ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

কারাগার থেকে বিনোদন কেন্দ্র

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ৪ জুলাই ২০১৭

কারাগার থেকে বিনোদন কেন্দ্র

কারাগারের গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে থাকা রাজবন্দীর চোখে-মুখে ক্ষোভ-বিক্ষোভের আগুন ঝলসে ওঠার দিনগুলো আজও হয়নি ম্লান। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনকালে ছাত্র-যুবাসহ রাজনীতিকদের ধরে ধরে বন্দী করা হতো কারাগারে। জেলখানায় বসে পরীক্ষা দিলেন বন্দী সরদার ফজলুল করিম। কারাপ্রকোষ্ঠে মঞ্চ বানিয়ে হারিকেনের আলোতে নাটক ‘কবর’ মঞ্চস্থ করলেন রনেশ দাশ গুপ্তসহ অন্য রাজবন্দীরা। নাটক লিখলেন কারাবন্দী মুনীর চৌধুরী। কিংবা ঊনসত্তরের গণআন্দোলনকালে কারাগারের বাইরে ছাত্র-জনতার সেই মুহুর্মুহু তোলা সেøাগান ‘জেলের ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো’ সারাদেশকে প্রকম্পিত করে তুলেছিল। এই কারাগারে ঘন ঘন আসা-যাওয়া করতেন শেখ মুজিব, পাকিস্তানী জান্তা শাসকদের তখতে তাউস যিনি তুলেছিলেন কাঁপিয়ে। একাত্তরে শেখ মুজিবের নির্দেশে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে কারাগারের ফটক ভেঙ্গে বেরিয়ে এসেছিল বন্দীরা, মুক্তির জয়গান গাইতে গাইতে। আবার এই একাত্তরে পাকিস্তানী দখলদার হানাদার বাহিনী হাজার হাজার বাঙালীকে বন্দী করে রেখেছিল। রাতের অন্ধকারে কাউকে কাউকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হতো। সবচেয়ে হৃদয়বিদারক নৃশংস ঘটনা ঘটে পঁচাত্তরের তিন নবেম্বর। জাতীয় চার নেতাকে গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করা হয়েছিল। সবই দুঃসহ স্মৃতি আজও। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারজুড়ে কত ক্রন্দন, কত আহাজারি, নির্যাতনের প্রতিবাদে অনশনÑ সবই হয়ে আছে বেদনামথিত স্মৃতিবাহী দুঃসময়ের দিনলিপি হয়ে। বাইশ একর জমিজুড়ে পুরনো ঢাকার কেন্দ্রস্থলে ব্রিটিশ আমলে চালু হয় কারাগারটি। মুঘলযুগে ছিল যা নায়েব নাজিমদের আবাসস্থল। এখানেই দুর্গ স্থাপন করা হয়েছিল, যখন ঢাকা ছিল বাংলার রাজধানী। ইংরেজ, পাকিস্তান আমল পার হয়ে বাংলাদেশ যুগে কারাগারটি সম্প্রসারিত হতে হতে কেন্দ্রীয় কারাগারের তকমায় বিধৃত হয়েছিল। কত রাজবন্দী, অপরাধী ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলেছিল। এক বছর আগে যুদ্ধাপরাধীদেরও ফাঁসি হয়েছিল এই কারাগারে। এই কারাজীবন নিয়ে অনেক বন্দী লিখেছেন স্মৃতিকথা। বাঙালীর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও লিখেছেন কারাগারের রোজনামচা। যে জীবন ছিল দুঃসহ, বাইরের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন, স্বজন-পরিজনহীন এক নিঃসঙ্গ জীবন। তার সঙ্গে নিপীড়ন, নির্যাতন, অত্যাচারের কমতি ছিল না। দাগি অপরাধী আর রাজবন্দীকে একই প্রকোষ্ঠে রেখে বিপন্ন বিস্ময় জাগিয়ে তোলা হতো। এই কারাগারে অনেক বন্দী দীক্ষা নিয়েছে সমাজ পরিবর্তনের মন্ত্রে। বন্দীরা চিরকুট পাঠাতেন বাইরের সতীর্থদের কাছে নানা বিষয় তুলে ধরে। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিরা নানা কাজের সঙ্গে হতো জড়িত। বিশ শতকে হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মী জেলখানার অন্ধ প্রকোষ্ঠে সমবেত কণ্ঠে গেয়ে উঠত মুক্তির গান। কারান্তরালের জীবনে অনেকে গেয়ে উঠত নজরুলের সেই অমর গান কারার ওই লৌহকপাট কিংবা এই শিকল পরা ছল মোদের। বাঙালীর ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে ঢাকা জেলখানার অবস্থান মেলে। সেই কারাগারটি আজ আর নেই। স্থানান্তর করা হয়েছে কেরানীগঞ্জে। শত শত বছরের ইতিহাসকে ধারণ করা স্থানটিকে মাটিতে মিশিয়ে ফেলা হয়নি। বরং সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে যথাযথভাবে সংরক্ষিত করে নির্মাণ করা হচ্ছে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও পার্ক। দুই শ’ আটাশ বছরের ইতিহাস সমৃদ্ধ দেশের প্রথম তৈরি এই কারাগারের পরিত্যক্ত জমিটি সর্বোচ্চ কাজে লাগানোর পরিকল্পনাটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। যে কারাগারে তিনি যেতেন বন্দী পিতা শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করতে। কত অশ্রুজল গড়িয়েছে পিতা-কন্যার। সেই স্থানে তিনি সর্বোচ্চ সবুজায়ন, ন্যূনতম নির্মাণকে প্রাধান্য দিয়ে গড়ে তুলছেন বিনোদন সমৃদ্ধ এবং ইতিহাসমনস্ক এক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। দীর্ঘমেয়াদী সময় নিয়ে স্থানটিকে গড়ে তোলার কাজটি যাতে সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়, জাতির ইতিহাস যাতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পৌঁছে, সেই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে দেশ ও জাতি সমৃদ্ধ হবে প্রকারান্তরে। এই উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই এবং প্রত্যাশা করি এক দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা গড়ে উঠুক।
×