ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দু’হাজার টাকায় ১০ তলা ভবন, তিন তলা লঞ্চ তিন হাজারে...

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ৪ জুলাই ২০১৭

দু’হাজার টাকায় ১০ তলা ভবন, তিন তলা লঞ্চ তিন হাজারে...

খোকন আহম্মেদ হীরা ॥ মাত্র দুই হাজার টাকায় মিলছে দশতলা ভবন। তিনতলা একটি যাত্রীবাহী লঞ্চ কিংবা পণ্যবাহী জাহাজ পাওয়া যাচ্ছে মাত্র তিন হাজার টাকার মধ্যে। তবে এগুলো আসল বসতবাড়ি কিংবা নৌপথে চলাচলের মতো কোন নৌযান নয়। বাস্তবকে অনুকরণ করেই দৃষ্টিনন্দন এসব জিনিসপত্র বাঁশ দিয়ে তৈরি করেছেন স্বল্পশিক্ষিত যুবক বেল্লাল সরদার (২৪)। পেশায় একজন ইলেক্ট্রিশিয়ান হলেও শখের বশে মাত্র এক বছরে তিনি বাঁশ শিল্পের মাধ্যমে শতাধিক শৌখিন শোপিস পণ্য নির্মাণের মাধ্যমে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। তার নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠেছে এসব শোপিস। বেল্লাল তার দক্ষতার মাধ্যমে স্থানীয় মানুষের মাঝে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন- আর্কিটেকচার, ডিজাইনার কিংবা কোন শিল্পীর তুলনায় তার শিল্পকর্ম কোন অংশেই কম নয়। বাঁশ দিয়ে তৈরি বেল্লালের সুরম্য নৌকা, চারতলাবিশিষ্ট জাহাজ, বসতঘর, মসজিদসহ প্রায় শতাধিক পণ্য চোখে দেখতে ও শৌখিন ক্রেতারা ক্রয় করার জন্য বরিশাল নগরীর নবগ্রাম রোড সোনামিয়ার পুলসংলগ্ন রফিক মার্কেটে ছুটে যাচ্ছেন। সেখানেই রয়েছে বেল্লালের এসব দৃষ্টিনন্দন শৌখিন শোপিস বিক্রির ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বেল্লাল জানান, তিনি মাত্র এক বছরের ব্যবধানে বাঁশ ও গাম ব্যবহারের মাধ্যমে তৈরি করেছেন বিভিন্ন তলাবিশিষ্ট একাধিক ভবনসহ ছোট-বড় দর্শনীয় বসতঘর, যার মধ্যে রয়েছে সর্বোচ্চ দশতলা ভবনও। পাশাপাশি তৈরি করেছেন নামাজের জন্য মসজিদঘর, একাধিক লঞ্চ, জাহাজ, নৌকাসহ প্রায় শতাধিক শৌখিন শোপিস। বেল্লালের হাতের ছোঁয়ায় বাঁশ শিল্পের মাধ্যমে নির্মিত তৃতীয় ও চতুর্থ তলার লঞ্চে রয়েছেÑ সিঙ্গেল এবং ডাবল কেবিন, সোফাসেট, ডেক ও বাথরুম ও লঞ্চের ইঞ্জিন রাখাসহ চালকের নির্দিষ্ট স্থান। একই ভাবে ভবন তৈরিতেও বেল্লাল রেখেছেন প্রবেশপথসহ উপরে ওঠার সিঁড়ি, নিচতলায় গাড়ি পার্কিংয়ের সুব্যবস্থা, প্রতিটি তলায় আলাদা কক্ষ, দরজা-জানালা ও বাথরুম। আর্কিটেক বা নেভাল আর্কিটেক যেভাবে নক্সা তৈরি করেন আঁকাজোঁকার মাধ্যমে, বেল্লাল ঠিক তেমনি তা বাঁশ দিয়ে তৈরি করে দিতে পারেন। জাহাজ, মসজিদ ও নৌকাগুলো তৈরিতেও তিনি দিয়েছেন নান্দনিকতার ছোঁয়া। বেল্লাল আরও জানান, তিনি প্রথমে বাঁশ দিয়ে একটি কবুতরের খাঁচা তৈরি করেন। পরবর্তীতে নিজের অদম্য ইচ্ছায় পর্যায়ক্রমে শৌখিন সব শোপিস তৈরি করেছেন। তাকে সরেজমিন নিয়ে যে কোন অফিস-আদালত, ভবন-বসতঘর, লঞ্চ-জাহাজ-নৌকা, উড়োজাহাজ ইত্যাদি চিত্র দেখালে তা তিনি বাঁশ দিয়ে তৈরি করে দিতে পারবেন। বেল্লাল ও তার আশপাশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের লোকজন জানান, বর্তমানে তার (বেল্লাল) তৈরি সব বাঁশ শিল্পের শোপিস শৌখিন ক্রেতারা ক্রয় করে নিয়ে যাচ্ছেন। জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার চাঁদপাশা ইউনিয়নের কোলচর গ্রামের কাঠমিস্ত্রি আব্দুর রহিম সরদারের তিন পুত্র ও এক কন্যাসন্তানের মধ্যে বেলাল সরদার দ্বিতীয়। অভাবের সংসারে তার বড় ভাইয়ের লেখাপড়া হয়নি। তিনি নগরীতে ইলেক্ট্রিশিয়ানের কাজ করেন। নিজের ও পরিবারের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আর্থিক সঙ্কটের কারণে এসএসসি পরীক্ষার আগেই বিজ্ঞান শাখার ছাত্র বেল্লালকে কর্মজীবনে নামতে হয়েছে। সেই থেকে অদ্যাবধি বেল্লাল তার বড় ভাইয়ের সঙ্গে নগরীতে বসবাস করেন। ইলেক্ট্রিশিয়ানের কাজ করার ফাঁকে বেল্লাল বাঁশ দিয়ে নানা কারুকার্যের শৌখিন শোপিস নির্মাণের কাজ করেন। ক্রেতারা বাঁশ শিল্পের এসব পণ্য যে কোন উৎসবে উপহার দেয়াসহ ঘরে আকর্ষণীয় শোপিস হিসেবে ব্যবহার করেন। এসব পণ্য তৈরির জন্য বেল্লাল ব্যবহার করেন বাঁশ, দা, করাত, হাতুুড়ি, বাটাল ও গাম। ইতোমধ্যে ছোট-বড় ভবন ও বসতঘর প্রতিটি তিনি ১২ থেকে ২২শ’ টাকায় এবং ১১টি লঞ্চ-জাহাজ ও নৌকা প্রতিটি তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। ওই সব শোখিন শোপিস তৈরি করতে তার ব্যয় হয়েছে দুই থেকে ১২শ’ টাকা। প্রতিটি জাহাজ নির্মাণ করতে তার কমপক্ষে ১৫ দিন ও সুরম্য বাড়ি নির্মাণে ১২ দিন এবং গ্রামের যে কোন ঘর নির্মাণে তার পাঁচ দিন পর্যন্ত সময় লাগে। শৌখিন ক্রেতা সাংবাদিক মনির হোসেন, তানভির আহমেদ অভি, মোঃ মিরাজ, আনোয়ার হোসেন, ফোরকান আহমেদসহ অনেকেই বলেন, বেল্লালের হাতে নির্মিত বাঁশের শোপিসগুলো দেশ-বিদেশে রফতানিযোগ্য। যে কোন শৌখিন ক্রেতা বেল্লালের তৈরি শোপিস দেখলে পছন্দের পাশাপাশি ক্রয় করে নেবেন। সরকারী ও বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বেল্লাল সরদার তার বাঁশ শিল্পের শোপিসগুলোকে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করে বেকার-যুবকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে দিতে পারেন।
×