ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বন্যার পানি আরও বেড়েছে

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৫ জুলাই ২০১৭

বন্যার পানি আরও বেড়েছে

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ অব্যাহত বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে কক্সবাজার ও সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। বন্যাকবলিত ওই সব এলাকায় হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও শিশু এখন মানবেতর দিনযাপন করছে। মঙ্গলবার কক্সবাজারে গাছ পড়ে ও ঢলের পানিতে শিশুসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া নদী ও হাওড়ের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় কুড়িগ্রামসহ দেশের নিম্নাঞ্চলসমূহ পানিতে তলিয়ে গেছে। খবর স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতার। জানা গেছে, দুদিনের টানা ভারি বর্ষণে সৃষ্ট পাহাড়ী ঢল ও জোয়ারের পানিতে কক্সবাজার জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। বন্যাকবলিত ওসব এলাকার নারী-পুরুষ মানবেতর দিনযাপন করছে। মহেশখালীতে পাহাড়ধসে মোঃ মোনার আলম ও টেকনাফের বাহারছড়া শামলাপুরে মাথায় গাছ পড়ে মঈনুদ্দিন ও ঈদগাঁওয়ে ঢলের পানিতে উম্মে সালমা নামে এক শিশুসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে পৃথক এসব ঘটনা ঘটে। দুদিনের ভারি বর্ষণে চকরিয়া মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে পাহাড়ী ঢলের পানি নেমেছে। বেশিরভাগ নিমাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। নদীতে পাহাড়ী ঢলের পানিপ্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় মঙ্গলবার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে প্রবাহিত হয়। টেকনাফের বাহারছড়া শামলাপুর মাথায় পুরানপাড়ায় গাছ পড়ে মঈনুদ্দিন (৩৫) নিহত হন। তিনি স্থানীয় আশ্রাফ আলীর ছেলে। বন বিভাগের লটের জমানো ঘূর্ণিঝড়ে ভেঙ্গে পড়া ঝাউগাছের টুকরা বিট অফিসে আনার জন্য গাড়িতে গাছ তুলতে গিয়ে গাছসহ পা পিছলে পড়ে গেলে গাছটি মঈনুদ্দিনের মাথায় পড়ে। সদরের ইসলামাবাদ ইউছুপেরখীলে ঢলের পানিতে খেলতে নেমে উম্মে সালমা (৭) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে মুরাপাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। শিশুটি স্থানীয় মোঃ আব্বাসের মেয়ে। ঢলের পানিতে খেলতে নেমেছিল শিশু উম্মে সালমা। এ সময় ঢলের পানির তোড়ে সে ভেসে যায়। পরে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে। মঙ্গলবার সকালে মহেশখালীর হোয়ানক মোহরাকাটার মোনার আলম (৩৫) পাহাড়ধসে মারা গেছেন। তিনি স্থানীয় আবদুস ছালামের ছেলে। ঘরের বাইরে কাজ করার সময় পাহাড়ের কিছু অংশ ভেঙ্গে মোনার আলমের ওপর পড়ে। এতে তিনি ঘটনাস্থলে মারা যান। মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল কালাম ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। চকরিয়ার কোনাখালী ইউপি চেয়ারম্যান দিদারুল হক সিকদার ও বিএমচর ইউপি চেয়ারম্যান এসএম জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ভারি বর্ষণের ফলে নদীতীরবর্তী নিচু এলাকার লোকালয়ে পানি ঢুকে দুই ইউনিয়নের হাজারো পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। চিরিঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান জসীম উদ্দিন বলেন, দুদিনের ভারি বৃষ্টিপাতে মাতামুহুরী নদীতে পাহাড়ী ঢলের প্রবাহ বৃদ্ধি ও চিংড়ি জোনের শত শত চিংড়ি প্রকল্প পানিতে তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। খুটাখালীতে ভারি বর্ষণ এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে খুটাখালীর ছড়ার বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে গেছে। ভাঙ্গন এলাকা দিয়ে ছড়ার বন্যার পানি অনুপ্রবেশ করায় পিয়াজ্জ্যাকাটা, হরইখোলা, পূর্বপাড়া, অফিসপাড়া, নাপিতপাড়া, চড়িবিল, দরগাহপাড়া, কিশলয় স্কুল, ফরেস্ট অফিস, মাইজপাড়া, হাফেজখানা, দক্ষিণপাড়া, খুটাখালী উচ্চ বিদ্যালয়, জলদাশপাড়া, উত্তর ফুলছড়ি এলাকার শত শত ঘরবাড়ি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এদিকে পোকখালীর গোমাতলী এলাকার বাসিন্দারা বলেন, গোমাতলীকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করে সেখানকার পানিবন্দী মানুষের জন্য দ্রুত ত্রাণসামগ্রী পাঠানোর জন্য জেলা প্রশাসক, উপজেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তার প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি। দীর্ঘ এক বছরের বে?শি সময় ধরে সাগরের জোয়ার-ভাটার সঙ্গে পানিবন্দী হয়ে অমানবিক জীবনযাপন করছে পোকখালীর ১০ হাজার মানুষ। গত বছর রোয়ানোর তা-বে গোমাতলীর বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে সাগরের জোয়ার-ভাটায় দুর্বিষহ জীবনযাপন করে আসছে এখানকার অসহায় মানুষগুলো। চৌফলদ-ী ইউনিয়নের ফরিদুল আলম মেম্বার জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন ২৭নং সøুইসগেটটি জোরপূর্বক বন্ধ করে রাখায় উজান থেকে নেমে আসা পানি বের হতে না পারায় এ সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে একাধিকবার তাগাদা দিলেও কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেয়নি। ইসলামাবাদের চেয়ারম্যান নুর ছি?দ্দিক জানান, ভা?রি বর্ষ?ণে ঈদগাঁও নদী?তে সৃষ্ট ঢলের পা?নি?তে প্লা?বিত হ?য়ে?ছে নিম্নাঞ্চল। জালালাবাদের চেয়ারম্যান ইমরুল হাসান রা?শেদ ব?লেন, বে?ড়িবাঁধ ভাঙ্গ?নে ও ঢ?লের পা?নি?তে প্রায় ৮শ’ প?রিবার পা?নিবন্দী আছে। এছাড়াও ঈদগাঁও নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকা ৩-৪ ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ঈদগাঁও নদী দিয়ে অতিরিক্ত পানি প্রবাহিত ও রাবার ড্যামের সøুইসগেট বন্ধ রাখায় সোমবার বিকেলে বেড়িবাঁধের (জালালাবাদ অংশে) রাবার ড্যামসংলগ্ন এলাকার বিরাট একটি অংশ পানির প্রবল স্রোতে ভেঙ্গে গেছে। ভাঙ্গন এলাকা দিয়ে ঈদগাঁও খালের বন্যার পানি প্রবেশ করায় বৃহত্তর ঈদগাঁও এলাকার লোকজন অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় দিনযাপন করছে। ঈদগাঁও বাজার ফরাজীপাড়া সড়কের পূর্ব লরাবাগের হাফেজখানা পয়েন্ট দিয়ে বন্যার পানি প্রবাহিত হওয়ায় যানবাহন ও জনসাধারণের চলাচলে চরম বিঘœ সৃষ্টি হচ্ছে। পানির তোড়ে ভেঙ্গে গেছে পালাকাটা এলাকায় অনেকের বসতবাড়ি ও সীমানা প্রাচীরের দেয়াল এবং ভেসে গেছে বহু মুরগিসহ গৃহস্থালিসামগ্রী। সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ নজরুল ইসলাম প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন। অপরদিকে ঘূর্ণিঝড় মোরার আঘাতে নষ্ট হয়ে পড়া একাধিক সড়ক এখনও সংস্কার হয়নি। বঙ্কিম বাজার থেকে আলমাছিয়া মাদ্রাসা গেট পর্যন্ত সড়কটির অবস্থা সিলেটের প্রায় ২২ হেক্টর রোপা আমনের বীজতলা পানিতে তলিয়ে গেছে। বন্যায় দুই জেলায় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর আউশ ধান তলিয়ে গেছে। জানা গেছে, কুশিয়ারা অববাহিকায় ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, ওসমানীনগর উপজেলার বন্যার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। গোয়াইনঘাট উপজেলায় অপরিবর্তিত থাকলেও নতুন করে প্লাবিত হয়েছে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার নিম্নাঞ্চল। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম জানান, কুশিয়ারা নদীর পানি আমলসিদ পয়েন্টে বিপদসীমার ৯৬ সেন্টিমিটার ও ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমার ১৪১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। সুরমার পানিও বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর পানি তীর উপচে প্রবেশ করায় প্রায় এক সপ্তাহ ধরে ছয় উপজেলার সুরমা ও কুশিয়ারা অববাহিকায় নদীর তীরের দুই শতাধিক গ্রামের নিম্নাঞ্চল পানির নিচে আছে। নতুন করে প্লাবিত হয়েছে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার কয়েকটি এলাকা। জেলায় নয়টি আশ্রয় কেন্দ্রে ৮৯টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, দুর্গত এলাকায় এ পর্যন্ত ১৩৭ মেট্রিকটন চাল ও প্রায় তিন লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুদ রয়েছে। দুর্গত মানুষদের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেয়া হবে। মেডিক্যাল টিম সিলেট অফিস ॥ সিলেটের বন্যাদুর্গত এলাকায় কয়েকটি মেডিক্যাল টিম কাজ শুরু করেছে। সিলেটের সিভিল সার্জন ডাঃ হিমাংশু লাল রায় জানান পানিবাহিত রোগবালাই দমনে এরই মধ্যে ১ লাখ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া ১ লাখ ৪৭ হাজার পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট এবং এক লাখ ওরস্যালাইন মজুদ রয়েছে। মঙ্গলবার বিকেলে সিলেট জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির বিশেষ সভায় তিনি জানান, স্বাস্থ্য বিভাগের মেডিক্যাল টিমের সদস্যরা বন্যার্তদের চিকিৎসাসেবা দিতে কাজ করছেন। সিলেটের জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে ত্রাণ সচিব শাহ কামাল, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক মোঃ রিয়াজ আহমদ, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, কেন্দ্রীয় সদস্য ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদর উদ্দিন আহমদ কামরান, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট লুৎফুর রহমান, সংসদ সদস্য মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী কয়েস। সভায় পুলিশ, সেনা, র‌্যাব, সিভিল সার্জন, ফায়ার সার্ভিসসহ জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তা ও প্রতিনিধিবৃন্দ, জেলার বিভিন্ন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, নির্বাহী কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। কুড়িগ্রাম ॥ কুড়িগ্রামের প্রধান প্রধান নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ফলে দ্বীপচর ও নদ-নদী তীরবর্তী এলাকার নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাচ্ছে। ফলে সদর উপজেলার হলোখানা, ভোগডাঙা, যাত্রাপুর, ঘোগাদহ, মোঘলবাসা, নাগেশ^রীর নুনখাওয়া, বামনডাঙ্গা, কালিগঞ্জ, উলিপুরের হাতিয়া, বেগমগঞ্জ, সাহেবের আলগা, চিলমারীর অস্টমীরচর, নয়ারহাটসহ কয়েকটি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের বীজতলা ও পাটক্ষেত জলমগ্ন হয়ে পড়েছে।
×