ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

৬ বছর ধরে শিকলবন্দী শিশু ঝন্টু

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ৪ জুলাই ২০১৭

৬ বছর ধরে শিকলবন্দী শিশু ঝন্টু

নিজস্ব সংবাদদাতা, শেরপুর, ৩ জুলাই ॥ যে বয়সে হাতে বই-খাতা ও পায়ে বল বা অন্য কোন খেলার সামগ্রী থাকার কথা, সে বয়সে হাতে কিছু পরানো না থাকলেও ঝন্টু নামে এক শিশুর পায়ে ঝুলছে শিকলবন্দী ২টি তালা। ঝন্টুর পুরো নাম শাকিল মিয়া। তার বয়স এখন সাড়ে ১২ বছর। শেরপুরের নকলা উপজেলার টালকী ইউনিয়নের বিবিরচর এলাকার মৃত আবদুস সামাদ মেম্বারের ছেলে ঝন্টুর জীবন দীর্ঘ প্রায় ৬ বছর ধরে ওই শিকলে বাঁধা। ওই দীর্ঘ সময় ধরে শিকলে বাঁধার কারণে ঝন্টুর দুই পায়ের গোড়ালিতে দগদগে ঘা হয়ে গেলেও কারও হৃদয়কেই সে গলাতে পারেনি। বরং দিন দিন বাড়ছে তার মানসিক প্রতিবন্ধিতা। সোমবার সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, ঝন্টুর করুণ অমানবিক শিকলবন্দী জীবনের দৃশ্য। জানা যায়, প্রায় ১৪ বছর আগে ঝন্টুর বাবা আবদুস সামাদ মেম্বার আগের সংসারের ৩ ছেলে ও ৩ মেয়ে রেখে বিয়ে করেন তার মা জোসনা খাতুনকে। এরপর প্রথম স্ত্রী তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে সম্পূর্ণভাবে আলাদা হয়ে যান। জোসনার দাম্পত্য জীবনে জন্ম নেয় একমাত্র সন্তান ঝন্টু। ঝন্টুর ২ বছর বয়স হলে তার বাবা সামাদ মারা যান। অভাবের তাড়নায় জোসনাকে অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতে যেতে হতো। তাই সঠিক সময়ে খাবার ও পোশাক পরিচ্ছদ দিতে না পারায় ছোটকাল থেকেই পথচারীদের কাছে টাকা চাওয়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে ঝন্টুর। টাকা না পেলে শিশুকালেই পথচারীর পিছু নিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত চলে যেত সে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে পথচারীদের পিছু নিয়ে মাঝেমধ্যেই শেরপুর, জামালপুর, নালিতাবাড়ীসহ বিভিন্ন জায়গায় চলে যেত। এমনকি একবার ঢাকার উদ্দেশে গাড়িতে উঠে বসে। পরে পরিচিতদের সহায়তায় পুনরায় তাকে বাড়িতে আনা হয়। ওই সমস্যা থেকে বাঁচতে বা ছেলে হারানোর ভয়ে ঝন্টুর ৬ বছর বয়সে ২ পায়ে শিকল পরিয়ে তালা লাগিয়ে রাখেন তার মা। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত ওভাবেই চলছে ঝন্টুর শিকলবন্দী জীবন। এ বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দা হাফিজুর রহমান, রেজাউল করিম, আবদুর রহিমসহ অনেকেই জানান, অমানবিক অবস্থা দেখে তারা একসময় শিশু ঝন্টুর পায়ে পরানো শিকল খুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু সে বার বার অন্যত্র চলে যাওয়ায় তাকে স্থায়ীভাবে পায়ে শিকল পরিয়ে তালাবন্দী করে রাখা হয়েছে। ঝন্টুর মা জোসনা খাতুন আক্ষেপ করে বলেন, ‘স্বামী মরার পর সংসারের বহুত কষ্টেও আমার সতীনপুত্ররা এল্যা চাইয়া দেহে নাই। ঝন্টুর উপরেও তারা কোন দয়ামায়া দেহায় নাই। ফলে পেটের ভাত জোগাইতে আর ঝন্টুরে সামাল দিতে তার পায়ে শিকল দিতে অইছে। বাবাডারে এই কষ্ট দিছি এলাকায় বাইচ্যা থাহার জন্যই।’ খোঁজ করে পাওয়া যায় স্থানীয় ইউপি সদস্য খোরশেদ আলমকে। তিনি জানান, অভাবের তাড়না থেকে বাঁচাতে ঝন্টুর নামে একটি প্রতিবন্ধী ভাতা কার্ড করে দেয়া হয়েছে। এরপরও তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যায়নি। এগিয়েও আসেনি কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। তার মতে, ঝন্টু যেহেতু অন্য সবার মতো বয়স অনুযায়ী সব বলতে, করতে ও বুঝতে পারেÑ সেহেতু তাকে সুচিকিৎসা দিলে সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু কে দেখে সেই অমানবিক ও করুণ দৃশ্য? কে এগিয়ে যায় সেই শিকলবন্দী শিশু ঝন্টুর পাশে? কেই-বা রাখে তার খবর?
×