ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিদ্যুত বিভাগের প্রতিবেদন

দীর্ঘমেয়াদী বিদ্যুত উৎপাদন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে চাই ৮৫ বিলিয়ন ডলার

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ৫ জুলাই ২০১৭

 দীর্ঘমেয়াদী বিদ্যুত উৎপাদন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে চাই ৮৫ বিলিয়ন ডলার

রশিদ মামুন ॥ দীর্ঘমেয়াদী বিদ্যুত উৎপাদন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ৮৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন। বিদ্যুত বিভাগের তৈরি করা একটি প্রতিবেদনে সম্প্রতি এ তথ্য জানানো হয়েছে। তিন ধাপে উৎপাদন, সঞ্চালন এবং বিতরণ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এই অর্থ বিনিয়োগ করা হবে। সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর পাশাপাশি অন্য দেশের সরকারের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ (জি টু জি), সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট এবং দেশী-বিদেশী বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ সংগ্রহ অর্থের সংস্থান করা হবে। সরকার বলছে গত সাত বছরে বিদ্যুতের বিভিন্ন প্রকল্পে আট বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে। এর বাইরে এখন যেসব প্রকল্পের কাজ চলছে তাতে বিনিয়োগ করা হচ্ছে ১০ বিলিয়ন ডলার। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) তৈরি করে দেয়া বিদ্যুত খাতের মহাপরিকল্পনার হিসেব ধরে বিনিয়োগের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে। বিদ্যুত বিভাগ বলছে, তিন ধাপে ২০১৭ থেকে ২০২১, ২০২২ থেকে ২০৩১ এবং ২০৩২ থেকে ২০৪১ সাল পর্যন্ত সময়ে দেশের বিদ্যুত উৎপাদন পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বিদ্যুত বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন এর আগে সাধারণত দেশের স্বল্প মেয়াদী চাহিদা পূরণের জন্য কাজ করা হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদী চাহিদা বিশ্লেষণ করে কোন পরিকল্পনা সাজানো হয়নি। এতে নির্দিষ্ট সময় অন্তর বিদ্যুত সঙ্কটের মধ্যে পড়ছে দেশ। এই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতেই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে। পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন উপস্থাপিত বিনিয়োগ লক্ষ্য নির্ধারণের প্রতিবেদনটিতে দেখা যায়, ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশের বিদ্যুত খাতে বিনিয়োগ প্রয়োজন ২১ বিলিয়ন ডলার। এরমধ্যে উৎপাদন প্রকল্পে বিনিয়োগ হবে ১০ বিলিয়ন ডলার, সঞ্চালনে বিনিয়োগ হবে সাত বিলিয়ন ডলার এবং বিতরণ এলাকা সম্প্রসারণ এবং আধুনিকায়নে বিনিয়োগ হবে চার বিলিয়ন ডলার। সরকারের ২০২১ সাল মেয়াদী পরিকল্পনায় দেশের সকল ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দেয়ার স্বপ্ন রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে দেশের যেসব এলাকায় গ্রিড লাইন পৌঁছায়নি সেসব এলাকায় নতুন গ্রিড নির্মাণ করা হবে। যেসব দুর্গম এলাকায় গ্রিড লাইন নির্মাণ একেবারেই সম্ভব নয় সেখানে অফগ্রিড বিদ্যুত পৌঁছে দেয়া হবে। ইতোমধ্যে দেশের কয়েকটি চরাঞ্চলে অফগ্রিড সৌরবিদ্যুত প্রকল্প নির্মাণ শেষ হয়েছে। মূলত এই সময়ের মধ্যে দেশের বিদ্যুত ব্যবস্থার সম্প্রসারণ করা হবে। পরিকল্পনায় দেখা যায় ২০২১ সালের মধ্যে দেশের ৯০ ভাগ এলাকা গ্রিড লাইনের বিস্তার ঘটানো হবে। তবে ১০০ ভাগ মানুষকে বিদ্যুত দিতে ১০ ভাগের অফগ্রিড বিতরণ লাইন থাকবে। এই সময়ের মধ্যে সারাদেশের মোট বিতরণ লাইন দাঁড়াবে ছয় লাখ ৩০ হাজার কিলোমিটার। এখন দেশে বিদ্যুত বিতরণ লাইনের পরিমাণ চার লাখ কিলোমিটার। বিপুল বিনিয়োগের সংস্থান কিভাবে হবে জানতে চাইলে মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী থেকে অর্থ সংগ্রহের। এর বাইরে অনেক দেশই এখন বিদ্যুতখাতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। এসব দেশের সরকারী কোম্পানির সঙ্গে আমাদের সরকারী কোম্পানি যৌথ উদ্যোগে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ইতোমধ্যে এ ধরনের কাজ শুরু হয়েছে। এর বাইরে ঠিকাদারদের মাধ্যমে ব্যাংক ঋণ সংগ্রহ অর্থাৎ সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট এ অর্থ সংগ্রহ হচ্ছে। এই প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। এর সঙ্গে দেশ বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংকও আমাদের দেশে বিনিয়োগ করতে চাইছে। তিনি বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য এখন বিদ্যুত খাতে অর্থের অভাব হয় না। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, দ্বিতীয় ধাপে ২০২২ থেকে ২০৩১ সাল পর্যন্ত বিদ্যুত খাতে বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে ২৪ বিলিয়ন ডলার। এই সময়ে উৎপাদন প্রকল্পে ১৩ বিলিয়ন ডলার, সঞ্চালনে দরকার হবে ছয় বিলিয়ন ডলার এবং বিতরণে আরও পাঁচ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। পরবর্তী ধাপে ২০৩২ থেকে ২০৪১ সাল পর্যন্ত সময়ে ৪০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। এ সময় উৎপাদন প্রকল্পে দরকার হবে ২০ বিলিয়ন ডলার এবং সঞ্চালন ও বিতরণে পৃথকভাবে ১০ বিলিয়ন ডলার করে প্রয়োজন হবে। বিদ্যুত বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, বিদ্যুত খাত মূলত চলমান বিনিয়োগ খাত। ক্রমান্বয়ে বিদ্যুত কেন্দ্রর বয়সসীমা শেষে আবার নতুন কেন্দ্র নির্মাণ করতে হয়। সাধারণত গ্যাসচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র ২০ বছর, কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্র ২৫ থেকে ৩০ বছর, আর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রে ৫০ বছর পর্যন্ত উৎপাদন ক্ষমতা বজায় থাকে। আর ছোট আকারের তেলচালিত কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ১৫ বছরের মতো। সঙ্গত কারণে এখন যেসব কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে তার মধ্যে অনেক কেন্দ্রই ২০৩০ বা ২০৩৫ সালে অবসরে যাবে। তখন নতুন কেন্দ্র নির্মাণের প্রয়োজন হবে। এজন্য ২০৩২ থেকে ২০৪০ সাল পর্যন্ত সময়ে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে। একই অবস্থা সঞ্চালন এবং বিতরণে সেখানেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে। এখন দেশের গ্রীডভুক্ত বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা ১৩ হাজার ১৭৯ মেগাওয়াট। ক্রমান্বয়ে এই উপৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়ে ২০২১-এ দাঁড়াবে ২৪ হাজার মেগাওয়াট. ২০৩০ সালে যা বেড়ে দাঁড়াবে ৪০ হাজার মেগাওয়াটে আর ২০৪১ সালে দেশের বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা হবে ৬০ হাজার মেগাওয়াট। এখন দেশের ৬২ শতাংশ মানুষ গ্রিডের বিদ্যুত পান। আর বাকি মানুষ এখনও গ্রিডের বিদ্যুত পান না। আরও ৩৮ শতাংশ মানুষকে গ্রিডের বিদ্যুত দেয়ার পাশাপাশি শিল্প বাণিজ্যর সম্প্রসারণে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে। এ ছাড়া ক্রমাগতভাবে মানুষের চাহিদা এবং অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটছে। এতে মানুষ ইলেক্ট্রিক পণ্য ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে। মানুষের জীবনমান পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই ধারা আরও বৃদ্ধি পাবে। এখন দেশের বার্ষিক বিদ্যুত ব্যবহারের প্রবৃদ্ধি ১০ থেকে ১২ শতাংশ। এখন নির্মাণাধীন প্রকল্পের মধ্যে ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে উৎপাদনে আসবে দুই হাজার ২২৩ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র। কেন্দ্রগুলো হচ্ছে আশুগঞ্জ ৪৫০ মেগাওয়াট, ভেড়ামারা ৩৬০ মেগাওয়াট, বিবিয়ানা দক্ষিণ ৪০০ মেগাওয়াট, সিরাজগঞ্জ ২২৫ (২য় ইউনিট), কুশিয়ারা ১৬৩ মেগাওয়াট, বিবিয়ানা- ফেজ (৩) ৪০০ মেগাওয়াট এবং সিরাজগঞ্জ ২২৫ (৩য় ইউনিট)। এর বাইরে মেগা প্রকল্পর মধ্যে নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্র ১৩২০ মেগাওয়াটের উৎপাদনে আসবে ২০১৯ সালে। এছাড়া কাছাকাছি সময়ে উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রের। ভারত বাংলাদেশের যৌথ মালিকানার বিদ্যুত কেন্দ্রটির উৎপাদন ক্ষমতাও ১৩২০ মেগাওয়াট। এই দুই কেন্দ্রর নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। এরমধ্যে পায়রা বিদু্যুত কেন্দ্রর মূল যন্ত্রাংশ আসতে শুরু করবে বছরের শেষ দিকে। এর বাইরে ২০২১ সালে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির মাতারবাড়ি -১২০০ মেগাওয়াট উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে ২০২১ সালে। এই কেন্দ্রটির দরপত্র মূল্যায়ন চলছে। এছাড়াও পিডিবির দুটি ১৩২০ মেগাওয়াট, কোল পাওয়ার জেনারেশন এবং সেম্বকর্পের একটি ১২০০ মেগাওয়াট, আশুগঞ্জের একটি ১৩২০ মেগাওয়াট, ইজিসিবি এবং মিতসুইয়ের একটি ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাচালিত কেন্দ্র উৎপাদনে আসার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২৫ সালের মধ্যে। এছাড়া এলএনজিভিত্তিক একটি ৭৫০ মেগাওয়াট এবং বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র-২৪০০ মেগাওয়াটের উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে ২০২৪ সালের মধ্যে।
×