ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ফজলুল হক মাস্টার

অভিমত ॥ আচানক দেশপ্রেমী আমরা!

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ৫ জুলাই ২০১৭

অভিমত ॥ আচানক দেশপ্রেমী আমরা!

গণতন্ত্রের কথা সকলের মুখে। গণতন্ত্রের শত্রুর মুখেও। ফ্যাকরাটা এখানেই। এ জন্যে গণতন্ত্রমনাদের পক্ষে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। বিতর্ক যতই হোক ’৭২-এর সংবিধানের বিরোধিতা করা সমীচীন নয়। অথচ সেটা হচ্ছে। স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়েও বিতর্ক করা ঠিক নয়। সেটাও হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান নিয়েও নানান কুকথা চলে এদেশে। আদর্শিকভাবে আমরা পিছিয়ে রয়েছি বলেই বলা হচ্ছে ’৭১ গ-গোলের বছর। এসব থামানো দরকার। ভাল উদ্যোগ চাই এ জন্য। বরং উদ্যোগটা উল্টো। কেননা স্বাধীনতা বিরোধীদের, গণতন্ত্রের শত্রুদের উৎসাহ দেওয়ার মতো অধমের কাজটিও আমরা করে চলছি। গলাবাজি চলছে যুদ্ধাপরাধী নেই বলে। ৬৩ জেলায় একযুগে বোমা হামলা হয়েছে। সেটা আবার হয়েছে রাষ্ট্রীয় মদদে! স্লোগান হয়েছে রাজপথে, গলা ফাটিয়ে স্লোগান হয়েছে বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানানোর জন্য। আমরা থমকে যাইনি, আমলেও নেইনি। আচানক দেশপ্রেমী আমরা! লাল সবুজের পতাকা যারা পছন্দ করে না, তারাও নেতৃত্ব দিচ্ছে। নেতা মানছি তাদের। জঙ্গীবাদের দোসর কারা, কারা গণতন্ত্রের শত্রু, তা জানার পরও আমরা ঘুমিয়ে থাকার ভান করি। পারলে গণতন্ত্রীদের ঠেক দেই সর্বশক্তি প্রয়োগে। রক্ত নেয়া যাদের নেশা, খুন করা যাদের পেশা তাদের টার্গেট শেয়ালের মতো। দ্রুত ব্লগার রাজীবকে হত্যা করে বার্তাটা আমাদের সে রকমটিই দিয়েছে। একজন হত্যাকারী অনেকের প্রাণ কেড়ে নিতে পারে। আবার একজন সক্রেটিসের দর্শনের প্রভাবে অনেক জ্ঞানীগুণী সৃষ্টি হয়। তবে প্রশ্নবিদ্ধ মেধা সেটিই, যে মেধায় বাংলা ভাইয়ের সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। যেখানে নিত্যদিন প্রকাশ্যে গোপনে লাশ হয় মানুষ, সেখানে উদারতা খুবই অচল বিষয়। সহিংসতা যা শুরু হয়েছে তাতে গণতন্ত্রের পুরো পথটাই কাঁটায় ছেয়ে গেছে। আগেও লিখেছি, বিএনপি একটি রাজনৈতিক ফোর্স। ক্ষমতায় যাওয়ার পথ ব্যতীত এরা অন্য কিছু চোখে দেখে না। ২২ জানুয়ারির নির্বাচন হয়নি-এটা বিএনপির একটি অন্তর্জ¡ালা। কেন, ২২ জানুয়ারির নির্বাচন হয়নি, সেটা বিশ্লেষণের সময় বিএনপির নেই। তদসময়ে ভুয়া ভোটার তালিকার মধ্য দিয়ে ভোট চুরির বিষয়টি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল অতি সাধারণের চোখেও। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিনকে তত্ত্বাবধায়ক প্রধান করায় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ধ্বংসের সর্বমহলে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল বিষয়টি। তাই গণ-আন্দোলনের মুখে ২২ জানুয়ারি নির্বাচন বাধাগ্রস্ত হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে ভোটবাক্স কেড়ে নিলেও নগ্নভাবে ভোটের রায় দিয়ে প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগের রাতে ‘ভোটকেন্দ্র’ বিদ্যালয় গৃহে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো। বিদ্যালয়গৃহ পুড়িয়ে দেওয়া আর ভোটের উপকরণ ছিনিয়ে নেওয়া কস্মিনকালেও এক কথা নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেওয়ার এ কালো ইতিহাসে বিএনপিকেই অনন্তকাল দগ্ধ হতে হবে। হত্যা করা হচ্ছে মানুষকে এবং পঙ্গুও করা হচ্ছে। বাহ্যত এসব গণতন্ত্রবিরোধী কুকর্মাদি, যারা খুনোখুনি করতে মাতামাতি করছে, মরিয়া যারা এ ধরনের ঘৃণ্য কর্মে, তাদের গোপন এজেন্ডা হলো রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা। সাতক্ষীরার ঘটনাপ্রবাহ এবং আইনরক্ষক বাহিনীর দেহ থেঁতলে দিয়ে উল্লাস করার মধ্য দিয়ে প্রকারান্তে রাষ্ট্র দখলের বিষয়টিকেই সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। বিএনপির বিদ্বেষ আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকাটা স্বাভাবিক, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সঙ্গে, জাতীয় আদর্শের সঙ্গে লড়াইয়ে জড়িত হয়ে বিএনপি নিজেরাই নিজের ক্ষতিটা বেশি বেশি করে চলছে। এতটা সময় অতিক্রান্ত হয়েছে, রাষ্ট্র পরিচালনায় বিএনপির ব্যর্থতার দায়, লুটপাট আর ক্ষমতার অপব্যবহারের সর্বগ্রাসী রূপের বহির্প্রকাশে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা ছিল ক্ষীণ। সত্য এই যে, তারেক রহমানের দুর্নীতির কারণে রাজপথে নেতাকর্মীরা তারেক জিয়ার নাম উচ্চারণ করলে দলের ক্ষতি হবে, অনুরূপ বিশ্বাস খোদ বিএনপির মাঝেই বিদ্যমান ছিল। যেভাবেই হোক বিএনপি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল এবং তারেক জিয়ার নামও নেতাকর্মীদের এমনকি দেশের মানুষের মুখে উঠে এসেছিল। নির্বাচন বর্জন এবং প্রতিহত করতে সন্ত্রাসী স্টাইল প্রদর্শন করতে গিয়ে হয়ত পূর্ববৎ অবস্থায় বিএনপি অনিবার্য কারণেই ফিরে গেল। কেননা সন্ত্রাসের আদলে ভরা অবরোধ-হরতালে সাধারণ মানুষরা সায় দেয়নি মোটেও। বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ, সুধী সমাজের লোকেরাও প্রয়োজন বোধ করেনি গণ-আন্দোলনের। এর কারণ, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিএনপি নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক দল নয়। কিন্তু গণতন্ত্র রক্ষার অঙ্গীকারে আওয়ামী লীগও হতাশার বহু চিত্র রচনা করেছে। এমপি-মন্ত্রীদের সম্পদ বেড়েছে অকল্পনীয় পর্যায়ে যা গণতন্ত্রের অঙ্গীকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের ভোট দিতে দলীয় নেতাকর্মীরাও ভোট কেন্দ্রে যায়নি। এর অন্তর্নিহিত কারণ অনুসন্ধানের প্রয়োজন নেই, বরং অভিজ্ঞতা এটাই বলে টাকা কামাইয়ের ধান্দা করলে নেতারা কখনোই জনসম্পৃক্ত থাকতে পারে না। হত্যার উল্লাস, সন্ত্রাসের কড়াল নৃত্যের মাঝে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কম হবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেশের মানুষেরা যে ভোট আনন্দ উপভোগ থেকে বঞ্চিত হলো এ দায়টা কার? ভোট অনুষ্ঠানের পদ্ধতি নিয়ে যে কাইজা ঝগড়া চলছে, দায়তো জনগণের নয়। এর অবসান চাই। কর্ম পরিকল্পনা চাই সেজন্য। নইলে আগুন জ্বলবে। খুন হবে আরও মানুষ। এ চেতনার বাইরে অবস্থান নিলে কারও ভাল হবে না, হতে পারে না। গণতন্ত্রের পথ পিচ্ছিল। রাজনীতিকদের চলার পথও পিচ্ছিল। আপামর মানুষ আতঙ্কে। এভাবে আর কত চলবে? জামায়াতকে আমরা যতই দোষ দেই, তাতে লাভটা কী। তারা যদি বদর রাজাকারের পরিচয়ের মাঝেই আত্মমর্যাদার পথ খোঁজে সেটা হবে তাদের এবং জাতির জন্যে বড় দুর্ভাগ্য। বরং স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর এসে তারা যদি অতীত কর্মের জন্য অনুতপ্ত হয় এবং যদি সশস্ত্র ক্যাডারিজম কর্মী বাহিনী গড়ার পথ পরিহার করে তবেই একটা ভাল পথের সন্ধান মিলবে। এদেশ মুক্তিযুদ্ধে পাওয়া দেশ। মুক্তিযুদ্ধপ্রেমী এখানকার মানুষ। গণজাগরণ মঞ্চে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ঢল। বক্তৃতাবিহীন গণজাগরণ চত্বরে জয় বাংলা কণ্ঠে ধারণ করে দৃঢ়তায় দিবানিশি অবস্থান করার এবং মানসিক শক্তির পথ খুঁজে পাওয়ার এক অভাবনীয় দৃশ্যÑ যা পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হয়েছে-এর বিপক্ষে যুক্তি দাঁড় করাবার শক্তি কারোর নেই। বাংলাদেশ, জয় বাংলা, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্র একই সূত্রে গাঁথা। চেতনা সমৃদ্ধ হোক সকলের অনুরূপ মানসে- প্রত্যাশাও তাই। লেখক : স্কুল শিক্ষক, জামালপুর
×