ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা বস্তিতে খুন, আল ইয়াকিন জঙ্গীদের অপতৎপরতা

প্রকাশিত: ০৬:০২, ৩ জুলাই ২০১৭

রোহিঙ্গা বস্তিতে খুন, আল ইয়াকিন জঙ্গীদের অপতৎপরতা

স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার ॥ মাতৃভূমি থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য একটি পরিকল্পনাপত্র তৈরি করে সরকার ইতোমধ্যে পত্রটি মিয়ানমার সরকারের কাছে হস্তান্তর করেছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে গত মে মাসে পরিকল্পনাপত্রটি মিয়ানমার সরকারকে হস্তান্তর করা হয়। এর আগেও বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গারা ফেরত গেছে স্বদেশে। পুরনো পদ্ধতির ধারাবাহিকতায় রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যাবে, নাকি নতুন কোন উপায় খুঁজে বের করতে হবে সে বিষয়ে আলোচনা করা হবে। মিয়ানমারকে দেয়া সরকারের পরিকল্পণাপত্রটির ব্যাপারে এখনও কিছুই জানায়নি তারা। এদিকে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী জঙ্গীগোষ্ঠী আল ইয়াকিনের ক্যাডাররা একের পর এক হত্যাকা- ও অপহরণের মধ্য দিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ দিন দিন অশান্ত করে তুলছে উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালী রোহিঙ্গা বস্তি। গত ১ মাসের ব্যবধানে ২ জন রোহিঙ্গা নেতাসহ ৩ জন রোহিঙ্গাকে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে খুন করেছে আল ইয়াকিন ক্যাডাররা। এতে খুন, গুম ও অপহরণ আতঙ্কে রয়েছে সাধারণ রোহিঙ্গারা। এসব সন্ত্রাসী ও বেআইনী ঘটনায় বস্তির আশপাশে অবস্থিত স্থানীয়দের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা বিরাজ করছে। মিয়ানমারের উগ্র সশস্ত্র সন্ত্রাসী জঙ্গী সংগঠন আল ইয়াকিনের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করতে বালুখালী ও কুতুপালং বস্তিতে অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে চিহ্নিত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। স্থানীয় এলাকাবাসীর দাবি ওই সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারসহ দ্রুত সময়ের মধ্যে বালুখালী রোহিঙ্গা বস্তি অন্যত্র সরিয়ে নেয়া না হলে ক্যাম্প বালুখালী ও কুতুপালংবাসী হুমকির মুখে পড়বার আশঙ্কা রয়েছে। সূত্র জানায়, সরকার চাইছে মিয়ানমার রোহিঙ্গা সমস্যার মূল কারণ খুঁজে বের করে এ সমস্যার সমাধান করুক। বাংলাদেশে আশ্রিত সব রোহিঙ্গাকে তারা ফেরত নিয়ে যাবে। এ বিষয়টি নিয়ে দুই পক্ষ আলোচনা করতে পারে। সরকারের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে স্বাভাবিক ও সুন্দর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক চাই। মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হবে। তিনি আরও বলেন, গত মাসগুলোতে আমরা দেখেছি মুসলিম উগ্রবাদের বিষয়ে মিয়ানমার চরম উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। তারা বলছে, গত অক্টোবরের পরে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে, শুধু তাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে আলোচনা করতে চায়। উল্লেখ্য, গত অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৮০ হাজার নতুন রোহিঙ্গা প্রাণভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এছাড়াও দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অন্তত আরও ৫ লাখ রোহিঙ্গা। জানা গেছে, জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল মে মাসে তিন সদস্যের একটি ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন গঠন করেছিল। তারা রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর অত্যাচারের বিষয়ে জানার জন্য দেশটিতে সফর করার কথা। কিন্তু মিয়ানমার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়ে দিয়েছে, এ বিষয়ে জাতিসংঘের কোন প্রতিনিধিদলকে তারা মিয়ানমারে প্রবেশ করতে দেবে না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পার্লামেন্ট সেক্রেটারি কিয়াও জেয়া বলেন, যদি তারা তদন্তের জন্য কোন দল পাঠাতে চায়, তবে তাদের মিয়ানমারে প্রবেশ করতে দেয়ার কোন কারণ আমরা দেখছি না। মিয়ানমারের এহেন আচরণে কক্সবাজারের সচেতন মহল তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। অপরদিকে, বালুখালী এবং কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তিতে কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। ওখানে দেশী, বিদেশী অখ্যাত, বিতর্কিত লোক, মিয়ানমারের বিদ্রোহী গ্রুপের ক্যাডার অবাধ বিচরণ করে থাকে। এতে সেখানে নানা প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী গ্রুপের অপতৎপরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বালুখালী ও কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তিতে রোহিঙ্গার ছদ্মবেশে অবস্থানকারী আল ইয়াকিন ক্যাডাররা প্রতিনিয়ত নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। তারা উন্নত এ্যাপস ব্যবহার করে প্রতিদিনের খবর ও চিত্র তৎক্ষণাৎ মিয়ানমারে অবস্থানরত জঙ্গীদের কাছে পৌঁছাচ্ছে বলে জানা গেছে। গত ১৩ জুন রাতে আল ইয়াকিনের ১০-১৫ জনের সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ কুতুপালং অনিবন্ধিত ক্যাম্পে হানা দিয়ে ই-১ ব্লক নেতা মোঃ আইয়ুব মাঝি ও কুতুপালং নিবন্ধিত ক্যাম্পের শরণার্থী আলী আহমদের পুত্র মোঃ সেলিমকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এর মধ্যে গত ১৮ জুন দুপুরে বালুখালী তেলীপাড়া খাল থেকে ভাসমান হাত পা বাঁধা ও গলা কাটা অবস্থায় মোঃ সেলিম এবং গত রবিবার রাতে অপহৃত রোহিঙ্গা মোঃ আইয়ুব মাঝির লাশ একই অবস্থায় উদ্ধার করে উখিয়া থানা পুলিশ। একইভাবে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গত ২৩ মে কুতুপালং নিবন্ধিত শরণার্থী ক্যাম্পের মালয়েশিয়া ফেরত মৃত ইমাম হোসেনের পুত্র মোঃ শফি প্রকাশ বলিকে রাতের অন্ধকারে ক্যাম্প থেকে অপহরণ করে জঙ্গলে নিয়ে খুন করেছে। ২৫ মে ক্যাম্পের অদূরে মধুরছড়া জঙ্গল থেকে রোহিঙ্গা মোঃ শফির প্রকাশ বলির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ১ মাসের ব্যবধানে ৩টি চাঞ্চল্যকর হত্যাকা- নিয়ে ক্যাম্প এলাকাসহ পুরো উখিয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। মিয়ানমার অভ্যন্তরে আল ইয়াকিনের ঘাঁটিতে অস্ত্র-বোমা সরবরাহসহ প্রতিমাসে মোটা অঙ্কের টাকা (চাঁদা) পাঠাতে একটি গ্রুপ গোপনে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। হুন্ডির মাধ্যমে নিয়ে আসা বিদেশী অর্থ ছাড়াও সশস্ত্র ক্যাডাররা রোহিঙ্গা বস্তির প্রতি পরিবার থেকেও চাঁদা সংগ্রহ করছে। এসবের নেতৃত্বে রয়েছে অস্ত্রের প্রশিক্ষক রোহিঙ্গা মাস্টার আইয়ুব ও ভয়ঙ্কর জঙ্গী মৌলভি শফিকুর রহমান। কিছুদিন আগে আল ইয়াকিনের জঙ্গী শফিককে গোয়েন্দা সংস্থা ধরে কক্সবাজার সদর পুলিশে সোপর্দ করেছিল। কিন্তু তার সহযোগীদের ব্যাপক তদ্বির, অঢেল অর্থ ব্যয় ও পুলিশের দুর্বল রিপোর্টের কারণে বেশিদিন কারাগারে থাকতে হয়নি ভয়ঙ্কর এ জঙ্গীকে। জামিনে মুক্ত হয়ে আবারও গা-ঢাকা দিয়ে গোপনে জঙ্গী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে। এতে উদ্বেগ উৎকন্ঠায় রয়েছে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকার বাসিন্দারা। উখিয়ার কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা বস্তি ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি আবু ছিদ্দিক, সাধারণ সম্পাদক মোঃ নুর জানান, অপহরণকারী ও খুনীদের মধ্যে বালুখালী বস্তির রোহিঙ্গা কলিম উল্লাহ, ইসমাইল, ছলিম উল্লাহ, মোঃ কালু, মোঃ ইসলাম, কুতুপালং বস্তির সন্ত্রাসী রোহিঙ্গা মোঃ জাবের, মোহাম্মদ নুর, মনির আহামদ, খুইল্যা মিয়া মুন্না, সেলিম, কলিমুল্লাহর নেতৃত্বে ২০-২৫ জনের সশস্ত্র একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গাদের থেকে অপরণ পূর্বক চাঁদা দাবি, খুন, ঘুমসহ বিভিন্ন হুমকি ধমকি দিয়ে যাচ্ছে। আবু ছিদ্দিক জানান, ঈদের পরের দিন কোন কারণ ছাড়াই সন্ত্রাসীরা এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে গুরুতর জখম করে তাকে।
×