ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রবল বর্ষণে রাঙ্গামাটিতে ফের পাহাড় ধস ॥ জনমনে আতঙ্ক

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ৪ জুলাই ২০১৭

প্রবল বর্ষণে রাঙ্গামাটিতে ফের পাহাড় ধস ॥ জনমনে আতঙ্ক

নিজস্ব সংবাদদাতা, রাঙ্গামাটি, ৩ জুলাই ॥ প্রবল বর্ষণে রাঙ্গামাটির বিভিন্ন স্থানে ফের পাহাড় ধস হয়েছে। আরও ধসের ভয়ে শহরের উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে নতুন করে কয়েক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। রবিবার রাত থেকে সোমবার দিনব্যাপী ভারি বৃষ্টিপাত হওয়ায় শহরের মানুষের মধ্যে নতুন করে পাহাড় ধসের অতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। প্রবল বর্ষণে রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের মানিকছড়ি ডেপ্পা ছড়া এলাকায় নতুন করে পাহাড় ধসের কারণে ওই সড়কে সোমবার দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত যনবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সড়ক বিভাগ তাদের বুল ডোজার দিয়ে সড়কে ধসে পড়া মাটি সরানোর পর সড়কটি পুনরায় চালু হয়, এছাড়া ঘাগড়া এলাকায় মাটি ধস নেমেছে বলে সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ এমদাদ হোসেন জানান। বৃষ্টির কারণে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি সড়কের মেরামত কাজের গতিও থেমে গেছে বলে তিনি জানান। মহা দুর্যোগের ২১ দিনের মাথায় পাহাড় ধসের ঘটনায় রাঙ্গামাটি শহরের বিভিন্ন কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া কিছু পরিবার নিজ উদ্যোগে বাড়িতে ফিরে গেলেও সোমবার ভারি বর্ষণের কারণে আবারও তারা অনেকেই আশ্রয় কেন্দ্রে ফিরেছেন। পাহাড় ধসের আশঙ্কায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থান থেকে সরে যেতে রবিবার রাত থেকে শহরে মাইকিং করে জেলা প্রশাসন। গত ১৩ জুন পাহাড় ধসের ঘটনায় রাঙ্গামাটি শহরের ভেদেভদী, যুব উন্নয়ন বোর্ড শিমুলতলী, রূপনগর, মুসলিমপাড়া, মোনঘর এলাকা, ওমদা মিয়া হিলসহ বিভিন্ন স্থান থেকে ১৯টি আশ্রয় কেন্দ্রে ক্ষতিগ্রস্ত ৩ হাজার ২শ’ নারী-পুরুষ ও শিশু আশ্রয় নেন। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা আশ্রিতদের জন্য সরকার ও বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে ত্রাণ সহায়তার পাশাপাশি নাস্তাসহ দুই বেলা খাওয়া দেয়া হচ্ছে। গত রবিবার রাঙ্গামাটি সরকারী কলেজ ও বিএডিসি আশ্রয় কেন্দ্রসহ কয়েকটি আশ্রয় কেন্দ্র থেকে কিছু পরিবার যাদের ঘরবাড়ি পাহাড় ধসে সম্পূর্ন বিধ্বস্ত হয়নি তারাই নিজ উদ্যোগে রূপনগরসহ কয়েকটি স্থানে ঘরে ফিরেন। সোমবার থেকে আবারও মুষল ধারে বৃষ্টিপাত হওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিংয়ের পর কিছু কিছু পরিবার আশ্রয় কেন্দ্রে ফিরেছেন। রূপনগর এলাকার বাসিন্দা আব্দুল করিম, ইসমাইল, জহরা বেগম জানান, কয়েক দিন আগে পরিস্থিতি ভাল হওয়ায় আশ্রয় কেন্দ্রে থেকে কিছু কিছু পরিবার নিজ নিজ বাড়িতে চলে এসেছিল। কিন্তু বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড় ধসের আশঙ্কা রয়েছে জেলা প্রশাসন থেকে মাইকিং করায় যাদের ঘরবাড়ি ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে তারা আবার আশ্রয় কেন্দ্রে বা নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন। ভারি বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ায় পশ্চিম মুসলিমপাড়া ও শিমুলতলী এলাকা হতে নতুন করে ১২০ জন লোক আশ্রয় নিয়েছেন। জেলা প্রশাসক মোঃ মানজারুল মান্নান জানান, বৃষ্টির কারণে পাহাড় ধসের আশঙ্কায় ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় যারা বসবাস করছে তাদের নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে মাইকিং করেছি। প্রতিনিয়ত ভারি বৃষ্টিপাত হলে পাহাড় ধসের আশঙ্কা করছি। তাই এসব মাথায় চিন্তাভাবনা রেখে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পৌর এলাকায় কোথায় কোথায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় লোকজন বসবাস করছে তা দেখতে এবং ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করলে তাদের জোর করে হলেও আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যাতে পরবর্তীতে এ ধরনের পাহাড় ধসে কোন লোকজন দুর্ঘটনায় শিকার না হন। বর্ষণে ফের পানির নিচে চট্টগ্রাম নগরীর নিচু এলাকা স্টাফ রিপোর্টার চট্টগ্রাম অফিস থেকে জানান, ভারি বর্ষণে আবারও তলিয়ে গেছে চট্টগ্রাম নগরীর নিচু এলাকা। আলোচিত-সমালোচিত সেই মহেশখালের বাঁধ কেটে দিয়েও জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা মেলেনি। সোমবার দুপুর পর্যন্ত বৃষ্টিপাতে সড়ক চলে যায় পানির নিচে। অনেক ঘর-বাড়ি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও পানি ঢুকে যায়। বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে জনজীবন। বন্ধ হয়ে যায় বন্দর বহির্নোঙ্গরে পণ্য লাইটারিং। এছাড়া জলমগ্ন নগরীতে খালে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন এক বৃদ্ধ। বর্ষণ থামার কোন লক্ষণ নেই। আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, মৌসুমে বায়ুর প্রভাবে আরও কয়েকদিন এমন আবহাওয়া বিরাজ করতে পারে। রবিবার রাত থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকে সোমবারও। বিকেল ৩টা পর্যন্ত অঝোর ধারায় বর্ষণে নগরীতে এক ধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। বেশির ভাগ সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিশেষ করে নিচু এলাকাগুলোর সড়ক তলিয়ে যায় হাঁটু থেকে বুক পানিতে। সেখানে যানবাহন চলাচলের কোন অবস্থাই ছিল না। ইঞ্জিনে পানি ঢুকে স্থানে স্থানে বিকল হয়ে পড়ে থাকে সিএনজি বেবিটেক্সি এবং বিভিন্ন ধরনের যানবাহন। এতে করে পরিস্থিতি হয় আরও সঙ্কটময়। নিচু সড়কে একমাত্র ভরসা ছিল রিক্সা। তবে এর জন্য যাত্রীদের ভাড়া গুনতে হয় তিন গুণ পর্যন্ত। রাতের বৃষ্টি ভোরেও অব্যাহত থাকায় বিপাকে পড়েন অফিস যাত্রীরা। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিশু-কিশোরদের ভোগান্তি হয় আরও বেশি। বিশেষ করে সকালে যারা কোন রকমে স্কুলে যেতে পেরেছে তারা আটকা পড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। সড়কে যানবাহন না থাকায় চরম ভোগান্তির সৃষ্টি হয়। নগরীর আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, ছোটপুল, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড, বেপারিপাড়া, হালিশহর, শুলকবহর, চকবাজার, কাপাসগোলা, চাক্তাই, মুরাদপুর, ষোলশহর, বহদ্দারহাট, চান্দগাঁও, বাদুরতলা, কাতালগঞ্জ, প্রবর্তক মোড়সহ নিচু এলাকাগুলো পানিতে ডুবে যায়। নিচু সড়কগুলো প্লাবিত থাকায় যানবাহনের চাপ পড়ে তুলনামূলকভাবে উঁচু সড়কগুলোতে। একসঙ্গে এত গাড়ি উঠে পড়ায় সৃষ্টি হয় তীব্র যানজটে। ফলে ১০ মিনিটের পথ অতিক্রম করতে যানবাহনগুলোর কেটে যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সব মিলিয়ে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ে। পতেঙ্গা আবহাওয়া দফতরের কর্মকর্তা মোঃ রুবেল জানান, সোমবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে ১৪৫ মিলিমিটার। সাগরে এ মুহূর্তে কোন নিম্নচাপ কিংবা লঘুচাপ নেই। সমুদ্র বন্দরগুলোর জন্য কোন সতর্কতা সংকেতও নেই। মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় এ বৃষ্টিপাত হচ্ছে, যা বর্ষা মৌসুমে প্রকৃতির স্বাভাবিক আচরণ। বায়ু চাপের আধিক্যের তারতম্য থাকায় সারাদেশে বর্ষণ আরও কয়েকদিন অব্যাহত থাকতে পারে। খালে পড়ে বৃদ্ধের মৃত্যু অতিরিক্ত বর্ষণে পানিতে একাকার হয়ে যাওয়ায় নালা-নর্দমা এবং খাল আলাদভাবে চিহ্নিত করার উপায় নেই। ফলে ঘটছে দুর্ঘটনা। এমনই এক ঘটনায় রবিবার গভীর রাতে খালে পড়ে নিখোঁজ হন শীলব্রত বড়ুয়া স্বপন (৬০) নামের এক বৃদ্ধ। তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মচারী। সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তার লাশ উদ্ধার করা হয় নগরীর বাকলিয়া থানার মিয়াখান নগর এলাকার চাক্তাই খাল থেকে। দামপাড়া এলাকার মোহাম্মদ আলী সড়কের রয়েল গার্ডেন কমিউনিটি সেন্টারে একটি বিয়ের দাওয়াতে এসেছিলেন স্বপন। মধ্যরাতে সেখান থেকে তিনি যখন বের হন তখন বেশ বৃষ্টি চলছিল। অসাবধানতাবশত খালে পড়ে প্রচ- স্রোতের তোড়ে নিখোঁজ হয়ে যান এই বৃদ্ধ। প্রায় ১০ ঘণ্টা নিখোঁজ থাকার পর সোমবার দুপুর ১২টার দিকে তার মরদেহ ভেসে উঠে চাক্তাই খালে। পুলিশ মরদেহটি উদ্ধার করে। এরপর স্বজনরা এসে শনাক্ত করেন। বন্দর বহির্নোঙ্গরে পণ্য লাইটারিং বন্ধ ভারি বর্ষণ এবং বাতাসের কারণে সোমবার সকাল থেকেই চট্টগ্রাম বন্দর বহির্নোঙ্গরে মাদার ভেসেল থেকে পণ্য লাইটারিং বন্ধ থাকে। বৃষ্টিপাত, বাতাস এবং স্রোত তীব্র থাকায় লাইটার জাহাজগুলোর মাদার ভেসেলের পাশে অবস্থান নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এতে করে পণ্য হ্যান্ডলিং বন্ধ হয়ে যায়। বন্দর সূত্রে জানা যায়, সোমবার জেটিতে ১৭টি এবং বহির্নোঙ্গরে ৩৫টি জাহাজ অবস্থান করছিল। বহির্নোঙ্গরের জাহাজগুলোতে রয়েছে চাল, গম, চিনি, সিমেন্ট ক্লিংকারসহ বিভিন্ন পণ্য। এর মধ্যে জেটির জাহাজের কন্টেনার হ্যান্ডলিং স্বাভাবিক নিয়মে চললেও বহির্নোঙ্গরের জাহাজগুলো থেকে পণ্য লাইটারিং সম্ভব হয়নি। বিকেলে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এ অচলাবস্থা বিরাজ করছিল। চট্টগ্রাম অফিস থেকে স্টাফ রিপোর্টার মাকসুদ আহমদ জানান, রবিবার সকাল পৌনে সাতটা। অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঢুকলেও অভিভাবকরা ফিরে আসতে পারেননি বাসা পর্যন্ত। এর আগেই শুরু হয় বৃষ্টি। নগরীর নিম্নাঞ্চলগুলো অতিবৃষ্টির কারণে মাত্র ঘণ্টাখানেকের বৃষ্টিতে টইটম্বুর রাস্তা ও আশপাশ এলাকা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে না হতেই আবার বাসায় ফেরার পালা। আবহাওয়া অফিসের হিসাব অনুযায়ী নগরীতে সোমবার বৃষ্টিপাত হয়েছে প্রায় ১৮৭ মিলিমিটার। সকাল থেকেই অতিবৃষ্টির কারণে অনেক শিক্ষার্থী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোল ঘেঁষতে পারেনি। নগরীর নিম্নœাঅঞ্চলই নয়, সোমবারের বৃষ্টিতে অনেক পাহাড়ী এলাকাও পানির ঢলে ভেসেছে। বিশেষ করে পাহাড়তলী এলাকা নগরীর উঁচু এলাকা হিসেবে খ্যাত হলেও বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ী ঢলের পানি জমে জলমগ্ন হওয়ার ঘটনায় নগরবাসী হতবাক হয়েছে। নগরীর ষোলোশহর ২নং গেট এলাকায় পানি জমে গাড়ি চলাচল করতে পারেনি জিইসি থেকে বহদ্দারহাট পর্যন্ত। সাগরিকা মোড় থেকে বড়পুল পর্যন্ত পোর্ট কানেকটিং রোড প্রায় হাঁটুপানিতে ডুবে গেছে। বড়পুল থেকে আগ্রাবাদ লাকি প্লাজা এমনকি কমার্স কলেজ পর্যন্ত পানিতে থৈ থৈ অবস্থা। কোথাও কোমরপানি আবার কোথাও হাঁটুপানি হওয়ায় যান চলাচল ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি নৌকায় ভর করতে হয়েছে রাস্তায় থাকাদের। যাদের আর্থিক সামর্থ্য নেই, পরিবহনচালকদের উচ্চভাড়ার কারণে তাদের হেঁটে জল মাড়িয়ে বাসায় ফিরতে হয়েছে। আগ্রাবাদ এক্সেস রোড এলাকায় এক মাকে তার মেয়েকে নিয়ে কোমরপানিতে গা ভিজিয়ে বাসায় ফিরতে দেখা গেছে। এদিকে নগরীর চকবাজার, কাতালগঞ্জ, বাকলিয়া যেন অল্প বৃষ্টিতে তলিয়ে যায়। চট্টগ্রাম ও মুহসীন কলেজসহ চকবাজার এলাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বাসায় ফিরেছে রিক্সা ও রিক্সাভ্যানে। মেয়েদের চট্টগ্রামের রাস্তায় রিক্সাভ্যানে চড়ে কলেজ বা স্কুল থেকে ঘরে ফেরার চিত্র এ বৃষ্টিতে দেখা গেছে।
×