ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন

ভালবাসা ও শ্রদ্ধায় বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল হক মামার বিদায়

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৫ জুলাই ২০১৭

ভালবাসা ও শ্রদ্ধায় বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল হক মামার বিদায়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পারিবারিকভাবে তার নামটি ছিল সৈয়দ শহীদুল হক। একাত্তরের রণাঙ্গনে লড়াই করেছিলেন মামা বাহিনীর প্রধান হিসেবে। সেই থেকে নামের আগে থাকা সৈয়দ পরিচয়টি আড়াল হয়ে জুড়ে যায় ‘মামা’ নামের মধুর সম্বোধনটি। সবার প্রিয় সেই মুক্তিযোদ্ধা মামা শহীদুল হক বিদায়যাত্রায় পেলেন সর্বসাধারণের অকৃত্রিম ভালবাসা ও শ্রদ্ধা। মঙ্গলবার মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন তিনি। শুক্রবার রাতে কাতারের রাজধানী দোহার একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন শহীদুল হক। সেখান থেকে মঙ্গলবার তার মরদেহ ঢাকায় আনা হয়। রাখা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হিমঘরে। পরবর্তীতে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মরদেহ আনা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের তত্ত্বাবধানে সর্বস্তরের মানুষের পাশাপাশি তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানান রাজনৈতিক ও সংস্কৃতি অঙ্গনের ব্যক্তিত্বরা। বিদায়বেলায় ভালবাসা জানাতে এসেছিলেন তার সহযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধারাও। এছাড়াও শ্রদ্ধা জানাতে ছুটে আসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী এ প্রজন্মের তরুণরাও। প্রথমেই ঢাকা জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট মৌসুমী মাহবুবের নেতৃত্বে শহীদুল হক মামাকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। পরে মুক্তিযোদ্ধারা জহিরউদ্দিন জালাল ওরফে বিচ্ছু জালালের নেতৃত্বে আরেক দফা গার্ড অব অনার প্রদান করেন। এ শ্রদ্ধানুষ্ঠানে যোগ দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, তার অবিস্মরণীয় অবদানকে আমরা হয়তো সেভাবে মূল্যায়ন করতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধে তার বীরত্বপূর্ণ অবদানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে মরণোত্তর সম্মাননা জানাতে চেষ্টা করব আমি। শহীদুল হকের ছেলে সৈয়দ খালেদ শুভ বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের সমার্থক বিভিন্ন পেজ থেকে বলা হচ্ছিল, বাবার মরদেহ কোনভাবেই দেশের মাটিতে সমাহিত হতে দেয়া হবে না। বাবার কারণে কাদের মোল্লার ফাঁসি হয়েছে বলে তারা এর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমরা তো হতে দেব না। আমরা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বাবার লাশটি দেশে আনার জন্য বড় ভূমিকা রেখেছেন। আমি কৃতজ্ঞ থাকব মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছেও। শহীদুল হকের ভাই এস এস হক জানান, তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘আমি মামা শহীদ বলছি’ প্রকাশে কাজ শুরু করবেন তারা। গ্রন্থটি লেখার দায়িত্ব নিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেন্টাল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোজাম্মেল হোসেন রতন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে জ্যেষ্ঠ সদস্য এম সানাউল হক বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ায় তিনি ট্রাইব্যুনালের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন। শহীদ মামা আজীবন একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি আমাদের গৌরব। সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর মেজর জেনারেল (অব) কে এম সফিউল্লাহ বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তুলতে শহীদ মামা দেশের আনাচে কানাচে ঘুরেছেন। কাদের মোল্লার ব্যাপারে যখন তথ্য বিভ্রান্তি দেখা গেল, তখন তিনি নানা তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। সুইডেন থেকে ছুটে এসে এ দেশের তরুণ প্রজন্মকে তারা উৎসাহিত করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করে উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, তিনি স্বাধীনতার পরে যেকোন অন্যায়, অবিচার আর সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। কাদের মোল্লার রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে তিনি সুইডেন থেকে ছুটে এসেছিলেন। মুজিব বাহিনীর অন্যতম যোদ্ধা নাজমুল হাসান পাখি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া এখনও শেষ হয়নি। তাকে হারিয়ে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। বিচ্ছু বাহিনীর প্রধান জহির উদ্দিন জালাল বলেন, বুকভরা সাহস নিয়ে সারাজীবন ভর তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে লড়াই করে গেছেন। নতুন প্রজন্মকে নতুনভাবে জাগিয়ে দিয়ে গেছেন তিনি। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী বলেন, এ মুহূর্তে সাম্প্রদায়িকতা পরিবেশে সরকার সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করছে। সে মুহূর্তে আমার বিশ্বাস তরুণ প্রজন্ম শহীদ মামার চেতনার উত্তরাধিকার বয়ে নিয়ে যাবে প্রজন্মান্তরে। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষে শ্রদ্ধা জানিয়ে সাধারণ সম্পাদক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত বলেন, মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদের নেতৃত্বে শান্তির অন্বেষণে তিনি দেশের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াতে শুরু করেছিলেন। গণজাগরণ মঞ্চের পরেও তিনি নবীন প্রজন্মকে জাগাতে চেষ্টা করে গেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে যখন চোরাবালিতে পড়ে বিভ্রান্ত, তখন আমরা তাকে দেখি স্বাধীনতার মৌলিক আদর্শকে সমুন্নত রাখতে তিনি সারা জীবন সচেষ্ট থেকেছেন। শহীদ মিনার থেকে শহীদুল হকের জানাজা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে। এর পর মিরপুর কাজীপাড়ার জামে মসজিদে আরেক দফা জানাজা শেষে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। এর আগে সোমবার দোহারে আবু হামর মসজিদে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
×