ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

তিস্তার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি, চৌহালী রক্ষা বাঁধের ১০০ মিটার বিলীন

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ৪ জুলাই ২০১৭

তিস্তার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি, চৌহালী রক্ষা বাঁধের ১০০ মিটার বিলীন

স্টাফ রিপোর্টার, নীলফামারী ॥ তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধিতে সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে নীলফামারীর ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলা এলাকায়। এদিকে তিস্তার বন্যাদুর্গতদের জন্য সরকারের পক্ষে জেলা প্রশাসনের ত্রাণভা-ার হতে জিআরের ৪০ মেট্রিক টন চাল ও ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ডালিয়া বিভাগের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, গত দুদিন ধরে উজানের ঢলে তিস্তা নদীর পানি ডালিয়ার তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে বিপদসীমার (৫২ দশমিক ৪০) ১০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আসায় তিস্তা নদীতে বন্যা দেখা দেয়। এতে তিস্তা অববাহিকার ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার বিভিন্ন এলাকার চর ও গ্রাম প্লাবিত হয়ে ১০ হাজার পরিবার বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে। এদিকে উজানের ঢল কিছুটা কমে আসায় সোমবার তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার নিচে নেমে আসে। সকাল ৬টা থেকে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এতে পানি কমেছে ৩০ সোন্টিমিটার। তবে বিকেলে তিস্তার পানি আরও তিন সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পায়। যে কোন সময় উজানের ঢল নেমে এলে এতে নদীর পানি পুনরায় বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। বর্তমানে নদীর পানি বিপদসীমার নিচে নেমে আসায় তিস্তার বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটে। অপরদিকে তিস্তা নদীর বন্যাদুর্গতদের জন্য সরকারের পক্ষে জেলা প্রশাসনের ত্রাণভা-ার হতে জিআরের ৪০ মেট্রিক টন চাল ও ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ডিমলা উপজেলার জন্য ২৫ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ৩৫ হাজার টাকা এবং জলঢাকা উপজেলার জন্য ১৫ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ১৫ হাজার টাকা রয়েছে। জেলা প্রশাসক খালেদ রহীম বলেন, তিস্তা নদীর বন্যা হয়ে থাকে উজানের ঢলে। ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলায় বন্যার শুরুতেই যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের জন্য চাল ও নগদ অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছাড়া তিস্তার বন্যা এলাকায় সার্বক্ষণিক নজরদারি রাখা হয়েছে। চৌহালী রক্ষা বাঁধের এক শ’ মিটার বিলীন স্টাফ রিপোর্টার সিরাজগঞ্জ থেকে জানান, যমুনা নদীর ভাঙ্গনের কবল থেকে সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলা রক্ষায় নির্মাণাধীন বাঁধে সোমবার আবারও প্রায় এক শ’ মিটার এলাকাজুড়ে ধস নেমেছে। যমুনার প্রচ- ঘূর্ণাবর্তে ১০৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৭ কিলোমিটার এ বাঁধের খগেনেরঘাট অংশে সোমবার দুপুরে প্রায় এক শ’ মিটার এলাকা বিলীন হয়েছে। ১০ দিনের মাথায় এ ধস দিয়ে চলতি বছরে ছয় দফা ধসে গেল এ বাঁধ। নির্মাণে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণেই কাজ প্রায় শেষের দিকে যাওয়া বাঁধটি মূলত বারবার ধসের সম্মুখীন হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে এলাকাবাসী। তবে দায়িত্বপ্রাপ্ত টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ড এ ধস ঠেকাতে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। উল্লেখ্য, এপ্রিলে, ২ ও ১৬ মে, ৮ জুন, ২৩ জুন একই ভাবে এ বাঁধের বিভিন্ন অংশ ধসে যায়। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র এবং এলাকাবাসী জানায়, চৌহালী উপজেলা সদরের পৌনে ৪ কিলোমিটার এবং টাঙ্গাইলের সোয়া ৩ কিলোমিটার মিলে ৭ কিলোমিটার এলাকা রক্ষায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থানুকূল্যে ২০১৫ সালে ১০৯ কোটি টাকার এ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পের আওতায় নদীর পূর্বপারের টাঙ্গাইল সদর উপজেলার সরাতৈল থেকে দক্ষিণে নাগরপুর উপজেলার পুকুরিয়া, খগেনেরঘাট, সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার ঘোরজানের চেকির মোড়, আজিমুদ্দি মোড়, খাসকাউলিয়া, জোতপাড়া পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের জন্য কাজ শুরু হয়, যার ৯৫ ভাগ কাজ ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে। তবে হঠাৎ সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নদীর চৌহালীর খগেনেরঘাট অংশে প্রায় এক শ’ মিটারজুড়ে ধসে যায়। বাঁধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয় পাথরের বোল্ড ও জিওব্যাগ। সাধারণ স্রোতে আকস্মিক এ ধসে এলাকাজুড়ে সবার মাঝে আতঙ্ক দেখা দেয়। বাঁধের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়ার আগেই দফায়-দয়ায় এমন ধস নামায় নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি এলাকাবাসীকে নাড়া দিয়েছে। কাজ নিয়ে অসন্তোষ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে এলাকাবাসী। এদিকে বাঁধটির বারবার ধসে চিন্তিত তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহজাহান সিরাজ। তিনি জানান, বারবার ধসে আমরাও বিব্রত। বিষয়টি প্রধান প্রকৌশলী ও মহাপরিচালককে অবহিত করা হয়েছে। উর্ধতন কর্তৃপক্ষ দ্রুত বাঁধ পরিদর্শন করে কার্যকরী পদক্ষেপ নেবে। সিলেটের ১১ উপজেলায় বন্যা স্টাফ রিপোর্টার সিলেট অফিস থেকে জানান, বর্ষণ অব্যাহত থাকায় সোমবার সিলেটের বিভিন্ন স্থানে বন্যার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিলেটের ১১ উপজেলায় কম বেশি বন্যা দেখা দিয়েছে। রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, হাট-বাজারসহ কয়েকটি উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও পানি প্রবেশ করেছে। বন্যাকবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। পানিবন্দী মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছানো জরুরী হয়ে পেড়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। সিলেটের বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, ওসমানীনগর, গোলাপগঞ্জ, জকিগঞ্জ গোয়াইনঘাট, কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা সদর কম বেশি বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। টানা বর্ষণ ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা ঢলে এসব উপজেলার কোথাও এক মাস ধরে, কোথাও দুই সপ্তাহ ধরে বন্যা দেখা দিয়েছে। ফলে এসব এলাকার কয়েক লাখ মানুষ হয়ে পড়েছেন পানিবন্দী। বন্যা দীর্ঘমেয়াদী হওয়ায় চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন বন্যাদুর্গত মানুষ। গত প্রায় এক মাস ধরে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের বেশিরভাগ এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে রয়েছে। ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার, ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ও তলিয়ে রয়েছে পানির নিচে। বালাগঞ্জ উপজেলায় গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে বন্যা দেখা দিয়েছে। বালাগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের প্রতিটি কক্ষে পানি ঢুকে পড়েছে। এ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বারান্দা পর্যন্ত পানি রয়েছে। বালাগঞ্জ সদর ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয় ও উপজেলা ডাকবাংলোও রয়েছে পানির নিচে। পানির মধ্যেই কোনরকমে উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়। এদিকে বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষ এখন ত্রাণের জন্য হাহাকার করছেন। এ মুহূর্তে আক্রান্ত এলাকায় ত্রাণ হিসেবে শুকনো খাবার প্রদানের দাবি জানিয়েছেন তারা। বন্যাকবলিত এলাকায় শিক্ষামন্ত্রী সোমবার গোলাপগঞ্জ উপজেলার ভাদেশ্বর, শরিফগঞ্জ ও বাদেপাশা ইউনিয়নের বন্যাকবলিত মানুষের সঙ্গে মতবিনিময়কালে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, শেখ হাসিনার সরকার বন্যার্তদের পাশে আছে। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সরকারী কাজ ফেলে আপনাদের পাশে ছুটে এসেছি।’ ‘বন্যাকবলিত এলাকার একজন মানুষও না খেয়ে থাকবে না’ বলে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন শিক্ষামন্ত্রী। শিক্ষামন্ত্রী বন্যাকবলিত মানুষের খোঁজখবর নেন। দুর্গত লোকজনের হাতে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছাতে প্রশাসনকে জোর তাগিদ দেন। স্টাফ রিপোর্টার কুড়িগ্রাম থেকে জানান, কুড়িগ্রামে অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো। জেলায় ২১০ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে গত কয়েক বছরের ভাঙ্গনে ২১ দশমিক ২০ কিলোমিটার বাঁধ নদীগর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। এছাড়াও ৫১টি পয়েন্টে অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে ৪৮ কিলোমিটার বাঁধ। বাঁধ ভেঙ্গে পড়ায় ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে হাজার হাজার পরিবার। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের তৈয়ব খাঁ এলাকার আইজার রহমান (৬৫) জানান, তিস্তা নদীতে পানি বাড়ার ফলে ভাঙ্গন তীব্র আকার ধারণ করেছে। এ পর্যন্ত আটবার নদী ভাঙ্গনের ফলে বাঁধে আশ্রয় নিয়েছি। এবার বাঁধও ভেঙ্গে যাচ্ছে। জানিনা পরিবার নিয়ে কোথায় যাব। একই এলাকার ব্যবসায়ী মতিয়ার রহমান জানান, পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিস্তা নদীতে ভাঙ্গন বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতোমধ্যে তৈয়ব খাঁ বাজারের একাংশ নদীতে বিলিন হয়েছে। ভাঙ্গনের মুখে রয়েছে তৈয়ব খাঁ জামে মসজিদ, বিদ্যানন্দ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, তৈয়ব খাঁ বাজার, সার্বজনিন মন্দিরসহ শতশত বসতবাড়ি। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ধরলা নদীর পানি ব্রিজ পয়েন্টে ২৫ দশমিক ৩৫ সে.মি. তিস্তা নদীর পানি কাউনিয়া রেল ব্রিজ পয়েন্টে ২৮ দশমিক ৫ সে.মি. ব্রহ্মপুত্র নদের নুনখাওয়া পয়েন্টে ২৫ দশমিক ১৮ সে.মি. এবং ব্রহ্মপুত্র নদে চিলমারীর রমনা ঘাট পয়েন্টে ২২ দশমিক ৯৬ সে.মি. সোমবার সকাল ৬টায় পরিমাপ করা হয়। গত ২৪ ঘণ্টায় ধরলা নদীতে ১৫ সে.মি., তিস্তা নদীতে দশমিক ২৯ সে.মি., ব্রহ্মপুত্র নদের নুনখাওয়া পয়েন্টে দশমিক ১১ সে.মি. এবং ব্রহ্মপুত্র নদের চিলমারী পয়েন্টে দশমিক ১৩ সে.মি. পানি বেড়েছে। জেলা ত্রাণ শাখা সূত্র জানায়, জুন মাসের শেষ সপ্তাহে রাজারহাট উপজেলায় তিস্তা নদীর ভাঙ্গনে ৫০টি পরিবার এবং ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙ্গনে রাজিবপুর উপজেলায় মোহনগঞ্জ ইউনিয়নে ৪৯টি দোকান ঘর বিলিন হয়ে যায়। বাড়ি ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রত্যক পরিবারকে দু’হাজার টাকা ও ৩০ কেজি করে চাল এবং ক্ষতিগ্রস্তদের দোকান মালিকদের তিন হাজার টাকা এবং ৩ কেজি করে চাল দেয়া হয়। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম জানান, ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামতের জন্য ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হলেও পাওয়া গেছে মাত্র ৬০ লাখ টাকা। ইতোমধ্যে রাজারহাটের বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের তৈয়ব খাঁ এলাকায় তিস্তা নদীর ভাঙ্গনকবলিত স্থানে জিও ব্যাগ ও পাইলিংয়ের কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়াও ১০টি পয়েন্টে সংস্কার কাজে টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শুরু করা হচ্ছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
×