোয় পুরে টানতে টানতে বুকস্টলে নিয়ে যাস! জোর করে বই কিনতে বাধ্য করিস! ছি ছি ছি! কেউ কেউ করে। আমি ফুটো বেলুনের মতো চুপসে যাই। ঘটনা কিঞ্চিত সত্যি বটে। কিন্তু তাতে আতেলের কী! কোন কোন ছিঁচকে লেখক বইমেলা শুরুর দশ দিন যেতে না যেতেই ফেসবুকে স্ট্যাটাস মারতে থাকে- দ্বিতীয় মুদ্রণ শেষ, তৃতীয় মুদ্রণ শেষের পথে। আমার খুব জানতে ইচ্ছে হয়, কী হে লেখক, প্রতি এডিশনে তোমার কত বই ছাপা হয়! কুড়িখানা, নাকি আরও কম! যত্তোসব ফেরেব্বাজ! এদের কারণে প্রকৃত লেখকেরা দাম পাচ্ছে না। পাবলিক সব ভুয়া মার্কেটিংয়ে কুপোকাত। মানে হয়! আমি আতেলকে তেলে ফিরিয়ে আনি। নইলে সে লেখকদের মু-ুপাত করে ছাড়বে। আমি তাকে বিলক্ষণ চিনি, তাই নিজের মান বাঁচাতে তেলের পিপায় আশ্রয় নিই। বলি, তেল জিনিসটা নেহাত মন্দ নয়, কি বল আতেল, থুক্কু সনৎ? হুম! তেল ছাড়া কি জীবন চলে! দিনকে দিন পরিস্থিতি এমন দাঁড়াচ্ছে, পানি পেতেও তেল দিতে হয়। তেলেজলে মিল মিশও খাচ্ছে খুব। এভাবেই গড়িয়ে চলে জীবন। লেখক : রম্যলেখক, কথাসাহিত্যিক
×