ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ নির্মিত হবে ভারতীয় এলওসির আওতায়

এক শ’ বছর পর পাবনায় রেল লাইন হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৪ জুলাই ২০১৭

এক শ’ বছর পর পাবনায় রেল লাইন হচ্ছে

সমুদ্র হক ॥ উন্নয়নের ধারবাহিকতায় উত্তরবঙ্গের রেল যোগাযোগে নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটছে। প্রায় এক শ’ বছর পর পাবনা জেলা শহরের মানুষ রেলগাড়িতে ভ্রমণের জন্য রেল স্টেশন পাচ্ছে। এ বছরের শেষদিকে পাবনা পর্যন্ত রেল যোগাযোগ চালু হয়ে পরবর্তী বছরে আরও সম্প্রসারিত হয়ে বেড়া উপজেলার ঢালারচর পর্যন্ত লিঙ্ক যাবে। এতকাল পাবনার মানুষকে ঈশ্বরদী জংশনে নেমে প্রায় ১২ কিলোমিটার সড়কপথে পাবনা পৌঁছতে হতো। এদিকে স্বল্প দূরত্বে বগুড়া তথা উত্তরবঙ্গ থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে ঢাকা পৌঁছার বগুড়া- সিরাজগঞ্জ মিশ্রগেজের (ডুয়েল গেজ) রেললাইন নির্মাণের প্রকল্পটি প্রায় ২০ বছর পর অনেক ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত হিমঘর থেকে বের হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ভারত আগ্রহ দেখিয়েছে। সূত্র জানায়, ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় রেলপথটি নির্মিত হতে যাচ্ছে। ঈশ্বরদীর অদূরে মাজগ্রাম থেকে পাবনা জেলা শহর হয়ে বেড়া উপজেলার ঢালারচর পর্যন্ত ৭৮ কিলোমিটার রেল লাইন, ১১ টি নতুন রেল স্টেশন, আধুনিক সিগনাল ও রেল ব্রিজ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে ২ হাজার ১৫ সালে। দুই পর্যায়ের (ফেজ) প্রথম পর্যায়ে পাবনা পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার রেললাইন ও ৪ টি নতুন রেল স্টেশন নির্মাণের ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। মাজগ্রাম-পাবনা-ঢালারচর ৭৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের এই প্রকল্পে রয়েছে : ১১ টি নতুন রেল স্টেশন, ৭৬ টি ছোট ও ৯ টি বড় রেলব্রিজ, ৫০টি রেল ক্রসিং এবং রেল সিগনাল ব্যবস্থা। বর্তমানে মাজগ্রাম, দাশুড়িয়া, টেবুনিয়া ও পাবনা রেল স্টেশন নির্মাণ, সিগনালিং রেললাইন বসানোর ৮০ শতাংশেরও বেশি কাজ হয়েছে। এই পথে শীঘ্রই পরীক্ষামূলকভাবে ট্রেন চালিয়ে ত্রুটিগুলো সারানো হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে পাবনা থেকে সুজানগর, সাঁথিয়া উপজেলার অংশিক হয়ে বেড়া উপজেলার ঢালারচর পর্যন্ত ৫৪ কিলোমিটার রেললাইন ও ৭ টি নতুন রেল স্টেশন সিগনাল রেল ক্রসিং নির্মাণ হবে। তবে পাবনা থেকে ঢালারচর পর্যন্ত ট্রেন লাইন হবে মিটার গেজের। এই পথে (পাবনা-ঢালারচর) ট্রেন চালু হবে আগামী বছরের ডিসেম্বরে।। মাজগ্রাম-পাবনা-ঢালারচর রেলপথ প্রকল্পে প্রথম বরাদ্দ ছিল ৯শ’ ৮২ কোটি ৮৭ হাজার টাকা। বর্তমানে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬শ’ ২৯ কোটি টাকা। প্রথম পর্যায়ের পাবনা পর্যন্ত কাজ শেষ হয়ে চলতি বছর ডিসেম্বর মাসেই ঈশ্বরদীর মাজগ্রাম থেকে পাবনা পর্যন্ত যাত্রীবাহী ও মালবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হবে, এমনটিই আশা করছে পশ্চিমাঞ্চলীয় রেলের উর্ধতন কর্মকর্তাগণ। পাবনা থেকে আন্তঃনগর ট্রেন সরাসরি ঢাকা পৌঁছবে পাবনা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে রাজধানী ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনে। ঢাকামুখী আন্তঃনগর ট্রেন ঈশ্বরদী জংশন হয়ে অল্প কয়েকটি স্টেশনে দাঁড়াবে। যাতে দ্রুত ঢাকা পৌঁছানো যায়। বর্তমানে রাজশাহী থেকে আন্তঃনগর ট্রেন ঈশ্বরদী বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে সরাসরি ঢাকা পৌঁছে। এদিকে যমুনায় বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু নির্মাণের সময়ই উত্তরবঙ্গ থেকে রাজধানী ঢাকার রেল যোগাযোগে বগুড়া- সিরাজগঞ্জ ৭৪ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি গুরুত্ব পায়। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ওই সময় এই রেলপথ নির্মাণের ফিজিবিলিটি স্টাডি করে। পরে প্রকল্পটি স্থগিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু সেতুতে রেললাইন স্থাপনের পর রাজধানী ঢাকা থেকে আন্তঃনগর ট্রেনকে ঈশ্বরদী হয়ে উত্তরবঙ্গে পৌঁছতে ৪ থেকে ৫শ’ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হয়। যার দেড় শ’ কিলোমিটারেরও বেশি ঘুরপথ। বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ মনসুর আলী রেল স্টেশন পর্যন্ত ৭৪ কিলোমিটার ডুয়েল গেজ রেল লাইন স্থাপিত হলে উত্তরবঙ্গের যে কোন জেলায় যেতে ৩ থেকে সাড়ে ৩শ’ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হবে। এতে সময় ও খরচ দুই-ই সাশ্রয় হবে। তখন ট্রেনে ঢাকা থেকে বগুড়া পৌঁছতে সময় লাগবে প্রায় ৪ ঘণ্টা। বগুড়া-সিরাজগঞ্জ সরাসরি রেলপথ নির্মাণের বিষয়টি নিয়ে প্রায় ২০ বছর ধরেই আলোচনা হচ্ছে। এই রেলপথ নির্মাণের দাবিতে বগুড়া ও সিরাজগঞ্জে আন্দোলন হয়েছে। ২ হাজার ১৫ সালের ১২ নবেম্বর বগুড়ায় আলতাফুন্নেছা খেলার মাঠের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেল লাইন নির্মাণের ঘোষনা দেন। এরপর ফাইল নড়েচড়ে ওঠে। সর্বশেষ এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ভারত লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় বাস্তবায়নের আগ্রহ প্রকাশ করে। তারই আলোকে ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোফাইল প্রণয়নের কাজ শুরু হয়ে তা শেষ পর্যায়ে। একাধিক সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বগুড়া-সিরাজগঞ্জ ডুয়েল গেজ রেল লাইন নির্মাণসহ পূর্বাঞ্চলেরও কয়েকটি রেল লাইন ও অন্যান্য প্রকল্প বাস্তবায়নের ফাইল ওয়ার্ক শুরু করেছে। শীঘ্রই উভয় দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে এ বিষয়ে চূড়ান্ত আলোচনার পর কাজ শুরু হবে। পাবনা ও বগুড়ার দুটি রেলপথ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে উত্তরাঞ্চলের সার্বিক অর্থনীতি আরও গতি পাবে। ব্রিটিশ শাসনামলে গত শতকের ১৯১৪ সালে পদ্মা নদীর ওপর হাডিঞ্জ রেলব্রিজ চালু হওয়ার সময় বলা হয়েছিল একটি লিংক রেল লাইন ঈশ্বরদী হয়ে পাবনা পর্যন্ত যাবে। এক শ’ বছরেও তা নির্মাণ হয়নি। বর্তমান সরকার দেশে রেল যোগাযোগের সার্বিক উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এ বিষয়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জানান, চলতি বছরের মধ্যে ঈশ্বরদীর মাজগ্রাম থেকে পাবনা পর্যন্ত মিশ্রগেজ লাইনে ট্রেন চালানো সম্ভব হবে। পাবনা থেকে ঢালারচর পর্যন্ত ট্রেন চলবে আগামী বছরে। উল্লেখ্য, বৃহত্তর পাবনা দেশের সবচেয়ে বড় তাঁতপ্রধান এলাকা। এই অঞ্চলের তাঁতের শাড়ি দেশের সুনাম ছাড়িয়ে বিশ্বের দরবারে বড় আসন করে নিয়েছে। পাশাপশি বগুড়া কৃষিপণ্য উৎপাদনে বড় ভূমিকা রেখেছে । পণ্য পরিবহন ও স্বাচ্ছন্দ্যে যাত্রী ভ্রমণে রেলপথ সুদূরপ্রসারী ভাবনা নিয়েই নির্মিত হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ সারা বিশ্বে স্বচ্ছন্দ ভ্রমণের জন্য রেল যোগাযোগকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। দেশে এতদিন রেলপথকে কম গুরুত্ব দেয়া হয়ছে। বর্তমান সরকার পূর্বাঞ্চলে ও উত্তরাঞ্চলে রেল যোগাযোগ বাড়াতে ব্যাপক পরিকল্পনা নিয়েছে।
×