ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সুইস ব্যাংকে অর্থ পাচার!

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ৫ জুলাই ২০১৭

সুইস ব্যাংকে অর্থ পাচার!

বাংলাদেশে এখন আলোচনার মূল বিষয় সুইস ব্যাংকে অর্থ পাচার। পত্রিকা, টেলিভিশন চ্যানেল, রাজনৈতিক অঙ্গন; সর্বত্রই চলছে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের অর্থ জমা রাখার বিষয় নিয়ে আলোচনা- সমালোচনা। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের কোন বিষয় বা প্রতিবেদন নিয়ে সব সময়ই এক ধরনের হৈচৈ পড়ে এবং চলে তীব্র আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। কখনও টিআইবির দুর্নীতির প্রতিবেদন, কখনও মানবাধিকার লঙ্ঘন বা কখনও সুইস ব্যাংকে অর্থ পাচারের মতো নানাবিধ সংবাদ বা প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া মাত্রই শুরু হয়ে যায় নানামুখী আলোচনা, সমালোচনা। দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এসব ঘটনার প্রকৃত প্রভাব যাই থাকুক না কেন, এগুলো আলোচনা-সমালোচনার জন্য যে সুন্দর উপাদান তাতে কোন সন্দেহ নেই। বর্তমানে তেমনি একটি সুন্দর উপাদান হলো সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের অর্থ পাচার, যা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার কোন শেষ নেই। সুইস ব্যাংকে অর্থ পাচার মোটেই নতুন কোন ঘটনা নয়। সেই গত শতকের আশির দশকে আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং স্বৈরাচারী এরশাদ যখন ক্ষমতায়, তখন থেকেই বাংলাদেশীদের সুইস ব্যাংকে অর্থ জমা রাখার কথা শুনে আসছি। যেহেতু সুইস ব্যাংক তখন কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করত, তাই এ ব্যাপারে তেমন কিছুই জানা যায় নাই। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে এবং বিভিন্ন মহলের, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো গোপনীয়তার বিষয়টি কিছুটা শিথিল করায় এ ব্যাপারে কিছুটা জানা যায়। তা ছাড়া বিশ্বের উন্নত, অনুন্নত অনেক দেশের নাগরিক সুইস ব্যাংকে অর্থ জমা রাখে। এমনকি কঠোর নিয়মনীতি ও কমপ্লায়েন্সের দেশ বলে পরিচিত, আমেরিকার মতো দেশের মানুষও সুইস ব্যাংকে অর্থ জমা রাখে। তবে আমাদের দেশে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন যেমন ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত তাই আমাদের দেশের মানুষ বিদেশে অর্থ জমা রাখলে তা অর্থ পাচার বলে আখ্যায়িত করা হয়। আর উন্নত বিশ্বে বিশেষ করে আমেরিকা কানাডায় বৈদেশিক মুদ্রার অবাধ লেনদেন হয়ে থাকে বিধায় সেখানকার মানুষ বিদেশে অর্থ প্রেরণ করলে তাকে বলা হয় বিদেশে অর্থ জমা রাখা। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে সমগ্র পৃথিবী যেখানে এক বিশ্ব ভিলেজে রূপান্তরিত হয়েছে সেখানে অর্থ সম্পদ এক দেশ থেকে আরেক দেশে অবাধে প্রবাহিত হবে এবং তথাকথিত নিরাপদ স্থানে জায়গা করে নিবে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই এবং এটাকে কেউ রোধও করতে পারবে না। সেক্ষেত্রে বৈধ পথ না পেলে তা অবৈধ পথেই ঘটবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের নাগরিকরাও কর ফাঁকিসহ নানা ফন্দিফিকিরের নামে অর্থ জমা করছে সুইজারল্যান্ডসহ অনেক উন্নত দেশে। এগুলোর দু-একটি ঘটনা মাঝেমধ্যে প্রকাশিত হলেও কয়টি ঘটনারই বা বিচার বা সাজা হয়! তবে, আমাদের দেশ থেকে হয়ত এই অর্থ পাচারের প্রবণতা একটু বেশি, এর কারণ নানা অনিশ্চয়তা। শুধু অর্থ কেন, মানব সম্পদও তো দেশ ত্যাগ করে বিদেশ চলে যাচ্ছে এই একই কারণে। আমাদের মতো অনেক বাংলাদেশীরা দেশের সফল ক্যারিয়ার ফেলে রেখে এসব উন্নত দেশে এসে এক রকম দাসত্বের জীবন বেছে নিয়েছি, তাও সেই একই কারণে। অর্থ পাচারের সমালোচনা না করে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলে এসব পাচার হওয়া অর্থও যেমন ফেরত যাবে, তেমনি মেধাবী প্রবাসীরাও দেশে ফিরে যাবে। যেমনটা আমাদের পার্শ্ববর্তী অনেক দেশের ক্ষেত্রে ঘটেছে এবং এখনও ঘটছে। যতক্ষণ পর্যন্ত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত এবং আইনশৃঙ্খলার উন্নতি ঘটানো না যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত এই অর্থ পাচারও বন্ধ করা যাবে না। এখন প্রশ্ন হলো সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে পাচার হওয়া অর্থ জমা হয় কিভাবে। বর্তমান বিশ্বে যে কোন ধরনের অবৈধ অর্থের লেনদেন মানি লন্ডারিংয়ের পর্যায়ে পড়ে এবং এটি একটি মারাত্মক শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিশ্বব্যাপী এই মানি লন্ডারিং অপরাধ দমনে অনেক কঠোর আইন প্রণয়ন করা হয়েছে এবং বিশ্বের উন্নত অনুন্নত সব দেশই তা কঠোরভাবে প্রয়োগ করে চলছে। বিশ্বের যে কোন দেশের নাগরিক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান এই মানি লন্ডারিং অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকলে তাদের কঠোর শাস্তি প্রদান করা হয়ে থাকে। ইতোমধ্যে বিশ্বের অনেক বৃহৎ আন্তর্জাতিক ব্যাংক এই মানি লন্ডারিং বা অবৈধ অর্থ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় চরম মূল্য দিয়েছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মানি লন্ডারিং অপরাধ দমনে যে ৪৬ সদস্য বিশিষ্ট সর্বোচ্চ সংস্থা এফএটিএফ (ফিন্যান্সিয়াল এয়াকশন টাস্কফোর্স) কাজ করে যাচ্ছে তার একটি অন্যতম সদস্য রাষ্ট্র সুইজারল্যান্ড। এই মানি লন্ডারিং অপরাধ দমনে এফএটিএফের রয়েছে ৪০টি সুস্পষ্ট সুপারিশ, যা প্রতিটা দেশ গ্রহণ করেছে এবং পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেনে চলছে। এই ৪০টি সুপারিশ যদি সঠিকভাবে মেনে চলা হয় তাহলে পাঁচ হাজার ডলারও অবৈধভাবে কোন ব্যাংকে জমা করা সম্ভব নয়। আমরা কোন বিশেষ প্রয়োজনে মাত্র দশ হাজার ডলার দেশে প্রেরণ করতে গেলে সেই অর্থের বৈধতা প্রমাণের জন্য অনেক কৈফিয়ত ও অনেক কাগজপত্র ব্যাংকে জমা দিতে হয়। তাছাড়া নিয়মকানুনের কঠোরতা এবং প্রয়োগের উন্নত মানের অর্থাৎ এক কথায় অয়েল কমপ্লায়েন্সের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে সুইজারল্যান্ডের। এ রকম একটি উন্নত ব্যাংকিং ব্যবস্থার অধীনে এসব অবৈধ অর্থ সুইস ব্যাংকে কিভাবে জমা হলো সেটাই একটি বড় প্রশ্ন। প্রকাশিত প্রতিবেদন যদি সত্য হয়, তাহলে সুইজারল্যান্ডই তো মানি লন্ডারিংয়ের বড় কেন্দ্রবিন্দু! এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে এফএটিএফের ৪০ সুপারিশই হোক বা কঠোর মালি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনই হোক; এর কোন কিছু দিয়েই বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতির চরম হুমকিÑ এই মানি লন্ডারিং অপরাধ দমন করা আদৌ সম্ভব কি? সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীরা অর্থ পাচার করে যত না অপরাধ করেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি অপরাধ করেছে সুইজারল্যান্ড এবং সেই দেশের ব্যাংকগুলো। কেননা এই ঘটনায় বাংলাদেশের কিছুটা অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে বটে, কিন্তু এর মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হবে যে, সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকিং ব্যবস্থা তো বিশ্বব্যাপী মানি লন্ডারিং আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে চলছে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখে এবং আন্তর্জাতিক মহলে উপস্থাপন করা জরুরী। বিশেষ করে বাংলাদেশের যে এফআইইউ (ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট) রয়েছে তাদের উচিত বিষয়টি এফএটিএফ, আমেরিকাভিত্তিক এসিএএমএস (এ্যাসোসিয়েশন অব সার্টিফায়েড এ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট)-সহ মানি লন্ডারিং প্রতিরোধের বিষয়ে যারা কাজ করে চলছে তাদের কাছে যথাযথভাবে উপস্থাপন করা। এসিএএমএসের একজন সদস্য হিসেবে সুযোগ মতো আমি ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টি কোন এক সভা বা সম্মেলনে তাদের দৃষ্টিতে এনে এর সুপারিশ প্রত্যাশা করব ঠিকই, তবে ব্যক্তির চেয়ে কোন রাষ্ট্র বা সরকার এবং তাদের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বিশেষ করে এফআইইউ যখন উদ্যোগ নেয় তখন বিষয়টির গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায় এবং কাজও হয় দ্রুত। প্রয়োজনে বাংলাদেশ অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের সঙ্গেও পরামর্শ করে সমষ্টিগতভাবে উপস্থাপনের উদ্যোগ নিতে পারে। এতে আরও ভাল ফলাফল পাওয়া যাবে বলেই। নিরাপদ স্থানের আশায় এই অর্থ পাচার বা বিদেশে স্থায়ী সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রে একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। যারা বাংলাদেশ থেকে বৈধ অর্থ অবৈধ করে বিদেশের নিরাপদ স্থানে জমা রেখে বা কোন কোন দেশে বেগমপল্লী নির্মাণ করে এক ধরনের আত্মতুষ্টিতে ভুগছেন, তাদের মনে রাখা উচিত এগুলো মোটেই নিরাপদ স্থান নয়। কারণ তারা অর্থ আনছেন অবৈধভাবে, কিন্তু ঘোষণা বা ডিকলারেশন দিচ্ছেন বৈধ অর্থের। ফলে লেনদেনের শুরুটাই হচ্ছে মিথ্যা ডিকলারেশনের মাধ্যমে যা বাতিলযোগ্য এবং যে কোন সময় প্রমাণিত হওয়া মাত্র বাতিল বা বাজেয়াফত হতে পারে। এ রকম সম্পদ বাজেয়াফতের নজির একেবারে কম নেই এসব উন্নত দেশে। এক সময় লিবিয়ার গাদ্দাফির পরিবারের অনেক সদস্য এবং আত্মীয়স্বজন আমেরিকা কানাডার মতো দেশকে বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ স্থান ভেবে অনেক বিলাসবহুল এ্যাপার্টমেন্ট ক্রয় করেছিল যা পরবর্তীতে এসব দেশের সরকার বাজেয়াফত করেছে। তাই যে কোন ধরনের অর্থ বা সম্পদ অর্জন এবং জমা রাখার জন্য নিজের দেশের চেয়ে নিরাপদ স্থান অন্য কোথাও নেই। সুতরাং সাবধান। লেখক : ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা [email protected]
×