ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রদ্ধা-ভালবাসায় ড. করুণাময়ের চিরবিদায়

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ৪ জুলাই ২০১৭

শ্রদ্ধা-ভালবাসায় ড. করুণাময়ের চিরবিদায়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সঙ্গে চোখের জলে চিরবিদায় নিলেন সঙ্গীত গবেষক ড. করুণাময় গোস্বামী। বিদায়যাত্রায় নানা শ্রেণীর-মানুষের স্মরণে এলো তার বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন। সোমবার ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে কয়েক দফা শ্রদ্ধা নিবেদনের পর তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। বৃষ্টিস্নাত দিনেও অগণন মানুষ এসেছিলেন সঙ্গীতে নিবেদিত প্রাণ বরেণ্য এই ব্যক্তিত্বকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। এসেছিলেন ভালবাসা জানাতে। তারা বলেছেন, করুণাময় গোস্বামী শরীরীভাবে না থাকলে আপন কর্ম ও গবেষণার মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন চিরকাল। সোমবার সকালে শমরিতা হাসপাতালের হিমঘর থেকে ড. করুণাময় গোস্বামীর মরদেহ বাংলা একাডেমিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আনা হয়। এরপর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বৃষ্টি উপেক্ষা করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট আয়োজিত শ্রদ্ধা নিবেদন পর্বে শিক্ষাবিদ, নাট্যজনসহ নানা পেশার মানুষ হাজির হয়েছিলেন। শহীদ মিনারের শ্রদ্ধাঞ্জলি পর্ব শেষে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় নারায়ণগঞ্জে তার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল তোলারাম কলেজে। সেখানে শিক্ষক-ছাত্রসহ আশপাশের স্থানীয় বাসিন্দারা তাকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এরপর শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাব ও পরে নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হয় তার মরদেহ। এ সময় নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রাণপুরুষ হিসেবে পরিচিত এই ব্যক্তিত্বকে শ্রদ্ধা জানান নারায়ণগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষ। এরপর নারায়ণগঞ্জ সদরের গাবতলী শ্মশানে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় উপস্থিত ছিলেনÑ করুণাময় গোস্বামীর স্ত্রী শিপ্রা দেবী, ছেলে সায়ন্তন গোস্বামী ও মেয়ে তিথি গোস্বামী। এ সময় তার সন্তান তিথি ও সায়ন্তন সবার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, বাবার আত্মজীবনী প্রকাশের ইচ্ছা ছিল, যা আলোর মুখ দেখেনি। আমরা সেটি প্রকাশের চেষ্টা করব। সকালে বাংলা একাডেমিতে করুণাময় গোস্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি প্রফেসর ইমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান, একাডেমির সচিব আনোয়ার হোসেনসহ বাংলা একাডেমির অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, বাংলা সঙ্গীতের একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন ড. করুণাময় গোস্বামী। সঙ্গীতের ইতিহাস ও এর ভাবসৌন্দর্য বিশ্লেষণে তিনি বিশেষ ভূমিকা রেখে গেছেন। যা তুলনাহীন। তিনি তার গবেষণা কর্মের মধ্য দিয়ে তরুণ প্রজন্মের মাঝে বেঁচে থাকবেন। দেশভাগ নিয়ে তার সম্প্রতি প্রকাশিত দুটি উপস্যাস ‘ভারতভাগের অশ্রুকণা’ ও ‘লাহোরের রহিম খের’ খুব তাৎপর্যপূর্ণ। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেনÑ সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল। শ্রদ্ধা নিবেদন করেন প্রফেসর ইমেরিটাস ভাষাসংগ্রামী অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ, মফিদুল হক, আবুল হাসনাত, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব ইব্রাহীম হোসেন খান, নজরুল ইনস্টিটিউটের পরিচালক আবদুর রাজ্জাক ভূইয়া, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ প্রমুখ। শ্রদ্ধাঞ্জলি পর্বটি সঞ্চালনা করেন মানজার চৌধুরী সুইট। যেসব সংগঠন শ্রদ্ধা নিবেদন করেÑ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, নজরুল ইনস্টিটিউট, শিল্পকলা একাডেমি, ছায়ানট, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশন, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, সার্বজনীন পূজা কমিটির মহানগর শাখা, জগন্নাথ হল এ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশন, মহিলা পরিষদ, উদীচী, সঙ্গীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ, ভিন্ন ধারা, বিএসবি ক্যামব্রিয়ান, কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট, বাংলাদেশ বেতার নিজস্ব শিল্পী সংস্থা, রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, গুরুদয়াল কলেজ কিশোরগঞ্জ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বন্ধুরা প্রভৃতি। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, উপমহাদেশে সঙ্গীত গবেষণা তার হাতে ঋদ্ধ হয়েছে। ড. করুণাময় গোস্বামী শিক্ষাবিদ ও গবেষক হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেছিলেন। নজরুল ও রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে আজীবন গবেষণা করেছেন। তবে তার সবচেয়ে বড় অবদান সঙ্গীতকোষ। এটা উপমহাদেশে সঙ্গীত নিয়ে বড় কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, তার জ্ঞান ও মনীষা আমাদের আলোকিত করে, গর্বিত করে। সঙ্গীতকোষ ড. করুণাময় গোস্বামীর অনন্য এক গবেষণাকর্ম। উপমহাদেশের সঙ্গীত গবেষণায় এই গ্রন্থ নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আসাদুজ্জামান নূর বলেন, গবেষণা ও শিক্ষায় অবদানের মধ্য দিয়ে ড. করুণাময় গোস্বামী নিজেকে জ্ঞানতাপস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। অন্তর্মুখী এই মানুষটি সাহিত্য ও সঙ্গীতে মৌলিক গবেষণায় যে কাজ করে গেছেন তা খুব কম গবেষকই করতে পেরেছেন। রামেন্দু মজুমদার বলেন, মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়েছে। একে একে গুণী মানুষরা চলে যাচ্ছেন। ড. করুণাময় গোস্বামীকে সঙ্গীতবেত্তা দেখেছি। রবীন্দ্র ও নজরুল সঙ্গীত নিয়ে গবেষণা করেছেন। সর্বশেষ দেশভাগ নিয়ে লেখা তার উপন্যাস আমাদের আলোড়িত করেছে। আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, কিছু কিছু মানুষ থাকেন যাদের মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না। যে বয়সেই মৃত্যু হোক না কেন তা অকালমৃত্যু বলে মনে হয়। ড. করুণাময় গোস্বামী তেমনি একজন ব্যক্তিত্ব। তার কাজ আমাদের পথ দেখাবে। অসমাপ্ত যেসব কাজ রয়ে গেল তা আমাদের আরও অনেক কিছু পাওয়া থেকে বঞ্চিত করবে। মফিদুল হক বলেন, সাতচল্লিশের দেশভাগের বেদনাকে বুকে ধারণ করে তিনি বাংলাদেশের সাহিত্য এবং ইতিহাস-ঐতিহ্যকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। শিক্ষায় গবেষণায় সেই চেতনাকে ধারণ করেছেন। নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক জাগরণেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ছিলেন সঙ্গীতে সমর্পিত মানুষ। সঙ্গীতের গভীরতাকে তিনি বুকে ধারণ করতে পেরেছিলেন। আমাদের সময়ে তিনি ছিলেন প্রেরণাদায়ী পুরুষ। মামুনুর রশীদ বলেন, ভারতভাগের বেদনা তিনি নতুন আলোয় আবিষ্কার করেছিলেন। ভারতভাগ যে মুসলমান সমাজকে ধ্বংস করে দিয়েছে এটা তার গবেষণায়, উপন্যাসে তুলে এনেছেন। ইতিহাসকে নতুন আলোয় দেখার প্রয়াস পেয়েছিলেন। জাতীয় কবি কাজী নজরুলকেও তিনি নানাভাবে আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন। অগ্রগণ্য এই নজরুল গবেষক তার গবেষণায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। নারায়ণগঞ্জের মাসদাইর শ্মশানে শেষকৃত্য স্টাফ রিপোর্টার, নারায়ণগঞ্জ থেকে জানান, বিশিষ্ট সঙ্গীত গবেষক ও শিক্ষাবিদ ড. করুণাময় গোস্বামী শেষকৃত্য সোমবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জের মাসদাইর শ্মশানে সম্পন্ন হয়েছে। এর আগে দুপুরে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বজনের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তার মরদেহ রাখা হয়। সেখানে জেলা প্রশাসনের পক্ষে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল হামিদের নেতৃত্বে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর মরদেহে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডাঃ সেলিনা হায়াৎ আইভী, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের জাতীয় পার্টি দলীয় সংসদ সদস্য এ কে এম সেলিম ওসমান, প্রধান তথ্য কর্মকর্তা শামীম চৌধুরি, আন্তর্জাতিক অপরাধবিষয়ক ট্রাইব্যুনালের প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুল হান্নান সরকার, নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হাইয়ের নেতৃত্বে জেলা আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাব, নারায়ণগঞ্জ জেলা সাংবাদিক ইউনিয়ন, জেলা আইনজীবী সমিতি, জেলা জাতীয় পার্টি, খেলাঘর, গণসংহতি আন্দোলন, মহিলা পরিষদ, নাগরিক কমিটি, নারায়ণগঞ্জ রবিন্দ্র সম্মিলন পরিষদ, নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স, রাইফেল ক্লাব, নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট, ছাত্র ইউনিয়ন, নারায়ণগঞ্জ হাইস্কুল, নারায়ণগঞ্জ কলেজ, বিদ্যা নিকেতন, নারায়ণগঞ্জ পূজা উদযাপন পরিষদ, বিএনসিসিসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ড. করুণাময় গোস্বামীর মরদেহে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ড. করুণাময় গোস্বামীর মরদেহবাহী এ্যাম্বুলেন্স করে ঢাকা থেকে তার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল সরকারী তোলারাম কলেজে নেয়া হয়। সেখানে কলেজের শিক্ষক, অধ্যক্ষ, ছাত্রছাত্রী সংসদ ও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমানের পক্ষে মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। পরে আনা হয় নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় অবস্থিত সুধীজন পাঠাগারের সামনে। সেখানে লাশবাহী গাড়িতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সুধীজন পাঠাগারের পরিচালকসহ কর্মকর্তাও কর্মচারা। পরে তার লাশ রাখা হয় চাষাঢ়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। দীর্ঘ দুই ঘণ্টা শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বিকেল তিনটার দিকে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় নারায়ণগঞ্জের মাসদাইর শ্মশানে। সেখানে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান শেষে দাহ করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেনÑ ড. করুণাময় গোস্বামীর স্ত্রী শিপরা রানী দে, ছেলে শায়ন্ত গোস্বামী, মেয়ে তিথি গোস্বামী, ভাই অসিম গোস্বামী, ক্যাব্রিয়ান কলেজের চেয়ারম্যান লায়ন বাশারসহ নারায়ণগঞ্জের শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক নেতাসহ সর্বস্তরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।
×