ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দিগন্ত টাওয়ার থেকে ফেলে দেয়া গৃহকর্মী লিমার অবস্থা গুরুতর

প্রকাশিত: ০৮:০৫, ৪ জুলাই ২০১৭

দিগন্ত টাওয়ার থেকে ফেলে দেয়া গৃহকর্মী লিমার অবস্থা গুরুতর

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ধর্ষণে বাধা দেয়ায় পরীবাগের সাততলা থেকে ফেলে দেয়া গৃহকর্মী লিমা আক্তার বেবীর (৩৫) ডান হাত ভেঙ্গে গেছে। মুখের জখম গুরুতর। পিঠেও গুরুতর আঘাত লেগেছে। নড়াচড়া করতে পারছে না। এত ব্যয়বহুল চিকিৎসার ভার বহন করতে তার পরিবার দিশেহারা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ওই গৃহকর্মী ওয়ার্ডের বেডে যন্ত্রণায় ছটফট করছে। উল্লেখ্য, শুক্রবার রাতে ধর্ষণে বাধা দেয়ায় পরীবাগের দিগন্ত টাওয়ারের ৭/এম ফ্ল্যাটের বাসিন্দা গৃহকর্তা এজেডএম সালেহ আহমেদ তাকে সাততলা থেকে ফেলে দেয় বলে অভিযোগ করেছে গৃহকর্মী লিমা। শাহবাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জাফর আলী বিশ্বাস জানান, শনিবার রাতে মিরপুর থেকে সালেহ আহমেদকে (৩০) গ্রেফতার করা হয়েছে। আটক সালেহের বাসার নিচ থেকে জব্দ করা হয়েছে তার ব্যবহৃত একটি গাড়ি, যাতে জাতীয় সংসদের মনোগ্রামযুক্ত স্টিকার লাগানো রয়েছে। ওই রাতে সালেহর বাবা আবুল হোসেনকেও আটক করা হয়। ওই টাওয়ারের আরেকটি ফ্ল্যাটের বাসিন্দা বিএনপির সহযোগী সংগঠন মুক্তিযোদ্ধা দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি হোসেন। তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে রবিবার আদালতে পাঠানো হয়েছে। হাসপাতালের বেডে গৃহকর্মী লিমা জানান, পেটের দায়ে অন্যের বাসায় কাজ করতেন। একটু ভাল বেতনের খবর পেয়ে ১৬ জুন বাড্ডার নাজমা আক্তার নামে এক নারীর মাধ্যমে পরীবাগের এ বাসায় মাসে ১৫ হাজার টাকা বেতনে কাজ নিই। কাজ শুরুর একদিন পরই গৃহকর্তার বিকৃত লালসার শিকার হই। বহুবার পালাতে চাইলেও গৃহকর্তা বাইরে বের হওয়ার সময় বাসা তালা মেরে যেতেন। আমার ফোনও কেড়ে নেন গৃহকর্তা। শুক্রবার রাতে ধর্ষণ চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে সাততলার বারান্দা থেকে নিচে ফেলে দেন গৃহকর্তা সালেহ। কপালগুণে বেঁচে গেলেও গুরুতর আহত হয়ে এখন ঠাঁই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বিছানা। পিঠ ও হাতের ভাঙ্গা হাড়ের যন্ত্রণায় আমি সারাক্ষণ ছটফট করছি। লিমা জানান, ওই বাসায় মনোয়ারা বেগম নামে আরও এক বৃদ্ধা গৃহকর্মী আট হাজার টাকা বেতনে কাজ করতেন। বাসায় সালেহ আহমেদের স্ত্রী পরিচয় দেয়া সীমা নামে এক নারী থাকতেন। তিনি নাকি সালেহ আহমেদের ১১তম স্ত্রী। সালেহ আহমেদ বাসার বাইরে গেলে সবাইকে তালাবদ্ধ করে রেখে যেত। তিনি জানান, সালেহ আহমেদ মদ ও ইয়াবার নেশায় ডুবে থাকত। প্রায়ই ওই বাসায় নারী ও মদের আড্ডা বসত। তারা একটা রুমে ইয়াবা সেবন করত। লিমা আক্তার জানান, ঘটনার দিন সন্ধ্যায় নেশাগ্রস্ত হয়ে কয়েকবার আমাকে জড়িয়ে ধরে সালেহ। বাধা দিলে প্রথমে রড দিয়ে বেধড়ক পেটায়। একপর্যায়ে সাততলার বেলকনি থেকে নিচে ফেলে দেয় সালেহ। সেদিন তার স্ত্রীকেও মারধর করেন তিনি। রাত দশটার দিকে মেয়েটিকে নিচে পড়তে দেখেন এ্যাপার্টমেন্টের কাজের লোক জাহাঙ্গীর। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে জানালে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে রাত এগারোটার দিকে ঢামেকে ভর্তি করে। হাসপাতালের বেডে মেয়ের শিয়রে বসে থাকা মাসুমা বেগম কান্নাজাড়িত কণ্ঠে জানান, আমার মেয়ে তো কোন অন্যায় করেনি। তার সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে। তাকে অন্যায় কাজে বাধ্য করতে চাওয়া হয়েছিল। নিজেকে রক্ষা করতে চাওয়ায় বাড়ির মালিক তাকে সাততলা থেকে ফেলে দেয়। হাসপাতাল অনেকগুলো টেস্ট করতে দিয়েছে। এজন্য যে টাকা দরকার, সে টাকা আমাদের নেই। কেউ চিকিৎসার ব্যয় বহন করলে আমার মেয়েটা বাঁচতে পারে। মেয়ের চিকিৎসার খরচ বহন করতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছি। অসহায় লিমা জানান, তার ভাই বনানীতে একটি বাসার গাড়ি চালান। চিকিৎসার জন্য কিছু টাকা দিয়ে গেছে। সে টাকাও শেষ। তিনি জানান, ১৬ বছর আগে স্বামী ছেড়ে গেছে। দুই সন্তান নিয়ে বাবা-মাকে দেখতে হয়। পড়াশোনা জানি না বলে মানুষের বাসায় কাজ করে খেতে হয়। সেদিন যা ঘটেছিল আহত লিমা পুলিশকে জানান, সেদিন স্যার আর ম্যাডাম (সীমা) এক রুমে অনেকক্ষণ দরজা বন্ধ করে ছিলেন। তারা প্রায়ই রুমের দরজা বন্ধ করে মোম জ্বালিয়ে কী যেন খেত। মাঝে মাঝে দুটো মেয়েও আসত। তারা সবাই এক রুমে দরজা বন্ধ করে রাখত। এরপর স্যার প্রায়ই অন্যরকম ব্যবহার করত। অপর গৃহকর্মী মনোয়ারা জানান, সালেহের হাতুড়িপেটায় গত মাসেও হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। মনোয়ারা বলেন, স্যার-ম্যাডাম রাতে ডাবের পানি খান। শুক্রবার বিকেলে স্যার রুম থেকে বের হয়ে ওই মেয়েটাকে ডাবের পানি দিতে বললে সে জানায়, ডাব নেই। এরপর স্যার রেগে গিয়ে তাকে লোহার পাইপ দিয়ে মারধর করেন। হাতে থাকা হাতুড়ি দিয়ে তার স্ত্রী সীমা ম্যাডাম ও আমাকেও প্রচ- মারতে থাকেন। পরে লিমাকে সাততলার বারান্দা থেকে ফেলে দেন। শাহবাগ থানার ওসি জানান, ঘটনার পর গৃহকর্মীর মা মাসুমা বেগম শনিবার থানায় এসে ধর্ষণে বাধা দেয়ায় তার মেয়েকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে একটি মামলা করেছেন। তিনি জানান, মামলার আগেই মৌখিক অভিযোগ পেয়ে সালেহ আহমেদের সন্ধানে শুক্রবার রাতেই তারা দিগন্ত টাওয়ারের ওই ফ্ল্যাটে অভিযান চালায়। বাসার দরজা ভেঙ্গে সেখান থেকে সালেহের স্ত্রী পরিচয় দানকারী নারীকে উদ্ধার করা হয়। বাসার বৃদ্ধা গৃহকর্মী মনোয়ারা জানান, সালেহ এর আগে তাকেও মারধর করতেন। ‘আগের মাসেও স্যার তাকে হাতুড়ি দিয়ে প্রচ- মারধর করার পর ধানম-ির একটি হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েছিলাম’। সূত্র জানায়, সালেহ কিছুদিন অস্ট্রেলিয়া ছিলেন। সেখানে তাদের রেস্তরাঁ ব্যবসা আছে। এদিকে শনিবার দিগন্ত টাওয়ারের পার্কিং থেকে নতুন মডেলের হিয়োন্দে-এইচ ওয়ান মডেলের একটি মাইক্রোবাস জব্দ করে তারা। গাড়িতে সংসদের মনোগ্রাম লাগানো ছিল। গাড়িটি এজেডএম সালেহ আহমেদ ব্যবহার করতেন বলে স্থানীয়রা র‌্যাবকে জানিয়েছেন। এর আগে ২০১৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর শাহবাগ এলাকায় র‌্যাবের একটি বিশেষ অভিযানে সালেহ আহমেদকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সে সময় তার কাছ থেকে বিভিন্ন দেশের মুদ্রা ও নগদ ৮ লাখ টাকা, ২৩ ইয়াবা বড়ি এবং সংসদের মনোগ্রামখচিত নম্বরপ্লেটবিহীন একটি নতুন মার্সিডিজ বেঞ্জ জীপ জব্দ করা হয়। র‌্যাবের অনুসন্ধানে জানা গেছে, সালেহ আহমেদ দীর্ঘদিন ধরে পরীবাগে তার নিজস্ব ফ্ল্যাটে ইয়াবা সেবন, বিকৃত যৌনাচার, হুন্ডি ও মাদক ব্যবসাসহ অন্যান্য অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত।
×