ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চালচিত্র

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ৫ জুলাই ২০১৭

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চালচিত্র

নিজেদের স্বার্থের মাথায় লাঠির বাড়ি পড়লে গণতন্ত্রের কথা মনে পড়া স্বাভাবিক। তখন গণতন্ত্রের সংজ্ঞাও প্রদান করা হয় নিজেদের মনের মাধুর মিশিয়ে। নিজেদের নির্দোষ মনে করা এবং পরের ব্যাপারে তিলকে তাল করা গণতন্ত্র কিনা, তা কেউ বলতে চায় না। বিএনপির মহাসচিব অতিসম্প্রতি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় যে হামলার শিকার হয়েছেন, তাকে কেউ ভাল বলেনি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিন্দা জানাতে দেরি করেননি। তদন্তেরও আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। এর পরও আদালত পর্যন্ত গড়াল ঘটনাটি। আর এর বিষোদ্গার চলেছে অনেক দিন। একটি পাহাড়ি এলাকায় বিচ্ছিন্ন ঘটনাটি ঘটেছে, সেটাকে গণতন্ত্রের জানাজা বলে চালাবার চেষ্টা দেখে হতবাক হচ্ছি। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে, ক্ষমতায় বসে, সরকারী কোষাগারের টাকা খরচ করে যে দলটি জন্মলাভ করেছে তার ইতিহাস আগাগোড়াই অসাংবিধানিক। ‘আওয়ামী-বাকশালীদের খতম কর’, এই বক্তব্যে কোন গণতন্ত্রের প্রতিধ্বনি ছিল না। যুদ্ধাপরাধী-ফ্যাসিবাদী একটি দলকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করা এবং সে দলের সঙ্গে সম্পর্ক অটুট রাখা গণতন্ত্রের চর্চার মধ্যে পড়ে না। এসব হিসাব করে গণতন্ত্রের জন্য গলা ফাটানো উচিত বলে আমরা মনে করি। নিজেদের দাঁড়িপাল্লাই গণতন্ত্রের মাপকাঠি নয়। স্বাধীনতার শত্রুরাও গণতন্ত্রের কান্না কেদেঁছে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর নির্বাচনের পর যা ঘটেছে দেশে, তার রক্তাক্ত ইতিহাস অনেক লম্বা, অনেক লোমহর্ষক। ওই সময়ের তরুণ প্রজন্ম ১৯৭১ এর চেহারা দেখার সুযোগ পেয়েছে। আমরা গণতন্ত্রের প্রতীক ধরব কাকে? এসএম কিবরিয়া সাহেবকে না সাকা চৌধুরীকে? কিবরিয়া সাহেবকে হত্যা করার পর তখন সংসদের স্পিকার, তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং স্বয়ং বেগম খালেদা জিয়া কী ভূমিকা নিয়েছিলেন? কী বক্তব্য দিয়েছিলেন? সাকা চৌধুরী সংসদে রংঢঙ করে শেখ হাসিনা সম্পর্কে যে কুরুচিপূর্ণ কথা বলত, সে সব বুঝি খুব গণতন্ত্রসম্মত ছিল? গণতন্ত্রের আর্জেস গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়েছিল ২১ আগস্টে, বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে, শেখ হাসিনার জনসভায়। হাওয়া ভবন থেকে গণতন্ত্রের জলীয়বাষ্প বের হয়ে আসত। পুরো আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার নীলনক্সা প্রণয়ন করা হয়েছিল হাওয়া ভবনে। যারা সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দান করেছে, স্বাধীনতার শত্রুদের ক্ষমতার অংশীদার করেছে, তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা উঠিয়ে দিয়েছে, যাদের আমলে ১০ ট্রাক অস্ত্র এসেছিল বাঙালী জাতিকে খতম করার জন্য, যারা মানি লন্ডারিং করেছে, কানাডার আদালতে যারা সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত, তারা সামান্যতে গণতন্ত্রের ‘অশনি সঙ্কেত’ দেখতে পান! আমরা কোন মন্দ কাজকে সমর্থন করতে চাই না। তাই বলে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মির্জা ফখরুলের গাড়ি বহরে হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন? শেখ হাসিনার রাজনীতির স্ট্যাটাস এতটা নিচে পড়ে আছে নাকি? গাড়ি বহরে হামলার নির্দেশ দেয়া তো রাজনৈতিক কৌশলের মধ্যে পড়ে না। ক্ষমতায় যিনি থাকেন ফ্যাসিবাদী হওয়ার তার অনেক পথ খোলা আছে। কিন্তু শেখ হাসিনা অপকৌশলের রাজনীতি করেছেন, এমন প্রমাণ কমই পাওয়া যাবে। তিনি বরং রাজনীতিতে আবেগপ্রবণতার পরিচয় দিয়েছেন, এমন দৃষ্টান্ত কম-বেশি আছে। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে রাষ্ট্রপতির আসনে বসানো তার আবেগপ্রবণ সিদ্ধান্ত। এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনকে স¦রাষ্ট্রমন্ত্রী বানানোও আবেগপ্রবণ সিদ্ধান্ত। অপকৌশলের চর্চাটা শেখ হাসিনার অভিধানে নেই বললেই চলে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সিস্টেম বিলোপ করা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে তাকে যথেষ্ট কৌশলী হতে হয়েছে, যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়েছে। শেখ হাসিনার উদ্যোগে নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী হতে চলেছে। এতে দেশের মুখ উজ্জ্বল হবে। অনেক ধরনের ষড়যন্ত্র দেশের শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হচ্ছে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের গাড়ি বহরে হামলাও একটা ষড়যন্ত্র। নেতিবাচক রাজনীতির দৃষ্টান্ত। এসব হচ্ছে সরল রাজনীতিকে জটিল করার চক্রান্ত। সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার পদক্ষেপ। গাড়ি বহরে হামলার এই সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিএনপির গলাফাটানো চিৎকার ২০০১ সালের ১ অক্টোবর নির্বাচনে ও তার পরে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসী কর্মকা-কে আড়াল করার একটা কৌশল ছাড়া কিছু নয়। ড. হুমায়ুন আজাদের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন, বহুমাত্রিক প-িত, গবেষক ও কবি-কথাশিল্পী, শিক্ষাবিদকে বিএনপি-জামায়াতের আমলে সন্ত্রাসীরা হুমকিতে হুমকিতে আধামরা করে ফেলেছিল, তারপর বইমেলার উপকণ্ঠে কুপিয়ে জখম করেছে। শেখ হাসিনা দেখতে যেতে চেয়েছিলেন ড. হুমায়ুন আজাদকে, সে অনুমতি দেয়নি বিএনপি সরকার। এর চেয়ে হীনম্মন্যতা আর কী হতে পারে? ২০০১ সালের পর তো নতুন করে বুদ্ধিজীবী নিধনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশকে একটি সংখ্যা লঘুশূন্য দেশে পরিণত করার মিশন হাতে নিয়েছিল বিএনপি-জামায়াত। মানুষ যাতে নৌকায় ভোট দেয়ার সাহস না পায়, সেই মিশন হাতে নিয়েছিল। ওই নির্বাচনকে ড. মুনতাসীর মামুন বলেছেন, ‘শালসা‘ নির্বাচন। অর্থাৎ সাহাবুদ্দীন, লতিফ ও সাঈদ মিলে ষড়যন্ত্র করে খালেদা জিয়াকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়েছিলেন। ড. হুমায়ুন আজাদ তার ‘পাকসার জমিন সাদবাদ’ উপন্যাসে যে বর্বরতার চিত্র অঙ্কন করেছেন তার এক বর্ণও অতিরঞ্জিত নয়। এটি বাংলা সাহিত্যের জঙ্গী ও মৌলবাদবিরোধী কালোত্তীর্ণ উপন্যাস। তিনি যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে হেফাজতের ষড়যন্ত্র নিয়েও একটি উপন্যাস লেখার সুযোগ পেতেন। হয়ত এ জন্যই মৌলবাদীরা তাকে এত নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করেছে। ড. আজাদের এ উপন্যাসটি ২০০১ সালের নির্বাচনের বর্বর ঘটনাকে কেন্দ্র করে লেখা হয়েছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর এমন ঘটনা ঘটেছে যে, পিতার কোল থেকে শিশুকে কেড়ে নিয়ে আছড়ে মেরে হত্যা করেছে, কারণ বড় হলে ওই শিশু নৌকায় ভোট দেবে। সংখ্যালঘুরা নতুন করে নিরাপত্তা হারিয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। হাজার হাজার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী উদ্বাস্তু হয়েছে। অত্যাচারে টিকতে না পেরে বরিশালের আগৈলঝরা থেকে সংখ্যালঘুরা বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়া আশ্রয় নিয়েছিল, ঢাকা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও আশ্রয় নিয়েছিল। শেখ হাসিনা তাদের সান্ত¡না জানাতে গিয়েছিলেন। ২১ আগস্টের বোমা হামলায় আইভি রহমানের মৃত্যুর বিভীষিকাময় দৃশ্যটি কিছুতেই ভুলতে পারি না। চট্টগ্রামের অধ্যক্ষ গোপাল কৃষ্ণ মুহুরীকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছিল, সে বীভৎস দৃশ্য ভোলার মতো নয়। নৌকায় ভোট দেয়ার অপরাধে একজন সংখ্যালঘু শিক্ষকের পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলা হয়েছে, এ ঘটনা লেখা আছে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘কলাম সমগ্র-প্রথম খ-’ বইতে। বিপন্ন জননীদের আর্তনাদ এখনও কানে ভাসেÑ ‘বাবারা আমার মেয়েটা ছোট, তোমরা একজন একজন করে যাও।’ ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, বাহাউদ্দীন নাছিম, ড. মুনতাসীর মামুন, শাহরিয়ার কবির, সাবের হোসেন চৌধুরীকে গ্রেফতার করে যে নির্যাতন করা হয়েছিল, তার কোন প্রতিশোধ নেয়নি আওয়ামী লীগ। ইতিহাস বিকৃত করার জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তার কোন প্রতিশোধ নেয়নি আওয়ামী লীগ। কবি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত স্বাধীনতার দলিলপত্র পরিবর্তন করে দাঁড় করানো হয়েছিল, ‘জিয়াউর রহমান ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।’ সেই কমিটির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকার কোন এ্যাকশনে যায়নি। ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’-এর নামে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামিয়ে সেদিন খালেদা জিয়া যে তা-ব চালিয়েছিলেন, তা তো ভুলে যাওয়ার মতো নয়। ২০১৪-১৫ সালে নির্বাচন ঠেকানোর নামে পেট্রোলবোমা দিয়ে যেভাবে মানুষ হত্যা করা হয়েছে, তারও কোন বিচার হয়নি। এটাও বিচারহীনতার দৃষ্টান্ত। সেই তুলনায় মির্জা ফখরুলের গাড়িতে হামলার ঘটনা সামান্যই। এই সামান্য ঘটনায় গণতন্ত্রের কোন ভরাডুবি হয়নি। তবে এই ঘটনার আমরা তীব্র নিন্দা জানাই। হামলাকারীদের গ্রেফতার করা উচিত, যাতে এমন ঘটনা সামনে আর না ঘটে। সন্ত্রাসী-দুর্বৃৃত্তরা কোন দলের আপন হতে পারে না। বাংলাভাই ও শায়খ রহমানরা কোন দলের উপকার করেনি। বিশ্বজিৎ হত্যাকা- সরকারকে ঘোরতর বিব্রত করেছিল। আইএস, তালেবান, আল কায়েদা, জেএমবি সবই বিশ্বের সমর্থন বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। অতিসম্প্রতি মুসলমানদের পবিত্রতম স্থান কাবা শরীফ ঘিরে থাকা মসজিদুল হারামে একটি সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা নস্যাত করে দিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। এই ভয়াবহ ঘটনা থেকে জঙ্গী সন্ত্রাসীদের স্বরূপ চেনার অনুরোধ জানাব আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে। লেখক : কলাম লেখক
×